কানকুনের জলবায়ু সম্মেলন, বাংলাদেশের মমতাজ বেগম এবং আমার কিছু কথা by রুশনারা আলী

কটি ন্যায্য জলবায়ু তহবিল গঠনের বিষয়ে আশাবাদ তৈরি হয়েছে কানকুনের সদ্য সমাপ্ত জলবায়ু সম্মেলনের মাধ্যমে। এ তহবিল থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা হুমকির মুখে পড়া দরিদ্র দেশগুলোকে সহায়তা করা হবে। যদিও এ তহবিলের অর্থ সংগ্রহ এবং রাষ্ট্রগুলোর কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এখনো বিস্তর অগ্রগতি প্রয়োজন।
যুক্তরাজ্যের অনেকের জন্য ২০১০ সালটি ছিল অন্য স্বাভাবিক ১০টা বছরের মতোই। কিন্তু সাম্প্রতিক অনেক ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থতার প্রতিটি বছর এ সমস্যাকে বিশ্ববাসীর জন্য আরো ভয়াবহ করে তুলবে। পাকিস্তানের নজিরবিহীন বন্যা ও আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলের খাদ্যাভাব সুস্পষ্টভাবে সংকেত দিয়েছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে থাকা মানুষগুলোর জন্য সামনের দিনগুলো ক্রমেই কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠবে। গত মাসে জন্মভূমিতে সফরে গিয়ে আমি নিজে দেখেছি, বাংলাদেশের জেলে সম্প্রদায়ের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশে আমি অঙ্ফাম আয়োজিত একটি 'জলবায়ু আদালত'-এ যোগ দিয়েছি। সেখানে জলবায়ু বিজ্ঞানী, আইনজীবী এবং বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের সরকারি ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। এ আদালতে আমি মমতাজের মতো ভুক্তভোগী নারীদের দুঃখের কথা শুনেছি। ১৯৯৯ সালে হঠাৎ ঝড়ে পড়ে জেলে স্বামীর নৌকা ডোবার খবর পাওয়ার দিনটির কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে তাঁর। 'স্বামী যাওয়ার দিন আকাশের অবস্থা ভালো ছিল না। আমি তাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি।' এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলেছেন মমতাজ। তাঁর স্বামী আর ফেরেননি। ২০০৭ সালে সিডরের সময় তাঁর মায়েরও মৃত্যু হলে এখন মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনোমতে চার সন্তান নিয়ে জীবন ধারণ করছেন মমতাজ। আদালতে আমরা সন্তানহারা মা-বাবা, উত্তাল সমুদ্রে লাখ টাকা মূল্যের ট্রলার হারিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়া ব্যক্তিদের শোকের কথা শুনেছি, শুনেছি ট্রলারডুবির পর সাগরে ভেসে অন্য দেশের সীমানায় চলে যাওয়ার অপরাধে ভারতে জেল খাটা একজনের কথাও।
এটা ঠিক যে মাছ ধরার পেশাটি কখনোই ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। কিন্তু জলবায়ু বিজ্ঞানীদের তথ্য-প্রমাণ প্রত্যয়ন করে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে হঠাৎ করে সমুদ্র উত্তাল হচ্ছে, ঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে। এসব তথ্য-প্রমাণের কারণেই আদালত বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায়ের দুর্ভোগকে 'জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি পরিণতি' হিসেবে অভিহিত করেছেন। আদালত বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত নাগরিকদের পুনর্বাসন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আদালত বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভুক্তভোগীদের দুর্ভোগের পেছনে ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলোর দায় আছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বক্তব্য। কারণ এটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, কানকুনের মতো আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনাগুলোতে জলবায়ু তহবিলের বিষয়টি কেন এত জরুরি।
সহজ ভাষায়, জলবায়ু তহবিল হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সহায়তা করার জন্য উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সম্পদের স্থানান্তর। আমার মতে, এ তহবিল কেবল জলবায়ু পরিবর্তন রোধের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোতে কার্বন কমাতে সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের জেলে সম্প্রদায়ের মতো ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অভিযোজনের জন্যও সাহায্য করবে এটি। যাতে তারা নিজেদের সুরক্ষা ও নতুন করে জীবিকা উপার্জনের জন্য বিনিয়োগ করতে পারে। জলবায়ু তহবিলের অর্থ কোথা থেকে আসবে এবং এ অর্থ কিভাবে পরিচালিত হবে_একটি বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য এ বিষয়গুলোতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা জরুরি।
