কোটালীপাড়ার জনসভায় প্রধানমন্ত্রী-খালেদা জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতে পারবেন না by অমরেশ রায়,

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধ বিচারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া জামায়াতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পারবেন না। তার আন্দোলন দেশের মানুষ মেনে নেবে না। এ বিচার এখন মানুষের প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবেই।প্রধানমন্ত্রী বুধবার গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া সরকারি শেখ লুৎফর রহমান কলেজ মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এদেশ এগিয়ে যাবে, উন্নত হবে। মহাজোট সরকারের প্রায় তিন বছরে নিজ নির্বাচনী এলাকা কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রথমবারের মতো এ আগমনকে ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ২০০০ সালের ২২ জুলাই কোটালীপাড়ার যে মাঠে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল, সেই মাঠে বুধবার এ জনসভার আয়োজন করা হয়।
সকাল থেকেই কোটালীপাড়া ও বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া এবং গোপালগঞ্জ ছাড়াও মাদারীপুর, বরিশাল, পিরোজপুর, ফরিদপুরসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে নেতাকর্মীরা জনসভার মাঠে সমবেত হতে শুরু করেন। বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহন
এবং হেঁটে সাধারণ মানুষও এ জনসভায় যোগ দেন। অনেকেই এসেছিলেন বাইচের নৌকায় চড়ে। এক পর্যায়ে গোটা এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়।
এর আগে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা থেকে কোটালীপাড়া পেঁৗছে প্রধানমন্ত্রী প্রথমে কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এরপর নবনির্মিত পৌর ভবন উদ্বোধন শেষে বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য বিমোচন ও পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। এ সময় সেখানে বিশেষ মোনাজাতও করা হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রবীণ সাংবাদিক নির্মল সেন উপস্থিত ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন হয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। নির্বাচিত সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে এবং মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ও উৎসবের সঙ্গে ভোট দিতে পারে_ সেটা একমাত্র আওয়ামী লীগই প্রমাণ করেছে।
জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ এবং দেশের মানুষের কষ্ট দূর করতে জনগণের সহযোগিতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বারবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। এরপরও তার লক্ষ্য থেকে তাকে বিরত রাখা যায়নি। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরের অত্যাচার-নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিবরণ তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াতের দুই গুণ, দুর্নীতি আর মানুষ খুন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে সারাদেশে দুর্নীতি ও লুটপাট হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে উন্নয়ন হয়, দুঃখী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের দু'বছরে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। যেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যায়নি, সেখানে সোলার সিস্টেম চালু করে ঘরে ঘরে আলো পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে।
নিজ নির্বাচনী এলাকা কোটালীপাড়ার উন্নয়নে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনতিবিলম্বে শেখ লুৎফর রহমান সরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স চালুসহ অবহেলিত সব কলেজের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে; যাতে এলাকার ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের কাছে থেকেই লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। কোটালীপাড়াকে একটি আধুনিক শহর এবং ঘাঘর বাজারকে উন্নত করা হবে। এলাকার মৎস্যসম্পদের উন্নয়ন করা হবে, যাতে তা বিদেশেও রফতানি করা যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত আওয়ামী লীগ সরকার সাক্ষরতার হার ৪৫ থেকে ৬৫ ভাগে উন্নীত করলেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসে তা ৫০ ভাগে নামিয়ে আনে। খালেদা জিয়া চাননি দেশের মানুষ শিক্ষিত হোক। লেখাপড়ার নামে সরকারি অর্থ নিলেও তার এক ছেলে ড্রাগে এবং আরেক ছেলে দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বেেলন, শেখ হাসিনা এদেশ ও দেশের মানুষকে রক্ষা করে চলেছেন। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ চলবে।
দলের সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক ও তার বন্ধু মামুন হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছেন। ক্ষমতায় এসে যাতে খালেদা জিয়া এবং তার দুই ছেলে দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজত্ব গড়ে তুলতে না পারেন, সে জন্য সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।
কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট সুভাষ চন্দ্র জয়ধরের সভাপতিত্বে জনসভায় অন্যদের মধ্যে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, অ্যাডভোকেট তালুকদার মোহাম্মদ ইউনূছ এমপি, বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র শওকত হোসেন হিরন, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথ, মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহাবুদ্দিন মোল্লা, গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাজা মিয়া বাটু, সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী এমদাদুল হক, কোটালীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম হুমায়ুন কবির বক্তৃতা করেন।
'টেকসই উন্নয়নের জন্য
নারীর ক্ষমতায়ন অপরিহার্য'
নারীর প্রতি সহিংসতা, ইভ টিজিং, যৌন হয়রানিসহ যে কোনো ধরনের নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে রাজধানীর রূপসী বাংলা হোটেলে নারী উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রয়াস কর্মসূচি উদ্বোধনকালে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের কঠোর পদক্ষেপের ফলে ইভ টিজিং এবং নারীর প্রতি সহিংসতা ও সামাজিক বৈষম্য উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। নারীর জন্য সমান ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান গড়তে না পারলে সমাজ চিরতরে পিছিয়ে পড়বে। বাসস, ইউএনবি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। কেননা অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে দূরে রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সুষম ও টেকসই উন্নতির জন্য নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন অপরিহার্য। এ কারণে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় 'জয়ীতা' শীর্ষক এ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। তাই নারী উন্নয়ন এখন প্রধান আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং সংসদ উপনেতাসহ মন্ত্রিসভার উল্লেখযোগ্য সদস্য নারী। তবু দেশের নারী সমাজের বিপুল অংশ এখনও অবহেলিত।
নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকারের নানা পদক্ষেপ তুলে ধরে তিনি বলেন, তার আগের মেয়াদের সরকার প্রথম নারী উন্নয়ন নীতি প্রণয়ন করে। এবার সেটিকে যুগোপযোগী করে 'নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১' প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ইউনিয়ন পরিষদে সরাসরি নারী প্রতিনিধি নির্বাচন সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে বলেন, 'বিগত ইউপি নির্বাচনে ১২ হাজার ৮শ' পদের জন্য ৪৫ হাজার নারী প্রার্থী অংশ নেন।'
শেখ হাসিনা বলেন, 'বাংলাদেশের নারীরা এখন শুধু কৃষিকাজেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। আমরা তাদের শিল্প ও বাণিজ্য খাতে অবদান রাখার জন্য উদ্বুদ্ধ করছি।' তৈরি পোশাক খাতে ২৫ লাখ নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার সরকার এ খাতের প্রসার নিশ্চিত করেছে। এতে শুধু রফতানি আয় বেড়েছে তা নয়, গ্রামের বিপুল সংখ্যক অবহেলিত নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারী উদ্যোক্তারা যাতে তাদের পণ্য বাজারজাতকরণে কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয় এবং তারা যেন সঠিক দাম পায় সেজন্য সব বিভাগীয় নগরীসহ জেলা ও উপজেলায় ক্রমান্বয়ে 'জয়ীতা'র বিভিন্ন শাখা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
পরে প্রধানমন্ত্রী লোগো উন্মোচনের মাধ্যমে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন এবং ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নগরীর রাপা প্লাজায় স্থাপিত 'জয়ীতা'র উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
এর আগে কর্মসূচির শুরুতে জমকালো অনুষ্ঠানে পহেলা বৈশাখ, ঈদ, পূজা ও বিজয় দিবসসহ দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও উৎসবের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়।

No comments

Powered by Blogger.