গল্প- 'জয়মন্টপের জায়াজননী' by জামাল উদ্দীন

চারদিকে সন্ত্রাস আর বোমাবাজির খবরে উদ্বেগ থাকলেও আপাতত তা চাপা পড়ে গেছে জয়মন্টপের চায়ের দোকানটিতে। হাটবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো এই চায়ের দোকানেই গ্রামের লোকদের একটু আধটু বিনোদন মেলে;

জমে ওঠে আড্ডা, দেখা-সাক্ষাৎ ঘটে, হয় পারস্পরিক কুশল বিনিময়। হাট বসে শুক্রবারে । বাকি ছয়টা দিন শূন্য পড়ে থাকে পুরো মাঠ। তিন তিনটি বটবৃক্ষ ছায়া দিচ্ছে এই মাঠে। মাঠের দুদিকে দুটি এবং ঠিক মধ্যিখানে একটি গাছ থাকলেও পাতার ফাঁকফোঁকর গলিয়ে আসা সূর্যালোকের ঝলকানি চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
তিনটি বটের গোড়া বৃত্তের মতো বাঁধানো।
হাটের দিন শান বাঁধানো বটতলাগুলো হাটুরেদের পসরা সাজিয়ে বসার কাজে লাগলেও বাকি সময় এগুলো থাকে বারোয়ারি আড্ডারুদের দখলে। কোনোটার তলায় বসে তাসের আসর, কোনোটার তলায় শুরু হয় গানের জলসা, কোনোটায় চলে শুধুই গুলতানি। এটাই এখানকার নিত্যদিনকার চালচিত্র। অবশ্য এমন খোলা চোখে যা দেখা যায়, তার বাইরেও রয়ে যায় অনেক ঘটনা, যেগুলোর নীরব স্বাক্ষী হয়ে আছে বটত্রয়ী। বটগাছগুলোর মতো কালের আরেক সাক্ষ্যদানকারী হলো বয়োবৃদ্ধ শাহবাজ মিয়া। পার্থক্য হলো বটগাছগুলোর তুলনায় বয়সে নবীন সে, বটগাছগুলো তার তুলনায় অনেক বেশি দেখতে পেলেও বলতে পারে না কিছুই।
অবশ্য শাহবাজ মিয়াও আজকাল আর আগের মত বলতে পারে না। ইতিমধ্যে তার একটা চোখে ছানি পড়েছে। দৃষ্টির মতো স্মৃতিও ধুসর হয়ে আসছে তার। চোখ দুটির একটায় যে এখনো খানিক আলো আছে সে জন্য দিনে হাজারবার মালিকের কাছে শোকর করে সে। দিন-দুনিয়ার মালিকের কাছে শাহবাজ মিয়ার এখন একটাই আরজি, দুইচোখ অন্ধ হওয়ার আগেই যেন তাকে পৃথিবী থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
জীবনে তো আর কম দেখেনি শাহবাজ মিয়া, এখন অনেক কিছু আর দেখতে ইচ্ছে করে না, আর তাই তার মনে হয় জয়মণ্টপে যে এখনো এখনো বিদু্যৎ আসেনি। এক অর্থে সেটা বেশ ভালোই হয়েছে। ভালোটা যে আর বেশিদিন থাকবে না সেটাও শাহবাজ মিয়ার জানা আছে। পলস্নীবিদু্যতের লোকেরা মাত্র কয়েকদিন আগে সরজমিনে সব কিছু দেখতে এসেছিল এবং যাওয়ার সময় শিগগিরই এই গ্রামে বিদু্যৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করে গেছে। কিন্তুু আসছে না, এ নিয়ে শাহবাজ মিয়ার খেদ নেই।
লাইট এলে কী আর না এলেই কী? তার চেয়ে বরং যেমন আছে তেমনই ভালো। লাইটের সঙ্গে না আবার নতুন কোন আপদ এসে হাজির হয়। বিদু্যৎ না থাকলেও মাঝে মধ্যেই জয়মণ্টপে রাতদিনের পার্থক্য থাকে না। সাধারণত বিদেশীরা আসার আগে আগেই এরকমটি হয়। রাতভর সাজুগুজু চলে। শাহবাজ মিয়া দোকানে থাকে বলেই রাতের এসব দৃশ্য তার চোখ এড়ায় না। ইচ্ছে না থাকলেও অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে হয় তাকে।
গ্রামেগঞ্জে মেয়েমানুষেরা রাতবিরাতে চলাফেরা কম করে। জয়মন্টপে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। সন্ধ্যা হতে না হতেই শাহবাজ মিয়া দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়, তাই বলে সন্ধ্যা হতেই ঘুমিয়ে পড়ে না; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমছে ওর ঘুমের পরিমাণ।