সরকার যুক্তরাজ্যের মোট জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেবে ব্যয় করার প্রতিশ্রুতি বহাল রাখার ঘোষণা দেওয়ায় দেশটির আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক ছায়ামন্ত্রী হিসেবে আমি খুশি। এ প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতেও আমি সচেষ্ট থাকব। তবে বাংলাদেশ থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি বলব, জলবায়ু তহবিল ও সাহায্য অবশ্যই দুটি ভিন্ন বিষয় এবং এ দুটো বিষয়কে পৃথক হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। জলবায়ু তহবিল উন্নয়নশীল দেশের প্রতি আমাদের কোনো উপহার বা দান নয়। বরং এটা ওই সব দরিদ্র মানুষের অধিকার, যারা নিজেরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দোষী না হয়েও এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ কারণেই এটা নিশ্চিত করা জরুরি যে যুক্তরাজ্য জলবায়ু তহবিলে যে অর্থ দেবে তা 'আন্তর্জাতিক সাহায্য' খাতের বাইরে থেকে দেবে; অর্থাৎ আগেই প্রতিশ্রুত ০.৭ শতাংশের বাইরে থেকে এ অর্থ দিতে হবে। গত লেবার সরকারের সময় আমরা নিশ্চিত করেছি, সাহায্য খাতে মোট বরাদ্দের ১০ ভাগের বেশি যেন জলবায়ু পরিবর্তন খাতে ব্যবহৃত না হয়। বর্তমান সরকারের আমলেও এ নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অভ্যন্তরীণ ব্যয় সংকোচনের এ সময়েও করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়েই বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব। কানকুন সম্মেলন শুরুর আগেই পার্লামেন্টে আন্তর্জাতিক সাহায্যবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর কাছে আমি এ প্রস্তাবের বিষয়টি উত্থাপন করেছি।
মমতাজের কাহিনী শুনে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতার আরো একটি বছর অতিবাহিত হওয়ায় ভবিষ্যতে যেসব নারী বিধবা হবেন, তাঁদের কাহিনী শোনার বিষয়টি আরো বেশি কষ্টকর হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়া উচিত যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশগুলোর। যেকোনো মূল্যে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঠেকাতে হবে এবং এ জন্য নিঃসরণ কমানো জরুরি। কিন্তু এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতিমধ্যেই ঝুঁকির মুখে পড়া মানুষের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন। এ কারণেই জলবায়ু খাতে নতুন ও বাড়তি অর্থ দেওয়ার বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে।
===============================
নাপাম বোমা যা পারেনি, চ্যালেঞ্জার ও আব্রাম্‌স্‌ ট্যাংক কি তা পারবে?  ঠাকুর ঘরে কে রে...!  ষড়যন্ত্র নয়, ক্ষুধা ও বঞ্চনাই আন্দোলনের ইন্ধন  বাহাত্তরের সংবিধানের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় বাধা কোথায়?  ড.ইউনূসের দুঃখবোধ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা  গীতাঞ্জলি ও চার্লস এন্ড্রুজ  গল্প- তেঁতুল  একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনা  গল্প- বট মানে গরুর ভুঁড়ি  গল্প- কিশলয়ের জন্মমৃত্যু  গল্প- মাকড়সা  দুর্নীতি প্রতিরোধে আশার আলো  জাগো যুববন্ধুরা, মুক্তির সংগ্রামে  ঢাকা নগর ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন প্রয়োজন  মারিও বার্গাস য়োসার নোবেল ভাষণ- পঠন ও কাহিনীর নান্দীপাঠ  লন্ডন পুলিশ জলকামানও নিল না  রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ ও যুদ্ধাপরাধী বিচারের দায়বদ্ধতা  পোশাক শিল্পে অস্থিরতার উৎস-সন্ধান সূত্র  বাতাসের শব্দ  গোলাপি গল্প  বজ্র অটুঁনি অথবাঃ  উদ্ভট উটের পিঠে আইভরি কোস্ট  আনল বয়ে কোন বারতা!  ফেলানীর মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গ- নিজ ভূমেই প্রশ্নবিদ্ধ ভারতের মানবিক চেহারা  বাজার চলে কার নিয়ন্ত্রণে  উঠতি বয়সের সংকট : অভিভাবকের দায়িত্ব  বিকল্প ভাবনা বিকল্প সংস্কৃতি  অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা  খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ রুশনারা আলী
এমপি, হাউস অব কমন্স, যুক্তরাজ্য


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.