শিল্পি- 'আমি যে গান গেয়েছিলেম...কলিম শরাফী' by জাহীদ রেজা নূর

তরুণ বয়সেই স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার ভয়রা ডিহি গ্রামে জন্ম নেওয়া মানুষটি। অনুভব করেছেন বঞ্চিত মানুষের হতাশ্বাস;

সে হতাশা ঝেড়ে ফেলতে নিয়েছেন গানের আশ্রয়। দুর্ভিক্ষের সময় দল বেঁধে গেয়েছেন ‘নবজীবনের গান’। জেলে বসেই গলা ছেড়ে গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত। সেই থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিরদিনের আবাসস্থল। তাঁর ভরাট কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত কিংবা গণসংগীত শোনা যাবে না আর। গত ২ নভেম্বর সকাল থেকে তিনি নেই। রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়াত এই পুরোধা ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এবারের মূল রচনা
যেদিন তিনি চোখ বন্ধ করলেন শেষবারের মতো, সেদিন অধ্যাপিকা নওশাবা খাতুন তাঁর পাশেই ছিলেন। সকালের দিকে একবার চোখ খুললেন কলিম শরাফী। তাকালেন এদিক-ওদিক। নওশাবা বললেন, ‘কষ্ট হচ্ছে?’
মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন কষ্ট হচ্ছে।
নওশাবা চিকিৎসককে ডাকতে পাঠালেন। গলায় খুব কফ।
চিকিৎসক আসার আগেই কলিম শরাফী ঘুমিয়ে পড়েছেন। শেষ ঘুম। নাড়ি ধরে বোঝা গেল আর চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই।
নওশাবা খাতুন বুঝতে পারছেন না কী ঘটে গেল। চশমাটা পড়ে আছে, আছে ঘড়িটাও। মানুষটা কোথায় গেল! একটু পরপরই ভুলে যাচ্ছেন, এ বাড়িতে কেউ মারা গেছে। বুকের ভেতর কেমন অস্থির লাগছে। মাঝেমধ্যেই দাম্পত্যজীবনের সুখস্মৃতিগুলো ভেসে উঠছে চলচ্চিত্রের কোনো দৃশ্যের মতো, অচিরেই তা হারিয়ে যাচ্ছে। বুকের অস্থিরতা কোনোভাবেই কাটছে না। চোখে পানি আসছে না। কাছের মানুষের মৃত্যু হলে মানুষ না কাঁদে? তাহলে নওশাবার চোখে পানি নেই কেন? যাঁরা প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাঁদের কারও কারও কাছে প্রশ্ন করছেন নওশাবা, ‘তোমাদের কেমন লেগেছিল? তোমরা কেঁদেছিলে? আমার তো এক ফোঁটা পানি এল না চোখে!’
পাশে বসা এক মহিলা জড়িয়ে ধরলেন নওশাবাকে। বললেন, ‘আসবে, আসবে, কান্না আসবে। বুকের অস্থিরতা কেটে যাবে।’—বলতে বলতেই কাঁদতে থাকেন তিনি। নওশাবা খাতুন তাঁর দিকে নিষ্পলক তাকান। বিড়বিড় করে বলেন, ‘ওঁ চলে যাওয়ার পর আমার একটা কথাই মনে হলো, আমি মুক্ত হয়ে গেলাম। আমাকে এখন কারও দরকার নেই আর। রোজ ভয় পেতাম। কখন কী হয়ে যায়, কে জানে! ঢাকার রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়াও তো কষ্টের। তাই ঘরেই এনে রেখেছিলাম অক্সিজেন সিলিন্ডার। এখন আমার আর ভয় নেই। কী নিয়ে ভয় পাব?’
