রাজনৈতিক আলোচনা- 'জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা' by নূরুল কবীর

আমাদের জনগণের সঙ্গে আমাদেরই দেশের সেনাবাহিনীর দূরত্ব বাড়ছেই। ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে গণআন্দোলনের মুখে জেনারেল এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক সেনাশাসনের অবসানের পর

থেকে ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের পরোক্ষ ক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালে আমদের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী নিজেদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ, লেখাপড়া ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি মনোনিবেশ করেছিল বলে শোনা যায়। পাশাপাশি নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপদাপন্ন জনগণের পাশে তাদের দাঁড়াতে দেখা গেছে এই কালপর্বে।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের পর অসংখ্য সামরিক অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান, নির্বাচিত সরকারপ্রধানদের হত্যাযজ্ঞ, রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদলে নিজেদের ভেতর খুনোখুনি, ইত্যাদির মধ্যদিয়ে যে বদনাম কুড়িয়েছিল এ সশস্ত্র বাহিনী, ১৯৯০ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সেই বদনাম আবার বেশ খানিকটা ঘুচিয়েও এনেছিল তারা। জনগণের কাছাকাছি এসে জনগণের মিত্র হিসেবে একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে অপ্রত্যক্ষভাবে দেশের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের ভেতর দিয়ে, ক্ষমতা গ্রহণের পর বিশেষত বেদখলি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখলমুক্ত করার নামে হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের জীবিকা ধ্বংস করার মাধ্যমে, দুর্নীতি দমনের নামে দেশের বহু ব্যবসায় ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত করে এবং সে প্রক্রিয়ায় সেনা কর্মকর্তাদের একাংশ নিজেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে, আর সর্বোপরি, দেশের সাধারণ নাগরিকদের ওপর করায়ত্ত ক্ষমতার যথেচ্ছ অপপ্রয়োগের মাধ্যমে এ সেনাবাহিনী ফের নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে।
একটি দুদীর্ঘ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে সংঘটিত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উত্থিত আমাদের এ জাতিরাষ্ট্রের জন্য এ পরিস্থিতি খুবই দুঃখজনক। বলার অপেক্ষা রাখে না, একটি নবীন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতি ও তার গণতান্ত্রিক বিকাশের প্রশ্নে সেনাবাহিনী ও জনগণের ভেতরকার এ বিচ্ছিন্নতা রীতিমতো বিপজ্জনক। এ বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরির পেছনে দেশের শাসকশ্রেণীর স্থূল স্বার্থান্বেষী রাজনীতির অন্তর্গত অসুস্থতা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ, আর সুযোগসন্ধানী নানান বিদেশী রাষ্ট্র ও সংগঠনের নানান অপতৎপরতাই প্রধানত দায়ী।
দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ, জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের টাকায় পরিচালিত নানান প্রতিষ্ঠানে প্রায় বিনামূল্যে শিক্ষা গ্রহণ করে যারা সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন, তারাও এ দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারেন না। কেননা, প্রচলিত রাজনীতির নানান গণবিরোধী বৈশিষ্ট্য, সেনাবাহিনীর গণবিচ্ছিন্নতার প্রবণতা, বিদেশী স্বার্থান্বেষী শক্তিগুলোর লোভাতুর তৎপরতা – ইত্যাদি সম্পর্কে দেশের শিক্ষাবঞ্চিত জনসাধারণকে নিরন্তর অবগত রাখা এবং এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ জারি রাখার গণতান্ত্রিক অপরিহার্যতা সম্পর্কে তাদের সচেতন করা গণতন্ত্রপরায়ণ বুদ্ধিজীবিতার অনিবার্য দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিপুল অধিকাংশই এ দায়িত্ব পালন করেননি, করছেন না এখনো। বুদ্ধিজীবিতার এহেন অগণতান্ত্রিক নিষ্ক্রিয়তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলসমূহ, সশস্ত্র বাহিনীর নানান প্রতিষ্ঠান আর তাদের বিদেশী দোসররা, জনতার চোখের আড়ালে, এমন এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এ দেশে গড়ে তুলেছে – যেখানে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের নানান অঙ্গপ্রত্যঙ্গের, জনবিচ্ছিন্নতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে জনগণের সঙ্গে জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিচ্ছিন্নতা এমন এক মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তা