গল্প- 'ঝল্সে ওঠে জরিণ ফিতা' by রফিকুর রশীদ

কিয়ামদ্দির স্বভাবের মধ্যে কেমন এক প্রকার এক রোখা গোয়াতর্ুমির ধাত আছে। ছোটবড় কারো কথাই ধর্তব্যের মধ্যে গন্য করে না।

নিজের ভালো কেবল সে নিজেই বোঝে, অন্যের বুঝের ধার ধারে না। কাঠে কোপ মারলে আর তাকে সরায় কে! তখন সে ওই এক কথার নিক্তির উপরে নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখবে, একেবারে নট্ নড়ন চড়ন। কী সংসার জীবন, কী সামাজিক জীবন আর কীইবা তার মাঠে ঘাটের চাষবাস- কিয়ামদ্দির একগুঁয়েমির কথা সর্বত্র প্রচারিত এবং প্রতিষ্ঠিত।
কিয়ামদ্দির বাপ নৈমদ্দির প্রবল বিশ্বাস, বৈশাখ মাসে জন্ম বলেই তার একমাত্র পুত্রের মেজাজ এমন রোদপোড়া মাটির মতো রুক্ষ, তিরিক্ষি।
জীবনের আগুনে পোড়খাওয়া এই বিশ্বাস কেবল বুকের মধ্যে পুষে রাখে না নৈমদ্দি, কখনো মনে মনে হিসেব মিলিয়ে দ্যাখে, কখনো বা কিয়ামদ্দির মাকে ডেকে তার সামনে মেলে ধরে। শুধু এক কিয়ামদ্দি বলে তা নয, তাদের আরো পাঁচটা সন্তান আছে। কারো জন্ম ফাল্গ-নে, কারো বা আশ্বিনে কি শ্রাবণে, সবারই স্বভাব চরিত্র কাদা মাটির মতো নরম। তা নিয়ে আবার গর্বে বুকের ছাতি ফোলায় কিয়ামদ্দির মা। মুখের আগল্ খুলে হাত নেড়ে নেড়ে গাওনা শোনায়- আটার গুনে হয় রুটি ভালো, আর মায়ের গুনে হয় বেটি ভালো, বুইঝেছো! হ্যাঁ অবশিষ্ট পাঁচ সন্তানই কন্যা। আমেনা, ছামেনা, মোমেনা, তারপর আসে কিয়ামদ্দি। পুত্র তৃষ্ণা পূর্ন হয় কিয়ামদ্দিকে দিয়েই। পূর্নই হয় কি? পরে আরো যে দুই সন্তান এসেছে, সত্যিকারের কথায় সে তো পুত্র আকাঙ্ক্ষা থেকেই। এক কিয়ামদ্দির খামখেয়ালি দেখতে দেখতে এতদিনে মনে হয় এই ভালো হয়েছে, ছেলের পরে যে দুই মেয়ে এসেছে-ময়না এবং টিয়া, দুজনেরই স্বভাব ঠান্ডা, অন্তরটা নরম ঘাসের মতো। এদের দুজনেরই জন্ম ভরা বর্ষায়, আষাঢ়-শ্রাবনে। রুদ্র কাল বৈশাখে কেবল ওই কিয়ামদ্দিই এসেছে, সৃষ্টিছাড়া, ছন্নছাড়া, গোঁয়ারের একশেষ।
বৈশাখে মানে, নৈমদ্দির আজো খুব স্পষ্ট মনে পড়ে-বৈশাখের পয়লা তারিখে লাঙলের ফলায় কঠিন মাটির বুক চিরে ধান বীজ তখন ছড়ানো সারা। ওই বীজ ঢেলে মাটি সমান করার জন্যে দু'পালা মই দিতে হবে; তার ইচ্ছে-পান্তা খেয়ে শরীর জুড়িয়ে নিয়ে তারপর মইয়ের উপরে চেপে দাঁড়াবে। এই ফাঁকে বলদজোড়াও একটুখানি জিরিয়ে নিতে পারবে। আহা, অবলা প্রাণী ওরা, কাঠফাটা এই রোদে ওরাই বা তিষ্ঠাবে কতক্ষণ! বাবলাগাছের ছায়ায় বলদজোড়া ছেড়ে দিয়ে নৈমদ্দি পান্তাভাতের সান্কি নিয়ে বসে। আইলের উপরে বসে কাপড়ের পোটলার বাঁধন আল্গা করতেই নৈমদ্দির মনটা জুড়িয়ে যায়। মাটির সান্কি ঢাকা আছে যে ঢাক্না দিয়ে, তার উপরে কলাপাতায় মুড়ানো