কাল রাতে শাহবাজ মিয়া হঠাৎ শুনতে পেল নারীকণ্ঠের আওয়াজ। পরিচিত মনে হল তার কাছে। বাইরে এসে দেখে মরিয়ম আর জয়গুন বেগমও আছে। তাদের সাথে মাঝের বাড়ির কফিলের বউও আছে মনে হলো। বাকি কয়জনকে চিনতে পারল না শাহবাজ মিয়া।
এত রাতে এরা এখানে কেন? প্রশ্নের উত্তর শাহবাজ মিয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যায়। এরা তো ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের সদস্য। তাদের সাথে ওই ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকেও দেখা যায়।
এই ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দেখলে শাহবাজ মিয়ার মনে পড়ে যায় কাবুলিওয়ালা গল্পের কথা। করিমন্নেছার কথাও ভুলতে পারে না সে।
আসলে ওর কপালটাই খারাপ। জন্মেছে গরীব ঘরে। গ্রামের লোকেরা চাঁদা তুলে গফুরের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল বাপ-মা নেই। স্বামী থাকবে অবলম্বন হয়ে। সেটাও হয়নি। আচমকা কী যেন হয়েছিল। গফুর নিখোঁজ। দিনের পর দিন। করিমন্নেছা এখন কার দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াবে। কেউ কেউ বলল, আবার বিয়ে করতে। করিমন্নেছা বলল- তা কি আর হয়। শুধু গতর খাটানোর জন্য কে আমাকে বিয়ে করবে। এতিম মেয়েটিরও কী হবে? অগত্যা করিমন্নেছা ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের কাছে যায়। যাওয়ার আগে বলেছিল- চাচা, কিছু টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করি। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াই। মা-মেয়ের পেটে সামান্য দানাপানি হলেই চলবে।
দূর থেকে শাহবাজ মিয়ার কানে আসে কর্মকর্তা ভদ্রলোকের কথা। শাহবাজ মিয়া ফিরে আসে বর্তমানে। কর্মকর্তাটি বলছেন, বিদেশীরা যদি সন্তুুষ্ট হন, আমাদের আরো টাকা দেয়া হবে। তাহলে বিশ্ব তহবিলের চেয়ারম্যান টাকা নিয়ে আসছেন? সুদূর আমেরিকা থেকে তিনি আসবেন"তাই এত প্রস্তুুতি, এত সাজুগুজু। অন্য সময়ের চেয়ে বাড়াবাড়িই মনে হয় তার কাছে। এর আগেও তো কতজন এসেছেন। কই, দোকান তো বন্ধ রাখতে হয়নি। বিশ্ব তহবিলের চেয়ারম্যান যেদিন আসবেন, সেদিন দোকান খোলা রাখা যাবে না। যেন মগের মুলস্নুক। তবু শাহবাজ মিয়া নিরূপায়।
তার কানে আসে কর্মকর্তাটি বলছেন, আপনারা সবাই ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছেন, কিস্তির টাকা ঠিকমত দেন-এসব বলতে যেন মুখে আটকায় না। টাকা পেলে লাখ টাকা ঋণ পেতে আপনাদের অসুবিধে হবে না।
কথাগুলো শাহবাজ মিয়ার কানে লাগে। লাখ টাকাও ঋণ দেয়? কই তাকে তো কেউ কোনদিন বলেনি হাজার টাকা ঋণ নিতে। তাকে তো কেউ বড় লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখায়নি।..বড় লোকঃঅনেক টাকার মালিকঃ
শাহবাজ মিয়ার ভাবনা বেশিদূর না এগুতেই চোখ চলে যায় মাঠের ওপাশে। যেখানে শুয়ে আছে তার স্ত্রী। কানে ভেসে আসে নারীকণ্ঠে কারো খিলখিল হাসির শব্দ। সে হাসিতেও টিপ্পনী কাটা হচ্ছে। রাহেলা যেন বলছে-হি.হি.হি. তুমি বড়লোক হবে? তোমার তো বউ নেই। হি.হি.
