ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক-গতি নিয়ন্ত্রণ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ ২৪ স্থানের উন্নয়ন হচ্ছে না by আনোয়ার হোসেন ও অরূপ রায়

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার রাস্তায় ২২টি বিপজ্জনক বাঁকে সড়ক সম্প্রসারণ ও বিভাজক দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এ এলাকার অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ আরও ২৪টি স্থানের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায়, যানবাহনের বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা না করায় এই বাঁক সম্প্রসারণে অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা।


হাইওয়ে পুলিশের মানিকগঞ্জ থানার তথ্যমতে, গত এক বছরে সাভার থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত প্রতি কিলোমিটারে গড়ে একটির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং প্রতি তিন দিনে একজন করে মানুষ মারা গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সাবেক পরিচালক শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সড়কের কারিগরি ত্রুটি ঠিক করা এবং আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা দরকার। বাঁক সম্প্রাসারণ ভালো উদ্যোগ। তবে যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে দুর্ঘটনা কমবে না। এ ক্ষেত্রে হাইওয়ে পুলিশকে আরও দায়িত্ববান হওয়া এবং দুর্ঘটনা কমাতে চালক ও পথচারীদের জন্য সচেতনতা কর্মসূচি নেওয়ার সুপারিশ করেছেন তিনি।
২২ বাঁক সম্প্রসারণ: বিপজ্জনক ২২ বাঁক সম্প্রসারণে ২২ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। প্রকল্পের অধীনে বাঁক সোজা করার লক্ষ্যে সড়কের কিছু অংশ সম্প্রসারণ ও সড়ক বিভাজক দেওয়া হবে। আগামী এপ্রিল মাসে এ কাজ শেষ হওয়ার কথা।
সওজ সূত্র জানায়, প্রতিটি বাঁকে বিদ্যমান মহাসড়কের ১৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত চার লেনে উন্নীত করা হবে। সড়ক বিভাজকও হবে ১৫০ থেকে ২৫০ মিটার। সব মিলিয়ে বাঁকগুলোকে কেন্দ্র করে সড়ক সম্প্রসারণ করা হবে ৩ দশমিক ৮১ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটার সড়কের জন্য ব্যয় প্রায় পাঁচ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। প্রতিটি বাঁকের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা।
গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, মহাসড়কের ধামরাইয়ের গোলড়া ও মানিকগঞ্জের জোকা এলাকায় দুটি বাঁক সম্প্রসারণের কাজ চলছে। জোকায় এই বাঁকেই গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর। তবে এই দুটি বাঁকে যে সড়ক বিভাজক দেওয়া হয়েছে, তা চওড়া ও উচ্চতায় মাত্র এক ফুট। ফলে এটা দূর থেকে চোখে পড়বে না বলে আশঙ্কা করছেন একাধিক চালক। স্থানীয় লোকজন জানান, গত সপ্তাহে বিভাজক নির্মাণের সময়ই একটি বাস সড়ক বিভাজকে উঠে যায়।
ঢাকা-মানিকগঞ্জ পথে যাত্রীসেবা পরিবহনের চালক মোশাররফ হোসেন বলেন, সড়ক বিভাজকে ধাতস্থ হতে চালকদের বেশ কিছুদিন লাগবে। রাতে হঠাৎ করে নতুন চালক এলে ভুল করে বিভাজকে উঠিয়ে দিতে পারেন।
তবে মানিকগঞ্জ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বাবুল সরকার বলেন, এই সড়ক বিভাজকের কারণে বাঁকে মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে না।
গোলড়া এলাকার বাসিন্দা ঠাণ্ডু মিয়া বলেন, এখানে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটতে দেখেছেন তিনি। তাঁরও আশা, বিভাজক ও সড়ক সম্প্রসারণ হলে দুর্ঘটনা কমবে।
সওজের মানিকগঞ্জ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সবুজ উদ্দিন খান বলেন, যে দুটি বিভাজক নির্মাণ করা হয়েছে, তা কিছুটা নিচু। এখন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হচ্ছে। সড়ক বিভাজক প্রায় সাড়ে তিন ফুট উঁচু করা হবে। এ ছাড়া বিভাজকের ৩০০ মিটার দূর থেকেই নানা সংকেত চিহ্ন দেওয়া হবে। ১০০ মিটার দূরে থাকবে গতি হ্রাসের ব্যবস্থা। তবে তিনি স্বীকার করেন, সড়ক সম্প্রসারণ ও বিভাজকের পর যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না।
সবুজ উদ্দিন খান জানান, ২২ বাঁক ছাড়াও এই মহাসড়কে ২৪টি ব্ল্যাক স্পট (অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা) আছে। সেগুলোতে এখন শুধু সাইনবোর্ড দিয়ে সতর্ক করা আছে। আপাতত আর কিছু করার চিন্তা নেই।
