সবুজ উন্নয়ন ও বাংলাদেশ by স্টিফান প্রিজনার

২০১১ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘আপনার সেবায় প্রকৃতি ও বন’। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি কেবল এক দিনের একটি আহ্বান নয়, বরং এ দেশের বনভূমি রক্ষা করার লক্ষ্যে কার্যকর আন্দোলনের সূচনা। এই আহ্বান জীবনের গুণগত মানের সঙ্গে বনভূমি ও এর প্রতিবেশের মধ্যে আন্তসম্পর্কের তাৎপর্য তুলে ধরে। জাতিসংঘ এ বছরটিকে আন্তর্জাতিক বনভূমি বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছে—প্রতিপাদ্যটি এ ঘোষণার সহযাত্রী। তাই এ প্রতিপাদ্য সত্যিকার অর্থে সবুজে ঘেরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে এক শক্তিশালী আহ্বান।
জলবায়ু ও পরিবেশের বিদ্যমান বাস্তবতায় এই আহ্বান গুরুত্ববহ। পৃথিবীর ভূ-ভাগের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বনের ওপর নির্ভরশীল। বনভূমি বিশ্বের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এবং বিভিন্ন স্তরে জীবন বাঁচিয়ে রাখে। বনভূমি অক্সিজেন সরবরাহ ও কার্বন শোষণ করে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমাদের যে নিয়ত সংগ্রাম, তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
অথচ পৃথিবীতে বনভূমি আজ বিপর্যস্ত। প্রতিবছর ৩৬ মিলিয়ন একর প্রাকৃতিক বনভূমি মানুষের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। নির্বিচারে বন ধ্বংস করার ফলে বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ।
বাংলাদেশের জন্যও বনভূমি ধ্বংস ও বন সংকোচন মারাত্মক উদ্বেগের বিষয়। স্বাধীনতাপূূর্ব সময়ে এ দেশে বনভূমির আয়তন ছিল মোট ভূখণ্ডের ২০ শতাংশ। সেই অনুপাত উদ্বেগজনক হারে কমে এসেছে। জাতীয় সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) বিশ্লেষণে বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের উন্নতি দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বনভূমি প্রতিনিয়ত ধ্বংস ও সংকোচনের কারণে বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন। ভাওয়াল-মধুপুর গড়, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও সুন্দরবন অঞ্চলের বনভূমি ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে। এমনকি বর্তমানে সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ যতটুকু বনভূমি রয়েছে, তা-ও উজাড় হয়ে যাচ্ছে নির্বিচারে। পার্বত্য এলাকাগুলোতে অর্থকরী ফসল চাষের ফলে বনভূমি কমে আসছে। সেখানে বনভূমি কৃষিজমিতে পরিণত হওয়ায় মাটি ক্ষয় হচ্ছে, সংকুচিত হয়ে আসছে নদী। বনভূমি কমে যাওয়ার ফলে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। সুন্দরবনের বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকাগুলোয় ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বেড়েছে।
ইউএনডিপির উন্নয়ন-প্রচেষ্টার একটি অন্যতম বিষয় হলো পরিবেশ রক্ষা। ইউএনডিপি বাংলাদেশের উন্নত পরিবেশগত ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা; জীববৈচিত্র্য রক্ষা; জ্বালানি সাশ্রয় এবং সমন্বিত ধারণার প্রচার ইত্যাদি বিষয় নিশ্চিত করতে নীতি ও কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা প্রকৃত অর্থে দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন বাস্তবতা বাংলাদেশে উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলোতেও গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তন-সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে ন্যায্য ও স্বচ্ছ করতে আন্তর্জাতিক সমাজকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের ডাক দিতে যে আন্তর্জাতিক মঞ্চ রয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সমন্বিত দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমন ও ব্যবস্থাপনা-পদ্ধতি জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় সদা সতর্ক। ইউএনডিপি পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ বনায়নে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দেবে। এই বন উপকূলীয় ঝড় প্রতিরোধ করবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনবে। এ ধরনের সার্থক অভিযোজন প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের দরকার কার্যকর ধারণা, প্রযুক্তি ও সুযোগকে খুঁজে বের করা এবং সেগুলোকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন-প্রক্রিয়াকে সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও টেকসই করবে।