যেকোনো সময়ে গোটা দেশের জন্যই একটা ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাতে পারে। রাজধানী ঢাকার অদূরে, রূপগঞ্জে, জনতা ও সেনা সদস্যদের ভেতরকার সাম্প্রতিক মুখোমুখি সংঘর্ষ সামগ্রিকভাবে জনসাধারণ ও সশস্ত্র বাহিনীর ভেতরকার ইতিপূর্বে বিদ্যমান দূরত্বকে আরো সম্প্রসারিত করবে বৈকি – যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শক্তিমান গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য ক্ষতিকর। এহেন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সেনাবাহিনী ও জনগণের মুখোমুখি পর্যায়ে দাঁড়িয়ে পড়ার পেছনে সক্রিয় উপাদানগুলো চিহ্নিত করা প্রয়োজন, প্রয়োজন ঘটনাটির মধ্যদিয়ে উত্থিত কয়েকটি ন্যায্য প্রশ্নের যথাযথ উত্তর অনুসন্ধান। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিবর্গকে চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি প্রদানও অত্যন্ত জরুরি।
নানান পত্র-পত্রিকায় মুদ্রিত খবর ও আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ কর্মকর্তার বিবৃতি অনুযায়ী, রূপগঞ্জে সেনাবাহিনীর কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জন্য একটি বিশাল আবাসন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রায় ৫০০ বিঘা জমির ওপর ২৭ হাজার আবাসিক প্লট সমন্বিত সুবিশাল এই ‘সেনা আবাসন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় জনসাধারণের কাছ থেকে জমি কেনা চলছিল। মনে রাখা প্রয়োজন, এই প্রকল্পটি কোনো সরকারি প্রকল্প নয় – ফলে সরকারের দিক থেকে ‘জনস্বার্থে জমি অধিগ্রহণ’ করার কোনো সুযোগ নেই এখানে। সেনাবাহিনীও, প্রতিষ্ঠান হিসেবে, এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত নয়। ফলে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের প্রশ্নে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর কোনো দায়দায়িত্ব নেই। সেনা কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত অর্থে ও সম্মিলিত উদ্যোগে প্রণীত হয়েছে এই প্রকল্প। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংগৃহীতব্য ৫০০ বিঘা জমি সেনা কর্মকর্তাদের কাছে বিক্রি করার ক্ষেত্রেও স্থানীয় জনসাধারণের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে না। কিন্তু প্রকল্পের জন্য সেনা কর্মকর্তাদের ৫০০ বিঘা জমি চাই-ই। এমতাবস্থায়, বাজার অর্থনীতির এই দেশে, জমির স্থানীয় মালিকরা যদি বুঝতে পারেন নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট ক্রেতার ৫০০ বিঘা জমির প্রয়োজন, কিনতে তাকে হবেই, তাহলে জমির দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ারই কথা। প্রথম পঞ্চাশ বিঘার তুলনায় দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা চতুর্থ পঞ্চাশ বিঘা বিক্রির ক্ষেত্রে এমনকি দ্বিগুণ, তিনগুণ, কিংবা চারগুণ দামও হাঁকতে পারেন জমির মালিক। এর মধ্যে কেউ কেউ জমি বিক্রি করতে অস্বীকারও করতে পারেন। করার অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু প্রকল্প প্রণয়নকারী কর্মকর্তাদের তাতে চলবে না। জমি তার চাই-ই। এবং তা ‘বাজার দরে’। অর্থাৎ একদিকে কৃষককে জমিও বিক্রি করতে হবে এবং অন্যদিকে সেই জমির ‘বাজার দর’ স্থির করবে ক্রেতা। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রথম পঞ্চাশ বিঘা জমি যে দরে ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে। পরবর্তী জমিও একই দরে ক্রয়ের আকাঙ্খা থাকবে তার। এটা জমির ব্যক্তিগত মালিকানা ও বাজার অর্থনীতির নিয়ম – উভয়েরই পরিপন্থী। সুতরাং ক্রেতা ও বিক্রেতার ভেতর হাঙ্গামা অনিবার্য। রূপগঞ্জে গত ২৩ অক্টোবর ঠিক তাই ঘটেছে।
স্থানীয় জনসাধারণের অভিযোগ, সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তাদের জমি বিক্রিতে বাধ্য করছে এবং ‘ন্যায্যমূল্য’ ছাড়াই তাদের জমি হস্তগত করতে বদ্ধপরিকর সেনাবাহিনী। এ অভিযোগ কতটা সত্য তা পরিপূর্ণ তদন্তে হয়তো বেরিয়ে আসবে। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণকে সেনাবাহিনী কর্তৃক চোখরাঙানির আলামত ইতোমধ্যেই সবার সামনে সমুপস্থিত, আর তা হলো – প্রকল্প এলাকায় সেনাবাহিনীর একাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন।
