রাজনৈতিক আলোচনা- সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি by মোজাফ্ফর আহমদ

বাংলাদেশে জরিপ নিয়ে বিতর্ক এমন এক উচ্চমার্গে পৌঁছেছে, যেটা থেকে প্রতীয়মান হতে পারে, জরিপের কোনো স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নির্ভর করে কিছু মানুষের বিচারিক বিশ্লেষণের ওপর। অথচ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো এ দেশেও জরিপ-সম্পর্কিত ফলিত তথ্যবিজ্ঞানই ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা গবেষণায় ব্যবহূত হয়ে আসছে আজ প্রায় পৌনে শতকের বছর ধরে। এমন অবস্থায় প্রথম আলোর উদ্যোগে একটি জরিপ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে প্রতি বিভাগের দুই-চার জেলা থেকে সংখ্যাবিজ্ঞানের জরিপ-প্রক্রিয়ায় দৈবচয়িত তিন হাজার ব্যক্তির বিভিন্ন বিষয়ে মতামত গ্রহণ করেছে।
এদের সবার বয়স ১৮ বছরের ওপরে। জনমিতি হিসাবে প্রশাসনিক অঞ্চল, জেন্ডার, শহর-গ্রামের উত্তরদাতাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জরিপের মৌল উদ্দেশ্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে মতামত সংগ্রহ, সরকারের বিপরীতে প্রধান বিরোধী দলের কার্যক্রমের পর্যালোচনা এবং সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতামত গ্রহণ। এ বিষয়ের মধ্যে ছিল দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, দুর্নীতি নিরোধ, আইনের শাসন, কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন, কৃষি খাতে সহায়তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, সংসদ পরিচালনা, বিরোধী দলের সঙ্গে আচরণ, শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন—এজাতীয় নানা বিষয়, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া এর মধ্যে অনেকগুলোই ছিল নির্বাচনী অঙ্গীকার বা প্রতিশ্রুতি। গণতন্ত্রে বিরোধী দলেরও ভূমিকা থাকে, সে ভূমিকা সম্পর্কেও জনমত জরিপে প্রশ্ন রাখা হয়েছে। অঙ্গসংগঠন নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে এবং অঙ্গসংগঠনের কর্মী-কর্তাদের আচরণ ও তার নিয়ন্ত্রণ নিয়েও মতামত জানার চেষ্টা করা হয়েছে।
এসব মতামতের ভিত্তিতে যে চুম্বক প্রশ্ন উঠে এসেছে তা হলো, এখন নির্বাচন হলে দুই নেত্রীকে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেবেন। শেখ হাসিনাকে বেছে নেবেন ৪৮ শতাংশ আর খালেদাকে নেবেন ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা। লক্ষণীয়, ৯ শতাংশ মতদাতা এঁদের কাউকেই যোগ্য মনে করেননি। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে সার্বিকভাবে সন্তুষ্টি ২০০৯ সালের তুলনায় সংখ্যাবিজ্ঞানের পরিমাপে লক্ষণীয়ভাবে কমেছে ৩৯ থেকে ৩২ শতাংশ। এর সঙ্গে মোটামুটি সন্তুষ্টি যুক্ত হলে পরিবর্তনটি সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে উল্লেখযোগ্য নয়। এ সন্তুষ্টি শহরাঞ্চলে গ্রামাঞ্চলের চেয়ে কমেছে বেশি। উল্লেখ্য, মহিলা মতদাতাদের মধ্যে সন্তুষ্টির মাত্রা পুরুষদের চেয়ে বেশি কমেছে। গ্রামাঞ্চলে ভোটারসংখ্যা বেশি, কিন্তু মহিলা ভোটারসংখ্যাও পুরুষের সমান। প্রতীয়মান হয়, নারীদের ক্ষমতায়নে সরকার তেমন সফল হতে পারেনি। নারী নির্যাতন বেড়েছে এবং কৃষির উন্নয়নে গ্রামীণ সমর্থন বেড়েছে। অঞ্চল ভিত্তিতে কেবল রাজশাহীতে সন্তুষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। এখানে জাপার সমর্থন বৃদ্ধির কতটুকু প্রভাব, তা কেবল অনুমিত হতে পারে।
এ সন্তুষ্টি মাত্রার প্রতিফলন ঘটেছে বর্তমানে ভোট হলে কোন দলকে ভোট দেবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে। এ ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থন ১০ শতাংশ কমে গেছে, বিএনপির সমর্থন ১৪ শতাংশ বেড়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থন রাজশাহী বিভাগ ছাড়া অন্যত্র বেশি কমেছে। পরিসংখ্যানগতভাবে অল্প হলেও জামায়াতের সমর্থন কমে যায়নি, এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন বেশ বেড়েছে। ‘না’ ভোটের পক্ষে সমর্থন এখনো আগের অবস্থানে আছে, এটি উপেক্ষণীয় মনে হয় না। গ্রামাঞ্চলে শহরের তুলনায়, মহিলাদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় এখন সমর্থনের মাত্রা আওয়ামী লীগের অনুকূলে নয়।
কেন এমন অবস্থা? প্রথমত, সরকারের কর্মপরিচালনায় আগের বছরের তুলনায় সন্তুষ্টি লক্ষণীয়ভাবে কমেছে। কারণ: ১. আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে অধিকাংশ উত্তরদাতা মনে করেছেন, ২. দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে বলে তাঁদের কাছে ধারণা হয়েছে, ৩. দুর্নীতি দমন কমিশন উল্লেখযোগ্যভাবে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে মতামত বেশ ভালো মনে হয়েছে, ৪. বিচারব্যবস্থায় উন্নতি লক্ষণীয় হচ্ছে না, ৫. কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের প্রচেষ্টার সফলতা অসফলতার মতোই, ৬. বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, ৭. অবকাঠামো খাতে সরকারের কার্যক্রম মোটেই সন্তোষজনক নয়, ৮. সরকারে দলীয়করণ বেড়েছে, ৯. বিরোধী দলের সঙ্গে আচরণ যথাযথ মনে হয়নি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক উত্তরদাতার, ১০. সংসদে বিরোধী দলকে আনার ব্যাপারে আন্তরিক মনে হয়নি অধিকাংশ মতদাতার এবং ১১. সংসদ যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে তাতে উত্তরদাতাদের অধিকাংশই সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