মুহূর্তকয়েক পর হাসির রেশ মিলে গেল বাতাসে।
_চাচা, পানি গরম আছে?
উত্তর পাড়ার রহিমুলস্নার ডাকে বাস্তবে ফিরে আসে বুড়ো।
_না, কী দিমু?
_লিকার ঢালেন। কড়া চাই।
দুপুরে খাওয়ার পর গদিতে বসেই মাথা হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমানো তার অভ্যাস। এ সময়ে খদ্দের এলে বিশুই সামাল দেয়। ছেলেটা গেছে মাঝপাড়ায় ঘর সাজানো দেখতে। রাস্তাঘাট পরিস্কার হচ্ছে।
_চাচা, বিশু কই।
_মাঝপাড়ার দিকে গেছে। বিদেশী আসবে। সাজাগোছ দেখতে গেছে।
_হুঁ, বুঝেছি। হাত থেকে চায়ের কাপটি বেঞ্চিতে রাখে। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলে রহিমুলস্নাহ-ভালই তো, এসব সাজুগুজু দেখলে গ্রামটারে ভালই লাগে। মাইয়া মানুদের যেমন সাজুগুজু করলে সোন্দর দেখায়।
দুই
রহিমুলস্নাহ চায়ের বিল দিয়ে চলে যায়। বুড়োর ভাবনায় আবারো ফিরে আসে করিমন্নেছা। খবর দিতে হবে যেন বিকেলে দেখা করে। ওরা যেমন শিখিয়ে পড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি করিমন্নেছাকেও শিখিয়ে দিতে চায় শাহবাজ মিয়া। বিকেলে এলেই সব বুঝিয়ে দিতে হবে। বিশ্ব তহবিলের চেয়ারম্যানের সামনেই বলতে হবে তার কাহিনি।
তিন
অগ্রহায়ণের শেষার্ধের সকালে শিশিরভেজা ঘাস আর সূর্যের নরম রোদ গ্রামীণ মহিলাদের মাঝে বেশ কৌতূহল জুুগিয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের সদস্যরা একে একে জড়ো হচ্ছে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে। জয়মন্টপের মাঠটি ছাড়াও গ্রামের ভেতরে একটি চৌচালা টিনের ঘরে হাজির হচ্ছে কেউ কেউ। কারো পরণে কালো বোরখা। শ্যামবর্ণ গায়ে কারো পরনের ধূলিরংয়ের শাড়ি ধূলোয় লুটিয়ে চলছে। সরু রাস্তার দু'পাশে ছোট্ট সোনামনিদের সারি। সবার হাতে ফুলের পাপড়ি। বিশ্ব তহবিলের চেয়ারম্যান আসবেন। তার সঙ্গে আরো দেশি-বিদেশি মেহমান। সবাই অপেক্ষমাণ তাদের জন্যে।
শাহবাজ মিয়াও এসেছে।
এখানে তার আসার কথা নয়। আজ তার দীর্ঘদিনের রুটিন হেরফের হয়ে গেছে। এতক্ষণে পাঁচ-দশজন লোক এসে বসত তার দোকানের বেঞ্চিতে। অথচ নিষেধ করায় আজ দোকানই খুলতে পারেনি সে। অগত্যা বিদেশী মেহমানকে একনজর দেখার জন্যই সে এখানে এসেছে। তার চেয়ে বড় কথা করিমন্নেছা কী বলে তা শুনতে এসেছে সে।
ঘড়িতে ৯টা ৪৫। ঠিক ঠিক সময়েই সেই বিশ্বখ্যাত মানুষ হিউজ আর্নারের আগমনে এই গ্রামে যেন গরীবের বাড়িতে হাতির পা পড়েছে। তাকে নিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরাও গর্বিত। এমন একজন বিশ্বখ্যাত লোক বাংলাদেশের এই অজপাড়াগাঁয়ে আনতে পেরে তাদের গর্বে বুক ভরে যায়। যেখানে নিরাপত্তার ভয়ে অনেকেই ভ্রমণ স্থগিত করেছে এই দেশটিতে। সেখানে কোন রকমের সরকারি