আগেই বলা হয়েছে, প্রকল্পটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর নয় – সেনা কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও অর্থায়নে প্রণীত হয়েছে এ আবাসন প্রকল্প। প্রশ্ন হলো, এহেন একটি ব্যক্তিগত প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী তার জনবল ও অস্ত্র সমন্বিত সেনাক্যাম্প করার অনুমোদন দিতে পারে কি না। আর জনগণের করের টাকায় পরিচালিত সেনাবাহিনীর সেই ক্যাম্পগুলো জনগণকে জমি বিক্রি করতে, কিংবা তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য দামে জমি বিক্রি করতে চাপ প্রয়োগ করতে পারে কি না, তাছাড়া, দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনা কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থে সেনাক্যাম্প ব্যবহারে সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছিলেন কি না। জনস্বার্থেই জনগণের এ উত্তরগুলো জানা প্রয়োজন। কিন্তু সরকারের দিক থেকে রূপগঞ্জের ঘটনা সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কোনো বক্তব্য-বিবৃতি আসেনি – যেটা খুবই রহস্যজনক।
জনতার সঙ্গে ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের সংঘর্ষের পরবর্তী ঘটনাক্রম আরো ন্যক্কারজনক। সেনাক্যাম্পের সঙ্গে জনতার বিবাদ জমিজমা বিক্রি করা-না করা নিয়ে, কিংবা বিক্রীত জমির ন্যায্য দাম পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে। বিবাদের একপর্যায়ে, জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে ক্যাম্পের সেনা সদস্যরা। গুলিবিদ্ধ হন জমির মালিক এলাকাবাসী। এ পর্যায়ে, সরকার ঘটনাস্থলে সশস্ত্র র‌্যাব-পুলিশ পাঠায়। প্রধানত সেনা কর্মকর্তা অধ্যুষিত র‌্যাব জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্মম লাঠিপেটার শিকার হন তারা। অসংখ্য মানুষ আহত হন। এরপর পুলিশি মামলার পালা। চার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা হয় সেনাক্যাম্পে হামলা চালাবার অভিযোগে – যে সেনাক্যাম্পের স্থাপনাই কি না আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে রয়েছে!
ইতোমধ্যে কয়েক দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রতিবাদী জনতার মধ্য থেকে গুলিবিদ্ধ একজন নিহত হয়েছেন। আশঙ্কাজনকভাবে আহত রয়েছেন কয়েকজন। আর পুরো এলাকাটি এখন পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে – গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। জনতার মধ্য থেকে যারা আহত-নিহত হয়েছেন, তাদের তরফে এখনো পর্যন্ত কোনো মামলা রুজু হয়নি। কেননা, থানা কোনো মামলা গ্রহণ করবে না – অন্তত জনতার সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের আগে তো নয়ই। এমতাবস্থায় ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া কঠিন বৈকি।
দেশের মানুষের নিরাপত্তাবিধান করা যেসব বাহিনীর দায়িত্ব, তাদের তরফ থেকেই এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন আপন আপন জমিজিরাত রক্ষায় সংগ্রামরত রূপগঞ্জের জনসাধারণ। দেশের সেনাবাহিনী তাদের সামনে নিরাপত্তা বিধানকারী মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়নি, উপস্থিত হয়েছে জমিলিপ্সু ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী হিসেবে।
এখানেই নিহিত রয়েছে বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রশ্নটি : দেশের সশস্ত্র বাহিনী দেশের মানুষের সামনে কী অবয়বে, কী ভাবমূর্তি নিয়ে, উপস্থিত রয়েছে? – জনতার সঙ্গে যে কোনো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে, হোটেল-রেস্তোরাঁয়, ঘরের বৈঠকখানায় যে আলোচনা সংঘটিত হয় তার সাধারণ রূপগুলো কারোর আর অজানা থাকার কথা নয়। সশস্ত্র বাহিনীর নানান গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। বিশুদ্ধ পেশাগত দায়িত্বে মনোনিবেশ করলে তারা সহজেই জানতে পারবেন এসব আলাপ-আলোচনার বিষয়বস্ত্ত, রূপ ও প্রকৃতি। মানুষ বলাবলি করেন, দেশের সেনাবাহিনী একদা নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানদের হত্যা করেছে, নিজেদের ভেতর খুনোখুনি করেছে, থেকে থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা জবরদখল করেছে, ক্ষমতায় এসে মানুষকে অত্যাচার করেছে।
ইদানীং আরো দুই ধরনের আলোচনা যোগ হয়েছে। মানুষ দুঃখ ও ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমাদের সেনাবাহিনী পৃথিবীর দেশে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখে, কিন্তু নিজ দেশে তারা অশান্তির অগ্রদূত দ্বিতীয়ত আমাদের সীমান্ত অঞ্চলে পরদেশী সৈন্যরা প্রায় বিনা বাধায় বছরের পর বছর আমাদের নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, আর আমাদের সেনাবাহিনী সামরিক-আধাসামরিক শাসনের ছত্রছায়ায় আমাদেরই নাগরিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিষ্ঠানটির নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তাদের এসব অবগত থাকা প্রয়োজন।