এক মুঠো আঁখের গুড়, সঙ্গে ভিজিয়ে রাখা আতপ চাল এবং ছোলার ডালের কয়েক দানা-পয়লা বৈশাখে এই উপাচারে হবে কৃষকের মিষ্টিমুখ। পোট্লা খুলতেই মনে ভরে যায়। মাটির তৈরি সান্কি -মাল্সার চল্ প্রায় উঠেই গেছে সংসার থেকে। তবু পয়লা বৈশাখ বলে কথা। সাধ্যমতো আয়োজন ঠিকই করেছে আমেনার মা। নিজের শরীরের বেহাল দশা, তবু স্বামীর ইচ্ছে টুকু সে অপূর্ন রাখবে না কিছুতেই। কলাপাতায় মুড়ানো গুড়-আতপচাল টুকু হাতের মুঠোয় তুলতেই স্ত্রীর মুখ মনে পড়ে এবং মমতায় ভরে ওঠে নৈমদ্দির বুক। এদিকে সুযোগ বুঝে আলগা মাটির বুক থেকে ধান বীজ খুঁটে খেতে শুরু করেছে মাঠের যত পাখ্পাখালি। সেদিকে চোখ পড়তেই খানিক দূরে নৈমদ্দি দেখতে পায়-মেজো মেয়ে ছামেনা দৌড়ে আসছে তারই কাছে। দু'হাত তুলে পাখ্পাখালি তাড়ানোর কথা সে ভুলে যায়, উৎকণ্ঠায় হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ছামেনা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে সুসংবাদ জানায়-তাদের একটা ভাই হয়েছে। প্রবল আনন্দে নৈমদ্দিকোলে তুলে নেয় ছামেনাকে। তারপর বাপ-বেটিতে ভাগ করে খায় গুড়-আতপচাল। নিজে না খেয়ে সান্কির সব পান্তা ভাত বিলিয়ে দেয় মাঠের পাখিদের এবং বিকেল বেলায় বটতলার মেলা থেকে মেয়েকে ঝুমঝুমি আর কাচের চুড়ি কিনে দেবারও ঘোষণা দেয় নৈমদ্দি।
কিয়ামদ্দিন সেই বহু প্রত্যাশিত এবং প্রত্যপ্রতীক্ষিত পুত্রধন।
তা সেই পুত্র, মানুষ হলে তবেই না সস্তি। পাঁচ কন্যার মাঝে পাওয়া একমাত্র পুত্রকে রাজপুত্তুর' বানাবার সাধ্য এবং সাধা কোনোটিই ছিল না নৈমদ্দি এবং তার স্ত্রীর। তাদের স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা -কিয়ামদ্দি মানুষ হোক। নিজে চাষাভূষো মানুষ, তবু ভেবেছে ছেলেটার যদি একটু লেখাপড়া হয়। এই নবীননগরে তখন স্কুল ছিল না, ছেলেকে পাঠিয়েছে ভৈরবপারের গ্রাম রাধাকান্তপুরের স্কুলে। দু'চার ক্লাস লেখাপড়া যা হলো তা-ই হলো, কিয়ামদ্দির অন্তরে স্থায়ী দাগ ফেলে দিয়েছে সতীশ মাষ্টারের যাত্রাপালার দল কিশোর পেরোতে না পেরোতেই তার প্রকৃতি প্রদত্ত কণ্ঠে নেমে আসে পুরুষোচিত গাম্ভীর্য এবং সুরের অভিঘাত। স্টেজে উঠলেই দর্শক সে াতার অকুণ্ঠ করতালি পায়, নগদ বকশিসও জুটে যায় কখনো সখনো। যাত্রাপালার আসর ফেলে কতোদিন বাড়িই ফেরে না কিয়ামদ্দিন। সামনা সামনি তাকে বকাঝকাও যাবে না, তাহলে আবার সেই চিরতরে বাড়ি ছেড়ে যাবার হুমকি ঝড়বে মুখের উপরে। এই সব দেশে শুনে কিয়ামদ্দির মা ক্ষনে ক্ষনে কেঁদে বুক ভাসায়, নৈমদ্দি ভাবতে বসে-কবে কখন যে হাতের মুঠোর চেয়ে ফলের আকৃতি এভাবে বেড়ে গেল! এখন কষে ধরতে গেলেই মুঠো ফস্কে যায়। কী করবে সে!