নিরাপত্তা ছাড়াই এমন ব্যক্তিত্ত্বকে নিয়ে আসা হয়েছে। সবই এই ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতার ক্ষমতা। যিনি পেনি, সিকি-আধূলি নিয়ে কারবার শুরু করে আজ হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। বেশি বেশি গরিবকে ঋণ দিতে পারছেন। তিনিও আছেন আর্নারের এক হাত ধরে, অপর হাতে জিন্স প্যান্ট আর হাতকাটা শার্ট পরিহিত এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা।
প্রায় সাদা গোঁফ, সামান্য লম্বা মুখের গড়ন আর দীর্ঘদেহী আর্নারের গায়ে একটি টি-শার্ট, পরণে নেভি বস্ন- জিন্স প্যান্ট। বয়স হলেও ততটা নুইয়ে পড়েননি। ধীর পায়ে সামনে এগুচ্ছেন আর সারিভাবে দাঁড়ানো শিশু-কিশোরেরা ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নিচ্ছে তাদের। এমন আতিথেয়তা আর্নার এর আগে দেখেনি। তার অনুভবে আজ বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার সুবিধাবঞ্চিত অবহেলিত এক গ্রামে এতটা আতিথেয়তা তার জন্যে ছিল কল্পনাবিলাস মাত্র। প্রকৃতি ও মানুষগুলোকে তার দেখতে ভালই লাগছে-সেই অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ যেন ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা ঈষৎ হাসি। নাকি বাংলাদেশ সম্পর্কে তার নতুন চিন্তা প্রশ্ন হয়ে ভেসে ওঠে তার কপালের ভাঁজে। এমন সুনির্মল পরিবেশেও এখানকার লোকেরা কেন যুগের পর যুগ গরীব থেকে গরীব হচ্ছে?
আর্নার এসে বসলেন চারদিক খোলা একটি চৌচালা ঘরে। গ্রামের সরু রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া এই ঘরটির এক কোণে লেখা আছে কেন্দ্র_১, ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক। সেখানে আগে থেকেই শ্রেণীকক্ষের মত সাজিয়ে রাখা বেঞ্চিতে বসা গ্রামের জায়াজননীরা। একেকটি মুখ যেন শতবছরের অভাবী রূপ তুলে ধরেছে প্রতাপশালী লোকটির কাছে। লম্বায় যেমন, তেমনি ফর্সাও। আর্নারের সাথে আসা মহিলাটা। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হল আর্নারের বান্ধবী হিসাবে।
_বুড়ো বেটার বান্ধবী! অনেকটা মুখ ফসকে যেন পেছন থেকে শব্দ বেরুলো। কয়েকজনের হাসির শব্দও হল। আবার তা মিলিয়ে গেল বাতাসে। তাতে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলেন আয়োজকরা। হাতের ইশারায় থামতে বললেন। তারপর মুহূর্ত কয়েক নীরবতা শেষে মুখ খুললেন ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ইউছুপ নূর। বললেন-আপনারা ভাল আছেন?
_হঁ্যা, ভাল আছি।
_আজ আপনাদের সামনে মেহমান নিয়ে এসেছি। উনারা এসেছেন অনেকদূর থেকে। বলেন তো কোন দেশ থেকে?
_আমেরিকা থেকে।
_কেন এসেছেন?
_আমাদের কার্যক্রম দেখতে।
_আপনাদের কিছু বলার আছে উনার কাছে?