গতিই মূল সমস্যা: মহাসড়কের এই অংশে ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিসীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু চালকেরা তা মানছেন না। বাঁক সোজা করার উদ্যোগ নিলেও গতি নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সরকার হাইওয়ে পুলিশকে যানবাহনের গতিবেগ নিরূপণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ‘গতি পরিমাপক’ যন্ত্র দিয়েছে। মানিকগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশেরও এ ধরনের দুটি যন্ত্র আছে। তবে দায়সারাভাবে মাসে দু-একবার সেটা ব্যবহার করা হয়।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকায় মাসের ১০ ও ১১ তারিখ গতি মাপে পুলিশ। এ ছাড়া মাঝেমধ্যে শনিবার গতি পরিমাপ করা হয়। গত শনিবার সাভার লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (পিএটিসি) সামনে গতিসীমা পরীক্ষা করে হাইওয়ে পুলিশ। সূত্র জানায়, বাস, ট্রাক, কারসহ ২০০ যানবাহন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এগুলোর গতি ঘণ্টায় সর্বনিম্ন ৭০ থেকে সর্বোচ্চ ৯৩ কিলোমিটার।
এর মধ্যে যাত্রীবাহী বাসের গড় গতি ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ি চলেছে ৮০ থেকে ৯৩ কিলোমিটার গতিতে। এই পথে সর্বোচ্চ গতি ৬০ হলেও পুলিশ ৭০-এর ওপরে চলা যানচালকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ৭০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলা ৩০টি যানবাহনের চালকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলে হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
মানিকগঞ্জ হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁরা গতি নিয়ন্ত্রণে প্রায়ই অভিযান চালান। কিন্তু অতিরিক্ত গতিতে চলা বাস আটকালে যাত্রীরা হইচই শুরু করে। ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে। এ জন্য অভিযান চালানো কঠিন। তার পরও নিয়মিত মামলা দেওয়া হচ্ছে।
২৪ ব্ল্যাক স্পট: একই স্থানে একাধিক দুর্ঘটনা ও হতাহতের ঘটনা বিশ্লেষণ করে এআরআই সারা দেশে মহাসড়কে ২১৪টি ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে সাভার থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত মহাসড়কে ২৪টি অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ স্থান বা ব্ল্যাক স্পট আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে ব্ল্যাক স্পটগুলোর জন্যও ব্যবস্থা নিতে হবে।
ব্ল্যাক স্পটগুলো সাধারণত মহাসড়কসংলগ্ন বাজার, বাসস্ট্যান্ড ও চৌরাস্তার মোড়। এসব স্থানে ‘দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা শুরু’, ‘অতি দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা’ লেখা সাইনবোর্ড দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ।
সওজ সূত্র জানায়, মানিকগঞ্জের জোকায় তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর এআরআই ও সওজের বিশেষজ্ঞরা চালকদের ট্রাফিক সংকেত সম্পর্কে তাৎক্ষণিক পরীক্ষা নেন। রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে বাস, ট্রাক, কারসহ বিভিন্ন শ্রেণীর ২২ জন চালককে জিজ্ঞেস করলে ২১ জনই সড়ক সংকেত সম্পর্কে বলতে পারেননি।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এ জন্যই ব্ল্যাক স্পটে যানবাহনের গতি কমাতে সার্বক্ষণিক হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি রাখতে হবে। পাশাপাশি গতি কমানোর জন্য ঝাঁকুনি দেয় এমন গতিরোধক (স্পিড ব্রেকার নয়) দিতে হবে।
দুর্ঘটনা: সাভার থেকে পাটুরিয়া পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার মহাসড়কে ২০১১ সালে দুর্ঘটনা ঘটে ৮২টি। মারা গেছেন ১৩৮ জন। আহত হয় আরও অনেকে। অর্থাৎ মহাসড়কের এই অংশের প্রতি এক কিলোমিটার ১ দশমিক ১৭টি করে দুর্ঘটনা ঘটেছে গত বছর। ওই এলাকায় প্রতি তিন দিনে একজন করে মানুষ মারা গেছে।
হাইওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, এই হিসাবের বাইরেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত বা আহতদের স্বজনেরা স্থানীয় পর্যায়ে অনেক সময় মীমাংসা করে ফেলেন। সে ক্ষেত্রে পুলিশের কাছে সেসব দুর্ঘটনার হিসাব থাকে না।

No comments

Powered by Blogger.