দূরদেশ-মিয়ানমার-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও বাংলাদেশের ভাবনা by আলী রীয়াজ

মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ হলে তা নাটকীয় বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। কয়েক মাস ধরেই বোঝা যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি করেছে এবং শিগগিরই দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে। গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার নেতাদের শীর্ষ বৈঠকে এ বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।


তিনি বলেছিলেন যে মিয়ানমারে অগ্রগতির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এর আগে অং সান সুচি মুক্তিলাভ করেন এবং তাঁকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতেও সম্মত হন মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা। তা ছাড়া ওবামা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানের সময় বলেছিলেন যে তিনি সবার সঙ্গে, এমনকি যেসব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, তাদের সঙ্গেও আলোচনার পক্ষপাতী।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে না বলা হলেও কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে জানা যাচ্ছিল যে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিছু আশু শর্ত দিয়েছিল। অং সান সুচির মুক্তি, নির্বাচনে তাঁর ও তাঁর দলের অংশগ্রহণে বাধা না দেওয়া, ভিন্নমতাবলম্বীদের বড় অংশকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া, চীনা অর্থানুকূল্যে নির্মীয়মাণ একটি বৃহদাকারের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল এবং কারেন গেরিলাদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি—এসব শর্তের মধ্যে গুরুত্ব লাভ করে। সেপ্টেম্বরের শেষে মিয়ানমার যখন ওই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করে দেয়, তখনই বোঝা যাচ্ছিল যে সম্পর্কোন্নয়নে মিয়ানমার শুধু আগ্রহীই নয়, এমনকি তার দীর্ঘদিনের বন্ধু চীনের সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরিতেও পিছপা হবে না।
৫০ বছর পরে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কারণ যে কেবল ওবামার দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং একে দেখা দরকার যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক ও সামরিক বিবেচনাপ্রসূত একটি দূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত হিসেবে। অনেকেই হয়তো লক্ষ করে থাকবেন যে ২০১০ সালের মধ্যপর্যায় থেকে, বিশেষত ২০১১ সালের গোড়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ এশিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে। সামরিক বিশ্লেষক এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞেরা এর বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্টিফেন ওয়াল্ট মনে করেন যে এই পরিবর্তনের কারণ চারটি: ইউরোপ এখন কোনো বড় ধরনের নিরাপত্তা-ঝুঁকিতে নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষা প্রয়োজন হবে; ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যর্থতা থেকে স্পষ্ট যে মধ্যপ্রাচ্যে জাতি গঠন চেষ্টা ভুল; এশিয়ার অর্থনৈতিক গুরুত্ব এবং এ ধারণা যে এশিয়ায় চীনের উত্থান ঘটছে এবং তা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া দরকার। এই চারটি কারণের সব বিষয়ে একমত না হলেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের অনেকেই এশিয়ায়, বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব-বলয় ক্রমবর্ধমান বলে মনে করেন। চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য এই ধারণাকে আরও জোরদার করেছে।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে গত এক দশকে চীন তার অর্থনৈতিক সাফল্যের ওপর ভর করে এশিয়ায় তার উপস্থিতি বাড়াতে চেষ্টা করছে। ২০১০ সালের তথ্যানুযায়ী, এশিয়ায় চীনের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের পরিমাণ হচ্ছে ৩০০ বিলিয়ন। এটি দেশের বাইরে চীনা বিনিয়োগের মোট প্রায় ৭২ শতাংশ। চীন এই বিনিয়োগ রক্ষায় তার রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। শুধু তা-ই নয়, চীন যদি এশিয়ায় তার বিনিয়োগ ও প্রভাবকে নিরঙ্কুশ করতে পারে, তবে তার পক্ষে পশ্চিম গোলার্ধে মার্কিনি প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হবে। মার্কিনি বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকদের একাংশের মধ্যে এ ধরনের একটা আশঙ্কা রয়েছে। এসব বিবেচনায়ই যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায়, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের মনোযোগ বাড়াচ্ছে।
যেহেতু পূর্ব এশিয়ায় বিশেষ করে দক্ষিণ চীন উপসাগরে প্রভাব বলয় বিস্তারের আর কোনো সুযোগ নেই, সেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মিয়ানমারকে তার প্রভাবে আনা কিংবা চীনা প্রভাব থেকে দূরে সরিয়ে আনা খুব জরুরি। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যেসব বিষয়ে দূরপ্রসারী শর্ত দিয়েছে বলে শোনা যায়, তার মধ্যে রয়েছে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক সম্পর্কে ছেদ ঘটানো। অতীতে মিয়ানমার উত্তর কোরিয়া থেকে হালকা অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় যে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা—আইএইএর সঙ্গে চুক্তি করুক। এটি মিয়ানমারের পারমাণবিক প্রকল্প বিষয়ে স্বচ্ছতা তৈরি করবে।
এ অঞ্চলে মিয়ানমারের আরেকটি গুরুত্ব হলো সমুদ্র-সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ নৌবাহিনী বা যুদ্ধজাহাজ-সংক্রান্ত। ভারতীয় মহাসাগরের এই অংশে বিশেষ করে মালাক্কা প্রণালির মুখ পর্যন্ত ভারতীয় নৌবাহিনীর রয়েছে কার্যত একচ্ছত্র আধিপত্য। চীন সেখানে তার প্রভাব বাড়াতে চাইলেও ভারত তাতে মোটেই খুশি নয়। মার্কিনিরা যদি মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করতে পারে, তবে সেটাও তাদের জন্য চীনা প্রভাব মোকাবিলায় সাহায্য করবে।
সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে দীর্ঘমেয়াদি বিবেচনায় মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে, চীন তাকে খুব সহজেই মেনে নেবে তা মনে করা অসংগত। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের বাণিজ্য সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ: ২০১০ সালে দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। এই সময় চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চীন প্রত্যক্ষভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করবে না। সম্ভবত চীন চাইবে এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে তার উপস্থিতি ও প্রভাব বাড়িয়ে ভারসাম্য তৈরি করতে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশের এসব পরিবর্তনের কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে কি না, সেটা বাংলাদেশের নীতিনির্ধারক, বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদেরা নিশ্চয়ই বিবেচনা করছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনায়ও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মিয়ানমার সফর এই বিষয়ে খানিকটা আশার সঞ্চার করে। কিন্তু এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ কতটা খোলামেলা, সেটা স্পষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার শর্ত হিসেবে কারেনদের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির কথা বলেছে কিন্তু রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের প্রসঙ্গ তোলেনি। এতে বোঝা যায়, বাংলাদেশ পর্দার অন্তরালে মিয়ানমার-যুক্তরাষ্ট্র যোগাযোগে সম্ভবত অংশ নেয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও অভ্যন্তরীণ জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মিয়ানমার পরিস্থিতির যেহেতু প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে, বাংলাদেশের উচিত হবে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জোর দিয়ে উপস্থাপন করা। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশে তার বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে উৎসাহী এবং বর্তমানে একটি বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, চীন-বাংলাদেশ বাণিজ্যের পরিমাণ ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের চেয়ে বেশি। নতুন পরিস্থিতিতে চীন তার বিনিয়োগ ও সম্পর্ক বিষয়ে কী ভাবছে সেটাও বিবেচনা করার বিষয়।
মিয়ানমার-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নয়ন ঘটবে বলে অনুমান করা যায়। বাংলাদেশ তার থেকে লাভবান হবে, না ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেটা অপেক্ষা করে দেখার বিষয় নয়, প্রয়োজন এই ঘটনাবলিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা।

ইলিনয়, ১৪ জানুয়ারি ২০১২
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.