কথা হচ্ছিল ৩ নভেম্বর, তাঁদের বাড়িতে বসে। তাঁকে সান্ত্বনা দিতে আসা লোকজনের আপ্যায়নেরও চেষ্টা করছেন বর্ষীয়সী নওশাবা খাতুন, ‘খান, মিষ্টিটা খেয়ে নিন।’
আমরা বসার ঘর থেকে খাবার ঘর পেরিয়ে পৌঁছে যাই কলিম শরাফীর ঘরে। প্রচুর আলো-বাতাস খেলা করে ঘরটিতে। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের একটি ছবি, ছবি আছে আরও দুয়েকটি। একটা টেলিভিশন। দুটো ঘড়ি। তসবি। কোরআন শরিফ। বিছানা। ৩৮ ঘণ্টা আগে এই বিছানায় শুয়ে ছিলেন কলিম শরাফী। অতঃপর প্রস্থান। চিরদিনের মতো ছেড়ে গেলেন এই ঘর, এই বাড়ি, এই দেশ, এই পৃথিবী।
২.
চোখ চলে যায় বইয়ের তাকে। অসংখ্য বইয়ের মধ্যে বেশ কটি বই নজর কাড়ে। গীতবিতান, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, দরবার-ই জহুর, শম্ভু মিত্রেরঅয়দিপাউস ও পুতুলখেলা, নাট্যভাষ, বিষ্ণুদের নাম রেখেছি কোমল গান্ধার বইগুলো তাঁর বৈচিত্র্যময় পড়াশোনার উদাহরণ হতে পারে। চট করে মনে পড়ে, শম্ভু মিত্রের সঙ্গে তাঁর হার্দিক সম্পর্কের কথাও। বাড়ির মেজ ছেলে বলে শম্ভু মিত্রকে ‘মেজদা’ বলেই ডাকত অনেকে, কলিম শরাফীও। শম্ভু মিত্রের কাছ থেকে শুধু নাটকের নয়, জীবনেরও পাঠ নিয়েছেন কলিম শরাফী। নিজেকে ভালোবাসার শিক্ষা দিতেন শম্ভু, শিক্ষা দিতেন লড়াই করে বড় হওয়ার। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নবান্ন নাটকটির কথা অনেকেরই মনে পড়ে যাবে। সে নাটকে অভিনয় করলেন কলিম। সাহিত্যিক গোপাল হালদার নবান্নতে একজন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের চরিত্রে অভিনয় করছিলেন, একদিন তিনি হাওয়া! রোগাপটকা কলিমকেই নামতে হলো সে ভূমিকায়। শম্ভু মিত্রের হাতে গড়া ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও ছিলেন কলিম শরাফী।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ গঠিত হয়েছিল ১৯৪১-৪২-এর দিকে। দেশের মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তোলার জন্য এ সময় দেশাত্মবোধক গান, সম্রাজ্যবাদবিরোধী গান, দুর্ভিক্ষের গান, পুরোনো দিনের গান ও নাটক মঞ্চস্থ করা হতো। এই দলেই যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এখানেই পরিচয় হয় সুবিনয় রায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে। সে সময় ছায়ানাট্যের ‘শহীদের ডাক’ নিয়ে তারা সারা বাংলা আর আসাম ঘুরে বেড়ান। এই দলের অন্যতম কণ্ঠশিল্পী ছিলেন কলিম শরাফী। তাঁর গানের প্রশংসা করে স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি রিভিউ ছাপা হয়েছিল। তড়িৎ চৌধুরী একদিন কলিমকে নিয়ে হাজির হলেন তাঁর গুরু শুভ গুহঠাকুরতার কাছে। শুরু হলো কলিমের নিয়মিত রবীন্দ্রচর্চা।
১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষের সময় দলবেঁধে গেয়েছেন ‘ফ্যান দাও, ফ্যান দাও, দুটি ভাত দাও’, ‘সোনার বাংলা শ্মশান হলো, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ গানগুলো।
৩.