কয়েকজন উঠে দাঁড়ালো।
শাহবাজ মিয়া দেখলো পেছনের সারিতে বসা করিমন্নেছা সুযোগ পেয়েই উঠে দাঁড়ালো। কথা বলার সুযোগ পেল সামনের সারিতে বসা একজন। নাম জয়গুন বেগম।
কথা বলতে শুরু করলো জয়গুন। যেন তোতাপাখি। দাঁড়ি-কমা, সেমিকোলনের ব্যবহার তার অভিধানে নেই। অনর্গল বলে যাচ্ছে। একটি গরু থেকে আজ চারটি গরুর মালিক। আড়াই হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গরু পালনের কাজ। ঠিক আগের রাতগুলোতে যেভাবে রিহার্সেল দেয়া হয়েছিল।
এভাবে আরো কয়েকজন বললো।
পেছন থেকে করিমন্নেছা বারবার উঠে দাঁড়াচ্ছে কিছু বলার জন্য। কিন্তুু সে সুযোগ পাচ্ছে না। পাবেই বা কি করে? তার কথা শুনলে বিদেশী মেহমান নাকি রাগ করবেন। ফিসফিসিয়ে কর্মকর্তা মহিলা তাকে বলল। শাহবাজ মিয়া বিষয়টি লক্ষ করে। তার খারাপ লাগে। ঋণ নেয়ার সময় শাহবাজ মিয়াও বলেছিল চেষ্টা করে দেখ কিছু করা যায় কি না। সেই অপরাধবোধে ভুগছে শাহবাজ মিয়া। তার মনে পড়ে রুহুল মিয়ার কথা। পরশু দুপুরে শাহবাজ মিয়ার দোকানে এসেছিল রুহুল মিয়া। রহিমুলস্নাহও ছিল।
বেঞ্চির পাশে বাঁশের মাচায় এসে বসে রুহুল । বলে, রহিমুলস্নাহর খবর কী?
_কী আর খবর। এই মাঠটা দেখছো না। কত সুন্দর করে সাজানো হইছে। এটাইতো নতুন খবর।
_ভালইতো লাগছে।
_আমিও কি আর মন্দ কই। কয়দিন আগেও কেমন ল্যাংটা ছিল মাঠটা।
বিদেশীরা আসলে তাদের সোন্দর দেশ দেখানোর জন্যই তো এই ফন্দি। সাংবাদিকরা ছবি তুলে নিবে। আমাদের গ্রামের কথা কত লোকে জানবে।
রুহুল মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে"ঠিকই। কম বুঝি বলেই তো অন্যরা আমাদের মাথায় নুন রেখে বরই খাচ্ছে। এই ধরো, তোমাদের পূবের বাড়ির মর্জিনার মা ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংকের সদস্য।
_হঁ্যা, এই গ্রামে সেই তো প্রথম সদস্য হয়।
_তার অবস্থাটা চিন্তা করে দেখ।
_কেন, তার আবার কি হল?
রহিমুলস্নাহর সাধারণ মাথায় এসব জটিল কথা ঢোকে না। মারপঁ্যাচ দিয়ে কথা বলা তার একেবারেই সয় না। তবু রুহুল মিয়ার কথায় সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। রুহুল মিয়া তারচে' দুই ক্লাশ বেশি পড়েছে। বুদ্ধিপরামর্শের জন্যও গ্রামের লোকজন তাকে ডাকে। রহিমুলস্নাহ ভেবে ঠিক পায় না কোনটা বোঝাতে চায় সে। মর্জিনার মা গত দশ বছর থেকেই এই ব্যাংকের সদস্য। শুরুতে লোকজন বারণ করেছিল। এমন কথাও বলেছিল-এদের সদস্য হলে কালো কাপড়ের কাফন পরানো হবে। তখন রুহুল মিয়াই সবার আগে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল।
দিনটি ছিল শুক্রবার। ভেজা আকাশ। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। রুহুল মিয়া বসেছিল এখানেই। হঠাৎ কাঁদতে কাঁদতে মর্জিনার মা এসে হাজির। কী হয়েছে, জিজ্ঞাসা করতেই বলল-বাড়ির লোকজন নানা কথা বলছে। কেউ চাচ্ছে না ক্ষুদ্র ঋণ ব্যাংকের সদস্য হোক সে। কিন্তুু বেচারী ছেলেমেয়ে নিয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। তফাজ্জলতো মারা গেছে টিবি রোগে। বউ-বাচ্চার জন্য কিছু রেখে যেতে পারেনি। মেয়েটাও কয়দিন পর সাবালিকা হবে।
মর্জিনার মা'র দুঃখ বুঝে সেদিন রুহুল মিয়া বলেছিল_তুমি সদস্য হও। বাড়ির লোকদের আমি বোঝাব।
রহিমুলস্নাহ বলে_তুমিই তো তাকে সদস্য হতে সাহস দিয়েছ।
_মনে আছে তাহলে।
_হঁ্যা, এখনতো মর্জিনার মা ভালই আছে।
_দুই হাজার টাকা দেনা থেকে দুইলাখ টাকা দেনা বেড়েছে।
_একটি সেলাই মেশিন দিয়ে কাজ করে আয় করেছে। ঋণ নিয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা রিক্সা চালাচ্ছে। টিনের ঘর করেছে।
"সবই হয়েছে। কিন্তুু ঋণ থেকে কি মুক্তি পেয়েছে?
