শেয়ারবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের তারল্যের সরাসরি যোগ ছিল

পুঁজিবাজারের সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের তারল্যের সরাসরি যোগ ছিল বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে, স্পষ্টতই এই তারল্য পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে পুঁজিবাজারের ধসকে সম্পর্কিত করা যায়।
‘২০১০-১১ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি’র ওপর সিপিডি পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তারল্যসংক্রান্ত বিধিমালা লঙ্ঘন করে ব্যাংকগুলো ঋণপ্রবাহ পুঁজিবাজারে স্থানান্তর করছিল। সে সময় বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থের মজুদ রাখার অনুপাতও বাড়িয়ে দেয়। তাই যেসব ব্যাংক পুঁজিবাজারে অনেক বিনিয়োগ করে ফেলেছিল, তারা শেয়ার বিক্রি করে ফেলতে বাধ্য হয়। ফলে পুঁজিবাজারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হলো হঠাৎ বিরাট ধস।
সিপিডির কার্যালয়ে গতকাল শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন পর্যালোচনা (আইআরবিডি)’ শীর্ষক কর্মসূচির অধীনে প্রস্তুতকৃত গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়কালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন বৃদ্ধির সঙ্গে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ কমে যাওয়ার একটি তাৎপর্যপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক আছে।
পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধির পরও খেলাপি ঋণ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে সিপিডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আবার অর্থবছরের প্রথমার্ধে ব্যাংকগুলোর লাভের পরিমাণ বেড়েছে, যা সম্পদের ওপর প্রাপ্তি অনুপাতে প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে এই মুনাফাকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে প্রাপ্ত লাভের প্রতিফলন হতে পারে বলে উল্লেখ করেছে সিপিডি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজার থেকে প্রাপ্ত মুনাফার ক্ষেত্রে ২০০৯ সালের তুলনায় ২০১০ সালে ১৫০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
তারল্য পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের শুরুতেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমতে শুরু করে। অর্থবছরের শুরুতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। ২০১০ সালের জুনের শেষার্ধের তুলনায় একই বছরের নভেম্বর এবং ২০১১ সালের জানুয়ারিতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ যথাক্রমে ২২ দশমিক ৪ এবং ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ কমে যায়।
এ নিম্নগতির পেছনে পুঁজিবাজারের মূল্যসূচক বেড়ে যাওয়া (ডিসেম্বর পর্যন্ত), বিনিয়োগ চাহিদা বৃদ্ধি, আমদানির উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার বড় দরপতন অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে সিপিডি মনে করে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে যেখানে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা, সেখানে ২০১১ সালের এপ্রিলে তা বেড়ে হয়েছে ২৮ হাজার ২৫ কোটি টাকা। তবে অতিরিক্ত তারল্য বর্তমানে যে পরিমাণ আছে, তার পরিমাণ বছরের শুরুর তুলনায় তিন হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা কম।
সিপিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, মুদ্রাবাজারেও তারল্য-ঘাটতির এ প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। কলমানি (স্বল্প সময়ের জন্য এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকের ধার করা অর্থ) সুদের হার ২০১০ সালের জুন মাসে ছিল ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ, যা নভেম্বর এবং ২০১১ সালের জানুয়ারিতে বেড়ে যথাক্রমে ১১ দশমিক ৪ ও ১১ দশমিক ৬ শতাংশে দাঁড়ায়। আর এপ্রিলে তারল্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও এই সুদের হার ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ।
সিপিডি বলছে, উচ্চ সুদের হারের মাধ্যমেও তারল্যসংকট প্রতিফলিত হয়। ২০১০ সালের জুলাই থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের সুদের হার কমে আসতে শুরু করে এবং নভেম্বর মাসে গড়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে সুদের হার আবার বাড়তে থাকে এবং মার্চে তা ১২ দশমিক ৮০ শতাংশে পৌঁছায়।

No comments

Powered by Blogger.