চারদিক-এই তো নূরজাহান কবিরাজ!

কারওরান বাজারের ফুটপাত দিয়ে হাঁটাই মুশকিল। এপাশে গাড়ি, ওপাশে গাড়ি। ফুটপাতে আকস্মিক মোটরসাইকেল! পুরো সংসার নিয়ে কিংবা সারা দিন মোট বয়ে টুকরিতেই শুয়ে থাকা বিধ্বস্ত মানুষ, নোংরা, হৈ-হট্টগোল। তাই নিয়মিত এ পথে চলাচলের সময় চেষ্টা থাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার।


তেমনই একদিন। শীতের সন্ধ্যা। হুড়মুড়িয়ে হাঁটায় আরও তাগিদ দিচ্ছে কনকনে হাওয়া। গাড়ির হর্নে কান পাতা দায়, তার ওপর শীত। তাই কানও ছিলাম প্রায় বুঁজে। তার পরও কোথা থেকে যেন বেমক্কা ভেসে আসে বাঁশির সুর, ধাক্কা লাগে বুকে। থমকে দাঁড়িয়ে পিছু হটি। কারণ, যেখান থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসছিল, গতির তীব্রতায় মুহূর্তে সে জায়গা পেরিয়ে গেছি। পিছিয়ে দেখি, ফুটপাতে শোয়ানো এক ছোট্ট ফুটফুটে শিশু চারপাশে আলো ছড়িয়ে হাসছে। ছেঁড়া-নোংরা কাপড়ে ঢাকা তার শরীর। পাশেই বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন তার ফ্যাকাশে চেহারার বাবা। মেয়ের হাসিতে তাঁর চেহারাতে রুগ্ণতা ছাপিয়ে সুখের দীপ্তি। পাশে শুকনা মুখে মলিন পোশাকে এক নারী, শিশুটির মা আনোয়ারা খাতুন।
থমকে দাঁড়ানোর সময়ও ভাবিনি, এভাবে জড়িয়ে যাব আমি এক বাবার বাঁশি আর শিশুর হাসিতে। পুরুষটি বাঁশি থামালে বোকার মতো জানতে চাই, আপনার মেয়ে?
উত্তর এল রাজকীয় ভঙ্গিতে, ‘হ, নূরুজ্জামানের মাইয়্যা, নূরজাহান।’
নূরজাহানের হাসি আর ওর বাবার বাঁশির রহস্য খুঁজতে আমার চোখে জিজ্ঞাসা ফুটে উঠলে নূরুজ্জামান নিজে থেকেই জানান দেন, ‘ওয় বাঁশি না শুনলে ঘুমায় না। পথে থাহি। তয় মাইয়ার মেজাজ বড় কড়া। বাপের বাঁশি শুইন্যা দিলটা খুশ কইরা তয় ঘুমায়।’
আমাদের কথার এক ফাঁকে দেখলাম শিশুটি ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিন্ত হয়ে নূরজাহানের বাবা বাঁশি পাশে রেখে জানালেন নিজের কিছু কথা। বললেন, তিন মাস আগে তেজগাঁও বস্তিতে মেয়ের জন্ম। ওখানে ঘরভাড়া ছিল এক হাজার ১০০ টাকা। পোষাতে না পেরে শিশুসন্তানসহ পথেই ঠাঁই করে নিয়েছেন। এক সময় নূরুজ্জামানের পেশা ছিল কবিরাজি। এমন রাস্তার মানুষও ছিলেন না তিনি। শেরপুরের ঝিনাইগাতী থানার নলপুরা গ্রামে ছিল তাঁর বাপ-দাদার ভিটা। পাগলা নদী ঘরবাড়ি গ্রাস করলে পথে নামেন। সেও আজ থেকে পাঁচ-সাত বছর আগের কথা।
আনোয়ারা-নূরুজ্জামান দম্পতির আরেকটি ছেলে আছে। নাম বিজয়। বয়স ১০-১২ হবে। ছেলেকে অপরাজেয় বাংলাদেশ নামের এক এনজিও স্কুলে দিয়েছেন বলে জানালেন নূরুজ্জামান। তবে এও বললেন, ওরে কন্ট্রোলে আনতে হইব। স্কুলে যায়টায় না।
কিন্তু মেয়ের ব্যাপারে পুরো সচেতন বাবা। মেয়েকে নিয়ে স্বপ্নের বয়ান দিতে গিয়ে পথে পথে গাছগাছড়া বিক্রি করে রাতে পথে ঘুমানো নূরুজ্জামান বলেন, ‘ওরে আমি করিবাজ বানামু। দ্যাশবিখ্যাত কবিরাজ।’
আবারও বোকার মতো প্রশ্ন করি, ‘মেয়েরা আবার কবিরাজ হয় নাকি?’
এবার বাবা-মা দুজন একযোগে বলে ওঠেন, ‘হয় না আবার? আগের আমলে তো কত মহিলা কবিরাজ আছিল।’
নূরুজ্জামান বলেন, ‘আমার পূর্বপুরুষের পেশাও আছিল কবিরাজি। আমার বাপের কাছে শুনছি, মাইয়ারা নিকি পোলাগো চায়াও ভালো কবিরাজি করবার পারে। তয়, আমার মাইয়া পারব না ক্যা?’
গেল বছরটা কেটে গেছে স্বপ্নহীনতায়। নতুন বছরের হিম ঠান্ডা বাতাসে খোলা পথে জবুথবু হয়ে চমকে উঠি। চমকে উঠি এই বাবার স্বপ্ন দেখার সাহসে। তারপর আবার এগোতে শুরু করি নিজের পথে।
এ সময় জড়ো হওয়া পথের অন্য নারী-পুরুষ-শিশু টিটকিরি করে পেছন থেকে বলতে থাকে, ‘শুইন্যা গেলে হইব? আমাগো লেইগা কিছু করেন।’ আরেক দল বলতে থাকে, ‘আরে শুনল নিজের ট্যাকা কামানের লাইগা।’
পিছু ফিরি না আমি। মনে মনে উত্তর দিই, ওই বাবা-মেয়ে আমাকে যা দিল তা তো টাকা না। তোমাদের কীভাবে দেব? স্বপ্ন দেখার সাহস তো যার যার নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়।
ইসরাত জাহান

No comments

Powered by Blogger.