বনশূকরের দিনকাল by শরীফ খান

খন থেকে ৭০-৮০ বছর আগেও বাংলাদেশের গ্রামীণ বন-বাগান ও পতিত জমির ঝোপঝাড়ে ছিল বনশূকরের বসবাস। তখন জনসংখ্যা ছিল কম, প্রচুর পতিত জমি ও ঝোপজঙ্গল ছিল—ছিল নিবিড়-ঘন গ্রামীণ বন। শূকরসহ নানা ধরনের বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ছিল সেই গ্রামীণ বন। নির্বিঘ্ন ছিল তাদের বসবাস। তবে সুন্দরবন লাগোয়া এলাকায় বন্য শূকর সংখ্যায় ছিল বেশি।

আজ বাংলাদেশে গ্রামীণ বনও প্রায় বিরল, যৎসামান্য যা আছে, সেখানেও বন্য শূকরের দেখা মেলে না। এরা উধাও হয়ে গেছে সমৃদ্ধ শালবনগুলো থেকেও। মূলত সুন্দরবনেই আছে ওরা মহাসুখে। আর বৃহত্তর সিলেট-চট্টগ্রামের টিলা-পাহাড়ি বনে টিকে আছে অল্প কিছু, তবে নানা কারণে কমে যাচ্ছে দিনে দিনে।
শূকর। নামটা শুনতে হয়তো অনেকেরই ভালো লাগে না, চেহারাও বদখত, কিম্ভূতকিমাকার নাক-মুখ! কিন্তু এই প্রাণীরাই থুতনির চ্যাপটা-গোলাকার অগ্রভাগ দিয়ে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে খাদ্য অন্বেষণ করতে গিয়ে বন-বাগান-মাঠ-ঘাটে চাষ দিয়ে ফেলে। এই প্রাকৃতিক চাষ মাটির জন্য মহা-উপকারী, উপকারী গাছপালা-ফসলের জন্যও। এরাও প্রকৃতির লাঙল।
হরিণের পাশাপাশি বন্য শূকর সুন্দরবনের বাঘের অন্যতম খাদ্য। বাঘের খাদ্য হয়েই ওরা বনের খাদ্য-শৃঙ্খলে অসামান্য ভূমিকা রাখে। স্বভাবে নিরীহ-লাজুক, কিন্তু প্রয়োজনে আক্রমণাত্মক, একরোখা, গোঁয়ার ও বদমেজাজি। একবার খেপে গেলে বাঘকেও কেয়ার করে না। ভয়ংকর জেদি এরা—প্রয়োজনে দুঃসাহসী, মরণপণ লড়াকু বীর। দৌড়ে দুরন্ত, আবার তীব্র গতির দৌড়ের মধ্যে মুহূর্তেই থমকে স্থির হয়ে যেতে পারে। বিপদে পড়লে মানুষকে আক্রমণ করে। এমনকি মেরেও ফেলতে পারে। মারার কৌশলটা নির্মম। থুতনি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আগে ফেলে দেবে মাটিতে, তারপর নাভির গোড়ায় দাঁত বিঁধিয়ে পেট চিরে দেবে। এ রকম কাহিনি আমি শুনেছি। এও শুনেছি, তেড়ে আসা দাঁতালের কপালে যদি হাত ঠেকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বোকারামরা ঠেলতেই থাকে—পাশ থেকে এসে আক্রমণের বুদ্ধিটা মাথায় খেলে না। ওদের ঠেলার সঙ্গে তাল রেখে পিছিয়ে এসে নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে মানুষ বেঁচে যেতে পারে।
শূকর শিকারি (ফসল রক্ষার্থে) বহু মানুষ আজও বেঁচে আছেন বাংলাদেশে। ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা জার্মানির ডেভিড গাস্ট ১৯৭৩ সালে ১০০ টাকার পারমিটে সিলেটের কোনো একটি বন থেকে গুলি করে যে বুনো দাঁতালটিকে মেরেছিলেন, সেটির দুটি দাঁতের ওজন ছিল দেড় কেজি (এই তথ্যটি আমি অন্যের কাছ থেকে পেয়েছি), ওজন ছিল প্রায় ছয় মণ। আমার শৈশবে বৃহত্তর খুলনা জেলার গ্রামীণ বনে দু-চারটে শূকর টিকে ছিল।
বনশূকরের খাদ্য কচু-ঘেচু-ফলমূল-বাঁশের কোড়ল, নানান রকম ফল ও নানান রকম ফসল। মাটি খুঁড়ে এরা কেঁচো ও অন্যান্য পোকামাকড়সহ ব্যাঙও খায়। সুযোগ পেলে মাংসও খায়। পুরুষ শূকরের ছেদন দাঁত বাইরে বেরিয়ে থাকে। এদের ‘দাঁতাল’ বলা হয়। মেয়ে শূকরের ক্ষেত্রে এটা ঘটে না। এরা জল-কাদায় গড়াগড়ি খেতে খুবই পছন্দ করে। কাত হয়ে পড়া গাছ বেয়ে উঠতে পারে। পোষা শূকরের মতো বন্যরাও গাদাগাদি করে শোয়। বনশূকরের ইংরেজি নাম Eurasian wild Boar. বৈজ্ঞানিক নাম Sus Scrofa. লেজসহ শরীরের মাপ ১৬৫-৭০ সেমি। ওজন গড়ে আড়াই-তিন মণ। বছরে দুইবার বাচ্চা দেয়। প্রতিবার ছয় থেকে আটটি বাচ্চা হয়। শূকরের দুধের রং ও ঘনত্ব ফোঁটা হরিণের দুধের মতো। দাঁতালের দাঁত দিয়ে মানুষের গলার নানান রকম গয়না তৈরি করা যায়।

No comments

Powered by Blogger.