একটু পেছন ফিরে দেখি। ১৯২৪ সালে জন্ম কলিম শরাফীর। তিনি যখন বড় হতে থাকেন, তখন অবধারিতভাবেই ‘ইংরেজ হটাও’ আন্দোলনের রেশ এসে তাঁর শরীরে ঢেউ তোলে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে জন্ম ও শৈশব কাটালেন তিনি। এরপর বাবার কর্মস্থল কলকাতায় চলে এলেন। তখন অবিভক্ত ভারত মুক্তির মন্দির সোপানতলে পেতে দিচ্ছে অকুতোভয় সাহসী সন্তানদের। সে এক অন্য রকম সময়। সেই অসাধারণ সময়ে জন্মেছিলেন বলেই কলিম শরাফী ঠোঁটে তুলে নিতে পেরেছিলেন গান। সে সময় মুসলিম পরিবারের কেউ গান করছে, এটা মেনে নেওয়া ছিল কঠিন। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলন তখন দেশব্যাপী। এরই মধ্যে নেতাজি সুভাষ বোসের আহ্বান, ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।’ স্বাধীনতা! শব্দটি শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে যায় কলিমের। কলিম কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলের চাঁদা দেওয়া সদস্য ছিলেন না। কিন্তু সেই সময় প্রতিবাদ সমাবেশে কিংবা মিছিলে যেতে হলে রাজনৈতিক পরিচয়টা মুখ্য ছিল না। সবাই যেতেন প্রাণের আবেগে। পরাধীন দেশে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে মিশিয়ে দিত আন্দোলনের স্রোতে। কংগ্রেসের রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা এসেছিল, কিন্তু কলিম শরাফী ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন, সাম্যবাদের পথে পা ফেলাই তাঁর আরাধ্য। এরপর পথে পথে ছুটে বেড়ানো। কামার-কুমোর-চাষি-জেলে-শ্রমিকদের কাছে পৌঁছে যাওয়া।
কোনো এক সাক্ষাৎকারে কলিম শরাফী একবার বলেছিলেন, স্বদেশি আন্দোলনের নেতা মিহিরদাকে খুব পছন্দ করতেন তিনি। কিন্তু মিহিরদার অপছন্দ ছিল সাম্যবাদ। এ নিয়ে হতো তর্ক। সেই তর্কের পথ ধরেই নিজের মতাদর্শ ঠিক করে নিয়েছিলেন কলিম। আরেকজন ছিলেন রউফ ভাই। তাঁর কাছেই মেহনতি জনতার পক্ষে রাজনীতির হাতেখড়ি। নিজেকে আগাপাশতলা অসাম্প্রদায়িক করে তোলার পেছনেও হাত ছিল এই রউফ ভাইয়ের।
৪.
‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন গান্ধীজি ১৯৪২ সালে। সে আন্দোলনে কেঁপে উঠল ব্রিটিশরাজের প্রাণ ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে কলিম শরাফী তখন পুরোদস্তুর আন্দোলনের মানুষ। একদিন ভোররাতে ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের অধীনে কলিমকে গ্রেপ্তার করতে এল পুলিশ। বাড়িতে জমে গেল মানুষের ভিড়। চারদিকে স্লোগান। সাধারণ মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ কলিমকে সাহসী করে তোলে। তাই সিউড়ি জেলের দিনগুলোকে কঠিন বলে মনে হয় না তাঁর কাছে। জেলে দেখা হয় অনেক নামী নেতাদের সঙ্গে। চলতে থাকে গান। এত দিন গণসংগীতের সঙ্গেই ছিল বোঝাপড়া, এবার রবীন্দ্রনাথ এসে ছড়িয়ে দেন তাঁর ছায়া। সেই ছাঁয়া আমৃত্য লালন করেছে কলিম শরাফীকে। ‘রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসিও নন, আবার কমিউনিস্টও নন, তবুও আমার মনে হতো এই যে আমার ভেতরটা এমন উদ্বেল হয়ে উঠছে, অপমানে-হতমানে কেঁদে উঠতে চাইছে, মানুষের কাছে পৌঁছাতে চাইছে, আর কী অদ্ভুতভাবে আমি গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠছি বা গলা ছেড়ে গাইছি তাঁর গান—শক্তি পাচ্ছি, সাহস পাচ্ছি, শান্তিও পাচ্ছি। আমি যেন তাঁর বাণীর, তাঁর সুরের অসীম ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে প্রতিদিন নতুন করে বেঁচে উঠছি, বাঁচতে শিখছি।’—বলেছিলেন কলিম শরাফী।
জেলজীবন শেষে তিনি দার্জিলিংয়ের কালিম্পংয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ পান কমরেড মুজাফ্ফর আহমদের। স্নেহ পেয়েছেন তাঁর। কলিম শরাফী চিকিৎসাবিজ্ঞানে ভর্তি হওয়ার পর অর্থের অভাবে ছেড়ে দিতে হওয়ায় কষ্ট পেয়েছিলেন মুজাফ্ফর আহমদ। সে সময় মুজাফ্ফর আহমদের কাছ থেকে পাওয়া ভালোবাসা ও জীবনের শিক্ষার কথা ভোলেননি কখনো।
৫.