অবশেষে কিয়ামদ্দিকে বশে আনার অভাবনীয় এক সুযোগ এলো বছর দশেক পরে হুট্ করেই। সতীশ মাষ্টারের মেয়ে সবিতা সে বছরই সবে কলেজে পা দিয়েছে। বাড়ি থেকে দু'আড়াই মাইল দূরে উপজেলা শহরের কলেজ। সবিতার ও কণ্ঠ সুরেলা। কলেজে নবীন বরন অনুষ্ঠানে নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখিরা বুঝিবা পথ ভুলে যায়' গেয়ে সে সাংঘাতিক করতালি আর ওয়ান মোর' পায়। শহরে নাম পড়ে যায় 'সন্ধ্যাদি সেকেন্ড।' কিন্তু মাত্র দিন পনের পরে সেই সেকেন্ড সন্ধ্যা কলেজ থেকে আর বাড়ি ফেরে না। বিস্তর খোঁজাখুঁজি হয়। সবিতার কণ্ঠে মুগ্ধ হয়েছিলেন বলে কলেজের প্রিন্সিপাল সাহেব পর্যন্ত সতীশ মাস্টারকে সঙ্গে নিয়ে থানা-পুলিশ ঘেঁটে তোলপাড় শুরু করেন। কিন্তু কী এক রহস্যময় এবং অব্যাখ্যের কারণে কারণে সতীশ মাস্টার নিরুদ্দিষ্ট কন্যা উদ্ধারে অনাগ্রহী হয়ে পড়লে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব পুরু লেন্সের চশমার আড়াল থেকে চোখ গোল গোল করে জানতে চান-কী ব্যাপার! কী হয়েছে আপনার? কেউ কিছু বলেছে আপনাকে? আই মিন্ হুমকি টুম্কি দিয়েছে নাকি?
সতীশ মাস্টার গাম্ভীর্যের কৃত্রিম মুখোশ এঁটে বসে থাকেন। প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের পীড়াপীড়ির মুখে আমতা -আমতা করে ঢোক্ চেপে বলেন, না না, তেমন কিছু নয়।
বিস্ময়ের ঘোর কাটে না প্রিন্সিপাল সাহেবের,
তাহলে, সতীশ মাস্টারের মুখে কুলুপ আঁটা। প্রিন্সিপাল সাহেব এখনো তৎপর; এসপি সাহেব একবার দেখা করতে বলেছিলেন। যাবেন না সেখানে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে যেন হাজার মন ওজনের পাথর সরানোর শ্রম দিতে হয় সতীশ মাস্টারকে। অনেক কষ্টে তিনি উচ্চারণ করেন,
হিন্দুর মেয়ে একবার পথভ্রষ্ট হলে তাকে ঘরে তোলার ও অনেক ঝক্কি ঝামেলা আছে স্যার।
পথভ্রষ্ট! আপনি কি নিশ্চিত সবিতা স্বেচ্ছায় পথভ্রষ্ট হয়েছে?
না। সতীশ মাস্টারের মুখে আর রা শোনা যায় না। প্রিন্সিপাল সাহেব আরো কী সব যুক্তির কথা তুলে ধরেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের শক্ত হবার পরামর্শ দেন। অতপর এক সময় তিনিও হাল ছেড়ে দেন। এ ঘটনার মাস খানেক পর, সবিতা প্রসঙ্গ অনেকটা খিতিয়ে এলে একদিন হঠাৎ শোনা গেল, সতীশ মাস্টার রাতের আঁধারে সপরিবারে নিরুদ্দেশ হয়েছে। বাড়ির কাছেই বর্ডার। বর্ডার টপ্কে ইন্ডিয়ায় চলে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। নানান ছুতোয় অনেকেই এভাবে পারি জমায়। সতীশ মাস্টারের বেলায় কেউ কেউ দু'চোখের ভ্রু ফুঁচকে বলাবলি করে, এও কি তবে নিরুদ্দেশ?