বাংলাদেশের এ ধরনের নতুন ও সুদূরপ্রসারী উদ্যোগে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ইউএনডিপি এবং এর অন্যান্য উন্নয়ন-সহযোগী। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস ও অভিযোজনের কাজ যাতে একসঙ্গে চলে এবং বাংলাদেশের যথার্থ টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হয়, সে জন্য একসঙ্গে কাজ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিকগুলো থেকে দেশকে সুরক্ষা দেবে।
ইউএনডিপির বর্তমান কার্যক্রমে জলবায়ু পরিবর্তন হ্রাস এবং সবুজায়িত উন্নয়নের বিষয়টি বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইট প্রস্তুতের জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রমে বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করছে ইউএনডিপি।
বাংলাদেশে ইটভাটায় গাছ ও কাঠ ব্যবহার নিষিদ্ধ হলেও দেশের অধিকাংশ ইটভাটার প্রায় ৩৩ শতাংশ জ্বালানি হিসেবে এখনো কাঠ ব্যবহূত হয়। দেশে এখন প্রায় আট হাজার ইটভাটা। এগুলোর মধ্যে ৯৫ শতাংশ ইটভাটাই সনাতন পদ্ধতির, যারা জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করে। ফলে প্রকটভাবে বনভূমি ধ্বংস করে। ইউএনডিপির সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার পাঁচ বছরের এই প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশদূষণ হ্রাস এবং দক্ষভাবে জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশে ইট তৈরির নতুন প্রযুক্তি জনপ্রিয় করতে সচেষ্ট। এই প্রকল্পের লক্ষ্য, ১৫০ বছরের পুরোনো প্রযুক্তির পরিবর্তে ইট তৈরিতে নতুন জ্বালানি-সাশ্রয়ী ও ধোঁয়ামুক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার। এ প্রকল্প সফলভাবে সম্পন্ন হলে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে আসবে, যা দুই লাখ ৩০ হাজার যাত্রীবাহী গাড়ি অথবা দুই লাখ ৫০ হাজার একর পাইন বন থেকে কার্বন নিঃসরণের সমান। আশা করা যায়, এই প্রকল্পের সফল পরিসমাপ্তির মাধ্যমে বিদ্যমান আট হাজার ইটভাটার জায়গায় অদূর ভবিষ্যতে নতুন প্রযুক্তির ইটভাটা স্থাপিত হবে, যার কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের সম্ভাবনা হবে আরও বহুগুণ বেশি।
২০০৯ সালের ডিসেম্বরে কোপেনহেগেন জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে আগত অংশগ্রহণকারীদের যাতায়াত ও খাদ্যের জ্বালানি ব্যবহার বাবদ প্রায় ৪০ হাজার টন কার্বন নিঃসরণ হয়। অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের দায় ডেনমার্ক সরকার সমন্বয় করেছে বাংলাদেশের কয়েকটি ইট কোম্পানির কম কার্বন নিঃসরণের সাশ্রয় থেকে। কার্বন নিঃসরণের এ রকম দায় সমন্বয়ের চুক্তি অনুযায়ী, এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের কার্বন রিডাকশন সনদ দেওয়া হয়, যা বছরে ৫০ হাজার টন কার্বন নিঃসরণ কমাবে। এ ধরনের কার্বন ট্রেডিং ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ইউএনডিপির একটি দূরদর্শী লক্ষ্য, যাতে এই ইটভাটা প্রকল্প এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেটা এখন থেকেই। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিকে সম্ভাবনায় রূপান্তর করে এ দেশের জন্য সবুজায়িত উন্নয়নের একটি নতুন সন্ধিক্ষণ সৃষ্টির সময় এসেছে আজ।
স্টিফান প্রিজনার: কান্ট্রি ডিরেক্টর, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, বাংলাদেশ।

No comments

Powered by Blogger.