ঠিকই তো। শাহবাজ মিয়া ভাবে। উপায় ছিল না বলেই করিমন্নেছা ক্ষুদ্র্রঋণ ব্যাংক থেকে তিন হাজার টাকা নিয়েছিল। গ্রামে ফেরি করে বেড়াত। তাতে লাভ হয়নি। কিস্তির টাকা আটকে গেছে। দোচালা টিনের ঘরটি ছিল তার সম্বল। সেই ঘরের চাল খুলে নিয়ে গেছে ওরা। করিমন্নেছার মাথার ওপর খোলা আকাশ ছাড়া আর কিছু নেই।
শাহবাজ মিয়া দেখল অন্যরা তখনো বলে চলেছে। জয়গুনের মত মরিয়মের মুখেও কথার ফুলঝুরি। একি করে সম্ভব?
মরিয়ম কি করে এমন মিথ্যা কথা বলতে পারল_শাহবাজ মিয়ার মাথায় ধরে না। দিন কয়েক আগেই মরিয়ম তার দোকানে গিয়েছিল। মরিয়মের হাতে চায়ের কাপটি তুলে দিতে দিতে শাহবাজ মিয়া জিজ্ঞেস করেছিল_খবর কি মরিয়ম।
মরিয়মের বাপের সঙ্গে শাহবাজ মিয়ার বেশ খাতির ছিল। সেই সুবাদে চাচা লাগে শাহবাজ মিয়া। বিয়ের অল্প কয়দিনেই বিধবা হয় মরিয়ম। এসব কারণে মরিয়মের প্রতি শাহবাজ মিয়া একটু দুর্বল। মরিয়মও যেন কিছুটা পিতৃস্নেহ অনুভব করে শাহবাজ মিয়ার কাছে এলে। তাই কখনো চাপের পয়সা দিতে হয় না তাকে।
_চাচা, দিনকাল খারাপ। কিস্তির টাকা চালাতে পারছি না।
কথাটা যেন এখনি কানে বাজছে। অথচ শাহবাজ মিয়া শুনলো মরিয়ম ঋণের টাকা নিয়ে ছাগল কিনেছে। কিস্তিও ঠিকমত দিতে পারছে। দুই মেয়ে নিয়ে সংসারও ভাল যাচ্ছে।
শাহবাজ মিয়া দেখলো বড় বড় ক্যামেরায় মরিয়মের ছবি তোলার হিড়িক। অন্যদেরও। ছবি তোলা যেন থামছে না। একের পর এক ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে। নানা ভঙিতে ছবি তুলছে ফটোসাংবাদিকরা। টিভি ক্যামেরার লোকগুলোও যেন অস্থির হয়ে পড়েছে। করিমন্নেছার খবর কেউ নিচ্ছে না। মরিয়ম আর জয়গুনই যেন সব খবরের উৎস। জয়মন্টপে ওদের এত গুরুত্ব দেখে হেসে ফেলে শাহবাজ মিয়া।
=======================
আলোচনা- 'তুর্গিয়েনেফ প্রসাদাৎ' by হায়াৎ মামুদ  গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল  ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস  গল্প- 'সোনালি চিল' by সৈয়দ মোফাজ্জেল হোসেন  গল্প- 'বোবা ইশারা' by মণীশ রায়  গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা  আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা'  আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ'  আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি  ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ  কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা  আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান 


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ জামাল উদ্দীন


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.