হাফেজ্জী হুজুর-এর রাজনৈতিক চিন্তাধারা by মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান

বিংশ শতাব্ধীর শেষ বছরগুলোতে সারা দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক বীর পুরুষ ছিলেন হযরত মাওলানা মুহম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)। বাংলাদেশের লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর থানার লুধুয়া গ্রামের এক ঝাড়ঝোপ ঘেরা বাড়িতে ১৮৯৫ সালে এক সম্ভ্রান্ত দ্বীনদার পরিবারে মৌলভী মুহম্মাদ ইদ্রীস সাহেবের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু শৈশবকালেই তিনি উন্মুক্ত চিন্তা-চেতনায় মত্ত হয়ে নিভৃত পল্লী ছেড়ে পাড়ি দেন তৎকালীন ভারতের ঐতিহাসিক পানিপথ শহরে। তখন বালক মুহম্মাদুল্লাহ সেখানে তাঁর প্রখর ধীশক্তি বলে পবিত্র কোরআনে কারীমের ত্রিশ পারা স্বল্প সময়ের মধ্যে হেফজ করে নেন।

অতঃপর উচ্চশিক্ষার উচ্চাশা নিয়ে ভারতের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাহারানপুর মাদরাসায় গমন করেন এবং ১৯২৩ সালে ইসলামী শিক্ষার সর্বশেষ স্তরে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি নিজেকে মানবতার রঙে রঙিন করার মানসে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক সাধক, মানুষ গড়ার কারিগর, হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর দরবারে গিয়ে মুরিদ হন এবং প্রায় একই সময়ে আল্লাহর দুনিয়া থেকে শয়তানি কর্মকান্ড উচ্ছেদ করে ন্যায় ও ইনসাফের শাসন কায়েমের মাধ্যমে সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ বিতাড়নের অগ্রদূত, উপমহাদেশের আজাদী আন্দোলনের অবিসংবাদিত প্রাণপুরুষ, বিশ্ববরেণ্য আলেম, শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহ.)-এর হাতে জিহাদী বায়আত হন। মাওলানা থানভী (রহ.)-এর রূহানী চিকিৎসায় তিনি আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে সত্যিকার মানবতার পরিপূর্ণ চরিত্র অর্জন করেন এবং একজন সোনার মানুষে পরিণত হন। আর হযরত শায়খুল হিন্দ (রহ.)-এর হাতে হাত দিয়ে তিনি তার শিরায়-উপশিরায় শয়তান ও শয়তানির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার সপৃহা সৃষ্টি করেন। ফলে তিনি হয়ে যান মানব ও মানবতার পরম বন্ধু এবং শয়তান ও শয়তানি চক্রের চরম শত্রু। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) '৮১-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃতীয় এবং '৮৬-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ২য় স্থান অধিকার করে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনোদিন কারও সমালোচনা করেননি, কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটাননি, আজকালকার নেতাদের মতো কারও চামড়াছোলা বক্তব্য রাখেননি। তবে হ্যাঁ, যারা ইসলাম, মানবতা ও জাতির দুশমন বা দেশের ক্ষতির কারণ, তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করে দিতেন। যা ছিল জাতির প্রতি হিতাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণ কামনা। আর এটা শুধু নিজ দেশেই সীমাবদ্ধ ছিল না বরং দুনিয়াজুড়েই তাঁর চিন্তার ব্যাপ্তি ছিল। যেমন ইরাক-ইরান দুটি ভ্রাতৃপ্রতীম দেশ যখন পরসপরে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল এবং অজস্র জনবল, অর্থবল ভুলুণ্ঠিত হচ্ছিল, তখন সমগ্র বিশ্ব থেকে কেবল তিনিই একমাত্র ব্যক্তি ১৯৮২ সালে বেসরকারি শান্তি মিশন নিয়ে দু'দেশের মধ্যে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন। ইরানের ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি এবং ইরাকের