সরকারের সাফল্যের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপ। ৮৯ শতাংশ উত্তরদাতা গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে সার্থক মনে করেছেন। এজাতীয় উত্তর দেশের সর্বাঞ্চলে। শহরে ও গ্রামে, মহিলা-পুরুষের ঐকমত্য। দ্বিতীয়ত, কৃষি খাতে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপে কৃষকেরা লাভবান হয়েছেন মনে করেছেন তিন-চতুর্থাংশ উত্তরদাতা। সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বলে মতামত এসেছে রাজশাহী অঞ্চল থেকে। শহরাঞ্চলের মানুষ গ্রামের মানুষের মতোই এ ধারণা পোষণ করেন। পুরুষ-মহিলাতেও এ বিষয়ে মতভিন্নতা নেই। তৃতীয়ত, ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারে এখনো অর্ধেকের বেশি উত্তরদাতা ভালো বলে মনে করেছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পক্ষে সমর্থনও তথৈবচ।
সরকারের দুই বছরের কার্যক্রমের সময় বিরোধী দলের কার্যক্রমও বিবেচিত হয়েছে। সরকারের আন্তরিকতা দৃশ্যমান না হওয়ায় বিরোধী দলের সংসদ বর্জন অধিকতর সমর্থন পেলেও অধিকাংশ উত্তরদাতা এটাকে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। বিরোধী দল সংসদের বাইরেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পেরেছে বলে মনে করেন গত বছরের মতো সম শতাংশ উত্তরদাতা, বেশির ভাগ উত্তরদাতাই বিরোধী দলের ভূমিকাকে কার্যকর মনে করেননি। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বিরোধী দল কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। সেনানিবাসের বাড়ির দখল যেভাবে নেওয়া হয়েছে, তাতে ৬১ শতাংশ উত্তরদাতা সমর্থন করতে পারেননি। এ নিয়ে বিএনপির ডাকা হরতালও সমর্থন করেননি ৭৫ শতাংশ উত্তরদাতা। এসব অনর্জন সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন বেড়েছে এবং খালেদাকে ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা প্রধানমন্ত্রী দেখতে উৎসাহী। এখানে শেখ হাসিনার ৮ শতাংশ অগ্রগামিতা থাকলেও সরকার ও তাঁর অঙ্গসংগঠনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড ও আচরণে খালেদা জিয়ার প্রতি সমর্থন আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে।
সার্বিকভাবে দেশ যে পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তার প্রতি সমর্থন গত বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ কমেছে। অধিকাংশ উত্তরদাতা আমাদের দেশের রাজনীতিতে ভালো কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছেন না। অধিকতর উত্তরদাতা দেশে পুরোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফিরে আসবে বলে মনে করছেন। এসব থেকে হতাশার চিত্রই ফুটে উঠেছে।
এখানে লক্ষণীয়, উত্তরদাতাদের মধ্যে মাত্র ২৩ শতাংশ বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিতে ফিরে যাওয়ার সমর্থক। পুঁজিবাদের সম্প্রসারণ অবশ্যই এর একটি কারণ। ৪০ শতাংশ উত্তরদাতা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে রাজনীতি করতে দেওয়ার পক্ষপাতী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে আগের বছরের তুলনায় সরকারের পদক্ষেপকে যথাযথ ভাবতে পারছেন কমসংখ্যক উত্তরদাতা। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জনগণের সমর্থন কমছে।
জরিপের মূল যে মতামত তাতে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা অনেক পরিপক্ব বলে মনে হয়। বর্তমান সরকার ব্যর্থতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনলে জনসমর্থন তাদের বাড়বে এবং সেজন্য ভুল শুধরে অঙ্গসংগঠনের ও সংগঠনের কর্মীদের দ্রুত ও যথার্থ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। খালেদার প্রতি সমর্থন বাড়লেও কার্যকর বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি এখনো অনেক দূরে।
====================================
ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন  এরশাদের বিচার হওয়া উচিত  ছোটদের বড় সাফল্য  প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাঃ পাস ৯২%, প্রথম বিভাগ বেশি  বাংলাদেশের বন্ধুঃ জুলিয়ান ফ্রান্সিস  নিষ্ফল উদ্ধার অভিযানঃ দখলচক্রে ২৭ খাল  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ভ টিজিং : জরুরি ভিত্তিতে যা করণীয়  প্রতিশ্রুতির দিন  শোকের মাস, বিজয়ের মাস  চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর  দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য  নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  খিলক্ষেতে আগুনঃ কয়েলের গুদামে রাতে কাজ হতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে  ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন  স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে  আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  


দৈনিক প্রতথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোজাফ্ফর আহমদ


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.