কোটি কোটি টাকার হরিলুটঃ ওয়াশ করতে হবে ওয়াসাকে

দেশের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত সংস্থায় পরিণত হয়েছে ঢাকা ওয়াসা। মিটার কারসাজি ও অন্যান্য খাতে দুর্নীতি ও লুটপাট করতে একটি চক্র বরাবরের মতোই সক্রিয় রয়েছে। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত আছেন ওয়াসার রাজস্ব বিভাগের ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। তাদের যোগসাজশে বিলিং সহকারীরা মিটার জালিয়াতি, অবৈধ ও বাইপাস সংযোগের মাধ্যমে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্যের মাসকাবারি আয় ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে চক্রভুক্ত সবার মধ্যে । তবে কাজীর গরু গোয়ালে না থাকলেও কেতাবে ঠিকই থাকে।

কাজেই বড় কর্তারা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার যে হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন, তা স্বভাবতই প্রতারণা-প্রহসনে পর্যবসিত হচ্ছে। এদিকে পানির যথেচ্ছ বিল পরিশোধ করতে গিয়ে ক্রমাগত চরম বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহকরা। আসলে ঘুষের টাকাই তাদের শোধ করতে হচ্ছে ভুয়া বিলের মাধ্যমে। অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। জানা গেছে, ওয়াসার মিটার রিডার ও রাজস্ব বিভাগের বিরুদ্ধে রয়েছে হাজারও অভিযোগ। নিয়মিত মাসোহারা না দিলে মিটার রিডাররা বিল করেন যেমন খুশি। আবার মাসোহারা দিলে বিলের টাকা কাটছাঁট করে দেন। এমনও অভিযোগ আছে, পাঁচ থেকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে ৭০-৮০ হাজার টাকার বিল নেমে যায় ১৫-২০ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ঘুষ দিতে রাজি না হলে মিটার রিডার সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে বাড়তি বিল করার হুমকি দিতেও ছাড়েন না। এ থেকেই অনুমান করা যায়, ওয়াসার দুর্নীতির বহর কোন মাত্রায় পৌঁছেছে এবং তার খেসারত বহন করতে গিয়ে সাধারণ গ্রাহকরা কতটা নাজেহাল হচ্ছেন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, মিটার রিডারদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নিয়ে প্রতিদিন শত শত ভুক্তভোগী ভিড় করছেন ওয়াসার জোনাল অফিসগুলোতে। কিন্তু ওয়াসার বিভিন্ন জোনের রাজস্ব কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত থাকায় তারা কোনো সুবিচার পাচ্ছেন না। এ সম্পর্কে স্বয়ং ওয়াসার প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তাও 'সুনির্দিষ্ট অভিযোগ' পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন! অথচ সম্প্রতি তিনি বলেছেন, বড় বড় ভবনে অনেক সময় কম বিল দেখে মনে হয় দুর্নীতি হচ্ছে। নইলে এত কম বিল হবে কেন? তার এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? শুধু মিটার কারসাজি, অবৈধ ও বাইপাস সংযোগের মাধ্যমেই নয়, অন্যান্য খাতেও ওয়াসার দুর্নীতি-অনিয়ম মারাত্মক আকার নিয়েছে। জানা গেছে, জেনারেটর চালানোর নামে তেল চুরি করে ওয়াসায় বছরে লুটপাট হচ্ছে ৯ কোটি টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজ না করেও মাসে ওভারটাইম আদায় করছেন বেতনের দশ-বারো গুণ বেশি। সিষ্টেম লসের নামে বছরে লুট হচ্ছে দেড়শ' কোটি টাকা। এছাড়া মিটার নেই এমন ৭০ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে নিয়মিত মাসোহারা। ওয়াসার এক অডিট রিপোর্ট অনুসারে, সংস্থাটির সাড়ে ৮শ' কোটি টাকার কোনো হদিস নেই। মোট সাতাশটি খাতে আট বছরে এই টাকার অনিয়ম করা হয়েছে। এদিকে ১৯৯৬-২০০৩ সাল পর্যন্ত ওয়াসার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে অভিযোগের সংখ্যা ছিল ৬৬২টি। এসব অভিযোগের প্রধান খাত হচ্ছে, অবৈধ পানির সংযোগ, ভ্যাট, সংযোগ বিচ্ছিন্ন ও পানি প্রবাহের সংযোগ ফি। এসব খাতে ধরা পড়েছে শত শত কোটি টাকার দুর্নীতি। এছাড়া আয়কর, ষ্টোর চার্জ, নৈশ ভাতা, পুরনো মালামালের নিলাম, অতিরিক্ত জ্বালানির ব্যবহার, কর্মচারীদের বিলের পরিমাণ নিয়ে অনিয়ম ইত্যাদি খাত থেকে আত্মসাৎ করা হয়েছে বিপুল অংকের টাকা। এমনকি বাণিজ্যিক সংযোগকে আবাসিক দেখিয়েও ফি বছর কোটি কোটি টাকা মেরে দেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আমার দেশ-এ গত ৩০ আগষ্ট। ওয়াসা রাজধানীতে পর্যাপ্ত পানি জোগান দিতে পারছে না। তাদের নিজেদের হিসাব মতেই পানির বর্তমান ঘাটতি প্রতিদিন ২০ কোটি লিটার। যা দিচ্ছে তার সবটাই আবার পানযোগ্য নয়। নানা সঙ্কটে জর্জরিত সেই সংস্থায় কী করে ঘুষ-বাণিজ্য এবং লুটপাট এত নির্বিঘ্নে চলতে পারে তা ভাবতেও কষ্ট হয়। মানুষকে জিম্মি করে এই আর্থিক হরিলুটের উৎস বন্ধ করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। ওয়াশ করতে হবে ওয়াসাকে। নইলে 'দিনবদল' হবে না-না ওয়াসার, না মানুষের।

No comments

Powered by Blogger.