১৯৪৬ সালেই তাঁর গণগংগীতের রেকর্ড বের হয়েছিল এইচএমভি থেকে। তবে সে বছরের দাঙ্গার ভয়াবহতার কথাও ভাবিয়েছে তাঁকে। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় তখন লাশ আর লাশ। যাঁদের একসময় ছিল সংসার, পরিচয়, তাঁরাই রক্তাক্ত দেহে পড়ে থাকলেন লাশ হয়ে। কলিম শরাফী তখন বিপর্যস্ত অবস্থায়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এ সময় সোহ্রাওয়ার্দীর ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’র বক্তৃতা শুনবেন গড়ের মাঠে। তিনি ছিলেন রামরাজাতলায়। কিন্তু বেঁধে গেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। পরদিন ভোরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ভেবেছিলেন যাবেন সুচিত্রা মিত্রের বাড়িতে। কিন্তু সে পথে আতঙ্ক। তাই ঘুরে চলে এলেন দেবব্রত বিশ্বাসের বাড়িতে। সেখানে তখন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্রও ছিলেন। স্মৃতিচারণার এক জায়গায় তিনি বলেছেন, জর্জদা (দেবব্রত বিশ্বাস) আমাকে দেখেই চিৎকার করে উঠলেন, ‘শালা বাইচ্যা আছে!’ দেবব্রতের বাড়ির একটি খাটের নিচে সাত দিনের জন্য ঠাঁই হলো কলিমের। এরপর দেবব্রত মুসলিম এলাকা পার্ক সার্কাস পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন কলিমকে।
পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলে একটি চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয় কলকাতা কালচারাল সেন্টারে। তাতে অংশ নেন জয়নুল আবেদিন, শফিউদ্দীন, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, আমিনা আহমেদ এবং রোকেয়া কবীর। এরপর আরও একটি প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয় জয়নুলের ১৯৪৩ সালে আঁকা মন্বন্তরের ছবি। সে সময় কলিমদের উদ্দেশ্য ছিল দাঙ্গার অবসান ও হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি গড়ে তোলা। হিন্দু এলাকায় যখন অনুষ্ঠান হতো, তখন কলিমের নাম হয়ে যেত ‘কল্যাণ মিত্র।’
৬.