কোনো স্বাধীন দেশের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে জনসাধারণের ভেতর এই ভাবমূর্তি জারি থাকা, ফের বলছি, সেনাবাহিনীর জন্য শুধু অপমানজনকই নয় – সে দেশের স্থিতি ও স্থায়িত্বের জন্য বিপজ্জনক। সেনাবাহিনীর এহেন ভাবমূর্তি গড়ে ওঠার পেছনে, আগেই বলেছি, শুধু সেনাবাহিনীই, কিংবা গোটা সেনাবাহিনী দায়ী নয়। শাসকশ্রেণীর দেশপ্রেমবিবর্জিত রাজনীতি, একটি দুর্বল বাংলাদেশ এর কাছ থেকে সুবিধাপ্রত্যাশী নানান বিদেশী রাষ্ট্র এবং দেশীয় বুদ্ধিজীবীদের ভীরু কিংবা সুবিধাবাদী অংশও সেনাবাহিনীর এই নেতিবাচক ভাবমূর্তির জন্য দায়ী। সেনাবাহিনীকে বিদ্যমান ভাবমূর্তি থেকে বের করে আনা বাংলাদেশের ইতিবাচক বিকাশের জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে, সেনাবাহিনীকেই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। থেকে থেকে জনসাধারণের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার নিজের যেমন, তেমনি দেশের সামগ্রিক স্বার্থের পরিপন্থী – সেনাবাহিনীর এ কথাটি উপলব্ধি করা আজ খুবই জরুরি। নিজেদের জমি রক্ষার ন্যায্য সংগ্রামকে কিংবা ন্যায্যমূল্যে বিক্রয়প্রত্যাশী ছোট ছোট জমির মালিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট লড়াইকে ‘কতিপয় কায়েমি স্বার্থবাদী’ লোকের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করার ভেতর দিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে রচিত জনগণের দূরত্ব বরং বৃদ্ধিই পাবে। অথচ সশস্ত্র বাহিনীর জনসংযোগ দফতর থেকে রচিত বিবৃতিতে এভাবেই দোষারোপ করা হয়েছে জমির মালিক জনসাধারণকে।
আগেই বলা হয়েছে, সুদীর্ঘ একটি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধে অসংখ্য মানুষের অপরিমেয় আত্মত্যাগের ভেতর দিয়ে একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থান ঘটেছিল। জাতিরাষ্ট্রসমূহের বর্তমান আন্তর্জাতিক সমাজে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীন স্থিতি ও সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকাশের জন্য অপরিহার্য উপাদানগুলোর অন্যতম হলো, জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, জনগণের সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও তার উন্নত খাদ্য-শিক্ষা-স্বাস্থ্য প্রভৃতির নিশ্চয়তাবিধান, এবং, অবশ্যই, জনস্বার্থের প্রতি নিরঙ্কুশ অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি আধুনিক, দক্ষ ও শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী। এসব উপাদানের যে কোনো একটি ছাড়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উন্নততর বিকাশ তো দূরের কথা, তার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে। ফলে, জনসাধারণের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা নয়, জনসাধারণের নিরাপত্তাবিধানের দিকে নজর দেওয়াই জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কর্তব্য।
উল্লেখ্য, জাতিরাষ্ট্র হিসেবে উত্থিত বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো এর যথার্থ বহুজাতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তর নিশ্চিত করা। অর্থাৎ, বাঙালি ছাড়াও অবাঙালি জাতি-গোষ্ঠীসমূহকে, তারা সংখ্যায় কিংবা অবয়বে যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, সমান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা শক্তিমান গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্যেই তা জরুরি। আর সে ক্ষেত্রেও আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর ইতিবাচক গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত জরুরি।
================================
রাজনৈতিক আলোচনা- 'নির্মানবীয় রাজনীতি ও জনসমাজের বিপজ্জনক নীরবতা by নূরুল কবীর  আলোচনা- 'সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী অভিযান by নূরুল কবীর  খাদ্য আলোচনা- 'খাদ্য উৎপাদনের বাধা দূর করাই ক্ষুধার বিরোদ্ধে প্রধান সংগ্রাম' by ফরিদা আক্তার  রাজনৈতিক আলোচনা- ' কোন পথে ক্ষমতা! হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই   আলোচনা- 'শিল্পনীতি-২০১০:সামর্থ্যের অপব্যবহারে পঙ্গ  আলোচনা- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ  আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব  ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ  নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি'  গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা  আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর  গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান  আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী


সাপ্তাহিক বুধবার এর সৌজন্যে
লেখকঃ নূরুল কবীর

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.