অলক্ষ্যে সেসব দিন by কে জি মোস্তফা

সংবাদপত্রকে একটি কালের ইশতেহার অথবা ব্যক্তি ও কালকে ছাড়িয়ে কাল-নিরপেক্ষতার দলিল বলা যেতে পারে। এ দলিল নির্মাণে যারা নিবেদিত, সেই সাংবাদিকদের জীবন ঘরে আর পথে কোনো তফাৎ নেই। সাংবাদিকতার সাধ বড় মায়াময়! কিন্তু একদিন সেই মায়াবী জগত ত্যাগ করতে হলো আমাকে। জীবনের মোড় কখন যে কোনদিকে বাঁক নেবে, সর্বনিয়ন্তা ছাড়া কেউ আর জানে না। তবে পৃথিবীতে কোনো কিছুই হারিয়ে যায় না।

একদিন না একদিন তা ফিরে আসে কাছে। তখন তাকে চেতনা দিয়ে, সত্তা দিয়ে গ্রহণ করতে হয়। কেননা আশার বিরুদ্ধেও আশা করে মানুষ। সে যাই হোক, তত্কালীন সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক এবং সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ডিফাঙ্কট নিউজ পেপারের উদ্বৃত্ত সাংবাদিক হিসেবে আমি ১৯৭৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা বিভাগে যোগদান করি সহকারী সম্পাদক পদে। প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড পোস্ট। স্থিতিশীলতা অবশ্য সবারই কাম্য, তবু অজানা পরিবর্তন আশঙ্কায় ভরা ভবিষ্যত্। শুধু চাকরিমনস্ক হওয়া কাজের কথা নয়, সঙ্গে চাই ক্রিয়েটিভ কিছু করা। হঠাত্ কেন জানি মনে হলো, দৌড় তো সবে শুরু, ওপরে ওঠার দৌড়। বিখ্যাত হওয়ার মতো সফল হওয়ার মতো মাদক বুঝি আর কিছু নেই। তাকে তাকে থাকে তাই বুদ্ধিমান ভদ্রলোক। কোথায় কাকে ধরলে কাজ হতে পারে, যথার্থ সময় কীভাবে আনতে হবে চোখে জল সে কৌশল আছে তার জানা। প্রকাশনা বিভাগে আমার যোগদানের সময় পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট কথাশিল্পী মহিউদ্দিন আহমদ (আহমদ মীর)। উপপরিচালক পদে ছিলেন তিনজন। স্বনামধন্য চিত্রশিল্পী কালাম মাহমুদ (প্রকাশনা), সুসাহিত্যিক আতোয়ার রহমান (এডহক পাবলিকেশন) ও আবদুল ওহাব (প্রশাসন)। এখানকার নিয়মিত প্রকাশনা ছিল সংবাদবিষয়ক পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’, সাহিত্যবিষয়ক ‘মাসিক পূর্বাচল’ ও শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন ‘মাসিক নবারুণ’। প্রথমটির সম্পাদক ছিলেন কাজী মোজাম্মেল হক এবং সহকারী সম্পাদক খ্যাতিমান ছোটগল্পকার স্লমায়ুন কাদির। মাসিক পূর্বাচল-এর সম্পাদনায় ছিলেন বিশিষ্ট কবি, অনুবাদক ও উপজাতিবিষয়ক গবেষক-লেখক আবদুস সাত্তার। নবারুণ-এর সম্পাদকের পদটি ছিল শূন্য। একজন সিনিয়র সাব-এডিটরের দায়িত্বে অনিয়মিতভাবে তা প্রকাশিত হতো। প্রসঙ্গত, পাকিস্তান আমল থেকে প্রকাশনা বিভাগে অনেক স্বনামধন্য কবি-সাহিত্যিক চাকরি করতেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, ছন্দবিশারদ কবি আবদুল কাদির, সুসাহিত্যিক আফসার উদ্দিন আহমদ, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (স্বল্পকালীন), কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল (স্বল্পকালীন) প্রমুখ। কবি তালিম হোসেনকে সাক্ষাতে পেয়েছিলাম, তখন তিনি এলপিআরে। উল্লেখ্য, আশির দশকে সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগ ও প্রকাশনা বিভাগ একত্রিত হয়ে ‘চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরে’ রূপান্তরিত হয় এবং স্থানান্তরিত হয় সার্কিট হাউস রোডে তত্কালীন বাকশাল কার্যালয়ে। সংক্ষেপে এখন যা ডিএফপি নামে পরিচিত। আবার এক সময় যুক্ত হলো সরকারি বিজ্ঞাপন সংস্থা। সে যাই হোক, সংবাদপত্রের উদ্বৃত্ত সাংবাদিক হিসেবে পরবর্তীকালে আরও ক’জন এখানে নিযুক্তি পান। কেউ স্টাফ-রাইটার, কেউবা সাব-এডিটর পদে। তারা হলেন কবি খালেদা এদিব চৌধুরী, সৈয়দ মোস্তফা হোসেন, উর্দু অনুবাদক জাফর আলম, আজমল হোসেন খাদেম ও ফাতেমা আনসারী। জীবন জীবিকা নিয়ে হেঁটে যাওয়া পৃথিবীতে সম্ভবত সবাইকে একটু-আধটু সাহস খুঁজে পেতে হয়েছিল নিজেকে স্থিত করার জন্য। চাকরিতে যোগদানের অল্প কিছুদিনের মধ্যে আমাকে শিশু-কিশোর পত্রিকা নবারুণ সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হলো সরাসরি। জীবনযাত্রার চরিত্র পরিবর্তনের সাময়িক জটিলতার মধ্যে প্রথমে একটু খটকা লাগল। অবশ্য ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সবারই ছিল আন্তরিক অভিনন্দন। এমন স্বাগত সম্ভাষণ ও অভিনন্দন যেন দুর্লভ। আসলে নিয়তিই জীবন চালাচ্ছে নাকি নিজেই নিয়তিকে ডেকে আনছি, এ প্রশ্ন একটা হ্যালুসিনেশনের চক্করে ফেলে দিলো। সময়েরও এক মস্ত ভূমিকা আছে জীবনে। সময়কে সময় দিয়ে সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকতে হয়। কিন্তু সময়কে বেশি সময় দিলে সময় শত্রুতা করে বসে, যা উড়ে পুড়ে গেছে তাকে কুড়িয়ে এনে যখন যেখানে সেখানটাকেই শেকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.