আবদুল আহাদ ও সিকান্দার আবু জাফরের আহ্বানে কলিম শরাফী ঢাকায় এলেন ১৯৫০ সালে। তত দিনে ভারত ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে। প্রশাসনে থাকা লোকেরা জানত, কলিম শরাফী প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। তাই শুরু থেকেই তাঁর দিকে ছিল ওদের নজর। এক অনুষ্ঠানে সুকান্তের ‘অবাক পৃথিবী’ গানটি করার পর পিছু নিল গোয়েন্দারা। প্রায় প্রতিদিন বাড়ি এসে জেরা শুরু হলো। এ অবস্থা থেকে মুক্ত হতে কিছুদিনের জন্য করতে হলো আত্মগোপন। কিন্তু তাতে থেমে থাকল না গান। সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, আফসারী খানম, রাখী চক্রবর্তীদের নিয়ে এইচএমভি থেকে বের করলেন একটি রেকর্ড। শেখ মুজিব তখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। শেখ মুজিবকে দিয়েই রেকর্ডটি উদ্বোধন করালেন কলিম। এটি তখন পরিণত হয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদে।
১৯৬৪ সালে টেলিভিশনের ঢাকা সেন্টার চালু হওয়ার সময় কলিম শরাফীকে করা হলো অনুষ্ঠান পরিচালক। সে সময় অনেকগুলো ভালো অনুষ্ঠান উপহার দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি বেশি বেশি রবীন্দ্রসংগীত প্রচার করছেন। ছেড়ে দিলেন চাকরি।
৭.
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে খান আতাউর রহমানের সূর্যস্নান ছবিতে কলিম শরাফীর ভরাট গলায় গাওয়া ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়ারে সে দুঃখে চোখের পানি’ গানটির কথা। এরপর তিনি নিজেই নির্মাণ করেন সোনার কাজল নামে একটি ছবি। ছবি করার কোনো ইচ্ছে ছিল না তাঁর। কাহিনিটি মাথায় এলে তিনি কথা বলেন শম্ভু মিত্রের সঙ্গে। শম্ভু মিত্র বলেন, এটা নিয়ে সিনেমা করতে পারো। জহির রায়হানকে ছবি বানাতে অনুরোধ করলেন তিনি। জহির বললেন, ‘কলিম ভাই, আপনিই করেন, আমি আপনার সহকারী হয়ে কাজ করব।’ ক্যামেরায় ছিলেন জামান। ছবির সংগীত পরিচালনা করেন কলিম শরাফী নিজেই। অভিনেতা খলিলের প্রথম ছবি এটি। সুমিতা দেবী ছিলেন নায়িকা। একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুলতানা জামান।
রমেশ শীলকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন একটি তথ্যচিত্র।
১৯৬৫ সালে রবীন্দ্রনাথের গান সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের সময় প্রতিবাদ করেছেন। সে সময় ছায়ানটের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। এই সময়টিতে রবীন্দ্রনাথের গান আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। স্বাধিকার আন্দোলনে সংস্কৃতিসেবীদের মধ্যে সব সময় খুঁজে পাওয়া গেছে তাঁকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন জ্বালিয়ে দেওয়ার পর তাঁর বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা। ভেবেছিলেন কামরুল হাসানের সঙ্গে দেশ ছাড়বেন। কিন্তু কামরুল আগেই চলে যাওয়ায় ঢাকাতেই থাকতে হয়। এ সময় এইচএমভি কোম্পানি থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে পাঠানো হয় লন্ডনে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের কাজও করেন। এরপর আমেরিকার ওয়াশিংটনে গিয়েও জনমত তৈরির কাজটি করে গেছেন।
৮.
কত কথাই হলো, কিন্তু হলো না তাঁর গানের কথা। তাঁর ভরাট কণ্ঠের গান শ্রোতাকে নিয়ে যেত এমন এক রাজ্যে, যেখানে সুরের ভেলায় ভেসে চলে জীবন। ‘পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক আঁখির কোণে অলস অন্যমনে,’ ‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে’, ‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা করো প্রভু’, ‘কেন চেয়ে আছ, গো মা’, ‘আমার মল্লিকাবনে’, ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার’। এ রকম কত গান তিনি গেয়েছেন, পৌঁছে গেছেন স্রোতার মনের গোড়ায়।
অন্য ধরনের গানও করেছেন তিনি। ‘আজ হলো রবিবার, কাল কোনো কাজ নেই, রাত জেগে তোমাকেই ভাবছি’—গানটিকে কি কলিম শরাফীর গাওয়া বলে মনে হয়? তিনিই গেয়েছেন এটি। সংগীতভবনের অধ্যক্ষ ছিলেন, ছিলেন রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থার সভাপতি। গানের সুধায় তিনি জারিত করে নিয়েছেন নিজেকে, কিন্তু আন্দোলনের পথেও ছিল তাঁর দৃঢ় পদক্ষেপ।
৯.