একক প্রতাপশালী নেতা প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বৈঠক করে শান্তির বার্তা, মীমাংসার কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। অনুরূপ সৌদি আরবেও বিশ্বখ্যাত গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা শায়েখ আব্ধুল্লাহ বিন বায (রঃ)-এর সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করে বিশ্ব মুসলিমের সমস্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এমনকি হেরেম শরীফের আশপাশ থেকে অসামঞ্জস্যশীল দোকানপাট উঠিয়ে দেয়ারও প্রস্তাব রেখেছিলেন। এ পর্যায়ে ১৯৮৫ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তিনি বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও বায়তুল মুকাদ্দাস উদ্ধারের ফর্মুলাও পেশ করেছিলেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ১৯৮১ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ১৯৮৭ সালের ৭ মে পর্যন্ত খেলাফত আন্দোলন গঠন করে প্রকাশ্য রাজনীতি করে গেছেন। কিন্তু এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে মানুষের কষ্ট, জানমালের ক্ষতি এবং দেশের সম্পদ নষ্ট হওয়ার মতো কোনো কাজ করেননি। একদিনের জন্যও কোনোদিন হরতাল করেননি এবং কোনো হরতালকে সমর্থনও করেননি। হযরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন শান্তিপ্রিয় মানুষ, তিনি আদর্শের লড়াই করতেন, পেশীশক্তির লড়াই নয়, তাই তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কখনো জ্বালাও, পোড়াও, ভাংচুর ইত্যাদি করেননি বরং সেটা ঘৃণা করতেন এবং যখন কারও গাড়ি, বাড়ি ভাংচুরের কথা শুনতেন তখন আফসোস করতে করতে ব্যাকুল হয়ে যেতেন আর বলতেন, 'হায় কি সর্বনাশ, এতে তো দেশেরই ক্ষতি হয়ে গেল। এ জন্যই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। তওবার রাজনীতি চালু করেছিলেন। তিনি বলেছেন, আমাদের সব অপাংক্তেয় কাজের জন্য আমরা সবাই দায়ী, যারা ক্ষমতাসীন হয়ে দুর্নীতি, দুরাচার, অত্যাচার, অবিচার, জুলুম, শোষণ করেছে, তারা যেমনভাবে দায়ী, আমরা যারা তাদের ভোট দিয়ে, চেষ্টা করে ক্ষমতায় বসিয়েছি, তারাও সমভাবে দায়ী। সুতরাং আমাদের সবাইকে যার যার হক আদায় করে তওবা করতে হবে। এজন্য তিনি নির্বাচন পদ্ধতিতেও সংস্কারের প্রস্তাব করেছিলেন, যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার না হয়, পেশীশক্তির মহড়া না হয়, কালো টাকার ছড়াছড়ি না হয়। তজ্জন্য তিনি '৮৩ সালে ঢাকার আশরাফাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় নেতৃবৃন্দের গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব দেন এবং রূপরেখার ঘোষণা দেন। এতে তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, এভাবে নির্বাচন হলে সৎ ও ভালো মানুষ নির্বাচিত হতে পারবে এবং নির্বাচনও দ্বন্দ্ব, সংঘাত, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হত্যামুক্ত হবে। ১৪০৭ হিজরি সনের ৮ রমজান বৃহসপতিবার দুপুর পৌনে দু'টায় তিনি সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে মহান আল্লাহ তা'আলার ডাকে চলে গেলেন। আর আমরা পরদিন রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সর্বশ্রেণীর মানুষ-সবাই জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হয়ে স্মরণ করলাম, বরণ করলাম তাঁর নীতিকে, মেনে নিলাম যে, তাঁর চিন্তাধারাতেই আমাদের মুক্তি ও শান্তি অবধারিত। তাই মানুষ আজও মনে করে যে, আজকের এ সময়ে এমন মানুষটিরই প্রয়োজন ছিল। লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন

No comments

Powered by Blogger.