অধ্যাপিকা নওশাবা খাতুন বলছিলেন কলিম শরাফীর শেষদিনগুলোর কথা। হূদযন্ত্র আর কিডনির সমস্যা ছিল, শ্বাসকষ্ট ভোগাত। অনেকবার হাসপাতাল যাওয়া-আসা করার পর একদিন এক চিকিৎসক বললেন, তাঁর জন্য এখন একটিই ওষুধ আছে, টিএলসি। উৎসাহ নিয়ে নওশাবা বলেছিলেন, ‘কোথায় পাব?’
‘এটা তো কিনতে পারবেন না।’ বললেন চিকিৎসক।
‘তাহলে?’
‘এটা হলো টেন্ডার লাভিং কেয়ার।’
নওশাবা সেই ভালোবাসা দিয়ে গেছেন কলিম শরাফীকে। শেষ সময়টিতে কলিম শরাফী ভালোবাসাহীন ছিলেন না।
বিদায় কলিম শরাফী। গানের মাধ্যমে বারবার আপনি আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমরা মনে রাখব আপনার গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ‘এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায়/ আমি যে গান গেয়েছিলেম...’।
========================
আলোচনা- 'হাওয়ার হয়রানি নামে ঢেকে যায় যৌন সন্ত্রাস'  সাহিত্যালোচনা- 'মারিও ভার্গাস ইয়োসা'র সাহিত্যে নোবেলের রাজনৈতিক মোড়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'জনগণ ও সেনাবাহিনীর বিপজ্জনক বিচ্ছিন্নতা by নূরুল কবীর  রাজনৈতিক আলোচনা- 'নির্মানবীয় রাজনীতি ও জনসমাজের বিপজ্জনক নীরবতা by নূরুল কবীর  আলোচনা- 'সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ত্রিমুখী অভিযান by নূরুল কবীর  খাদ্য আলোচনা- 'খাদ্য উৎপাদনের বাধা দূর করাই ক্ষুধার বিরোদ্ধে প্রধান সংগ্রাম' by ফরিদা আক্তার  রাজনৈতিক আলোচনা- ' কোন পথে ক্ষমতা! হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই   আলোচনা- 'শিল্পনীতি-২০১০:সামর্থ্যের অপব্যবহারে পঙ্গ  আলোচনা- যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ রক্ষাকারী ইসরাইল লবি ইভটিজং আলোচনা- নারী উৎপীড়ক সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া  রাজনৈতিক আলোচনা- 'ছাত্ররাজনীতি তার হারানো গৌরব ফিরে পাক by ফরহাদ মাহমুদ  আলোচনা- 'দেশ কাঁপানো নূরজাহান' by আবদুল হামিদ মাহবুব  ইতিহাস- 'বাংলা ভাষার স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ' by রফিকুল ইসলাম  গল্পালোচনা- 'অরণ্যে যুদ্ধ' by অরুন্ধতী রায়  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ  নিবন্ধ- 'আইলা, কৃষি এবং কোপেনহেগেন প্রাপ্তি'  গল্পিতিহাস- 'এত যে সফলতা, তবুও বিফলতা' by সনৎ কুমার সাহা  আলোচনা- 'মুনাফার মালা গলায় ঝুলিয়ে পুঁজিবাদীরা মানবজাতি ধবংসের ব্যবস্থা করছে by বদরুদ্দীন উমর  গল্পালোচনা- 'স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি' by লে. জেনারেল মাহবুবুর রহমান  আলোচনা- 'টেলিভিশন কি পত্রিকার প্রতিদ্বন্দ্বী



প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ জাহীদ রেজা নূর


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.