তা নিরুদ্দেশ কিংবা দেশান্তর যাই বলা হোক না কেন, সতীশ মাস্টারের এই অন্তর্ধানের পর আরো কিছু দিন তার য াত্রাদলকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হয়, কিন্তু কিয়ামদ্দি আর কিছুতেই প্রাণ খুঁজে পায় না। বাড়িতে বসে থাকে উদ্যমহীন, চুপচাপ। কী যে তার করণীয়, সেটাও যেন স্থির করতে পারে না। এই বিপণ্ন এবং বিমূঢ় অবস্থাটা কাজে লাগিয়ে এই সুযোগে তাকে খাঁচায় পোরার পরিকল্পনা আঁটে তার মা-বাবা, বোন-দুলভাই সবাই মিলে। এ ব্যাপারে সব চেয়ে বেশি উৎসাহ এবং তৎপরতা দেখা যায় কিয়ামদ্দির পিঠাপিঠি বোন টিয়া পাখির মধ্যে। তার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রাম গোবিন্দপুরে। ছোট পরিবার। সুখেই আছে। কিয়ামদ্দি একবার গোবিন্দপুরে টিয়াকে দেখতে গিয়ে রাফিয়া নামের এক ময়েকে দেখে রাধা বলে ডেকেছিল। খেয়ালী মানুষের এই খেয়ালিপনাটুকু সে নাকি ভুলতে না পেরে টিয়া কেউ নানাভাবে উত্যক্ত করে, আবার আদর আবদারও করে। শেষ পর্যন্ত টিয়া এবং তার স্বামীর মধ্যস্থতায় সেই রাফিয়ার সঙ্গে কিয়ামদ্দির বিয়ে হয় সেও এক বৈশাখেই। জন্ম মাসে বিয়ে করতে নেই বলে কিয়ামদ্দির মা খুব আপত্তি করেছিল। কিন্তু তার ছেলে কি কারো আপত্তি শোনার মানুষ! তাহলে আর গোয়অতর্ুমিটা যাবে কোথায়। তবে হঁ্যা, বিয়ের পর কিয়ামদ্দি ভেতরে বাইরে অনেকখানি বদলে যায়। মাঠঘাট, ঘর সংসারের প্রতিমনোযোগী হয়। নৈমদ্দি অবাক হয়ে অচেনা চোখে নিজের ছেলের কান্ডকীর্তি দ্যাখে। কেউ কখনো ভেবেছিল" এই ছেলে এভাবে কখনো সংসারের হাল ধরবে! বাপের কাছে কেমন অবলীলায় প্রস্তাব রাখে" অনেক কষ্ট কইরিছো, ইবার তুমার ছুটি।
ছুটি! নৈমদ্দিঅবাক হয়, ছুটি মানে?
তুমার ছুটি। ট্যাক্টার কিনি আমিই সব চাষাবাদ করবু।
আজকাল হয়েছে বটে কলের লাঙলের চল্। গরুর লাঙল প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু নৈমদ্দি ওই সব যান্ত্রিক হাঁঙ্গামায় জড়াতে চায় না। তবু সে কথা ছেলের মুখের উপরে না বলে সে কৌশলী হয়, জবাব দিয়ে আশ্বস্ত করে আচ্ছা, ট্যাকাপয়সা যোগাড় হোক, ট্যাকটার পরে কিনলিই হবেনে।
বাড়িসুদ্ধ সবার উৎকণ্ঠা এবং আশংকা ছিল নতুন বউ রাফিয়াকে নিয়ে। সে কি পারবে এই বেয়াড়া মানুষটিকে বাগ্ মানাতে? তার গায়ো রঙ ফর্সা নয়। নাক মুখের ভাও তেমন ধারালো নয়। খুঁত্নির নিচে কবে কোন ছোটবেলাকার কাটা দাগ এখনো মাথা উঁচিয়ে আছে। গানপাগল কিয়ামদ্দি যে কী দেখে তাকে রাধা বলে ডেকেছিল কে জানে! একদিনের সেই রাধা ডাকের মর্যাদা দিতেই এগিয়ে এলো কিয়ামদ্দি। বিয়ে উপলক্ষে নতুন করে দেখাশোনার বালাই নেই, সে এক কথায় রাজি। তবু বিয়ে বলে কথা। কনে দেখার আনুষ্ঠানিকতা তো থাকেই। কিয়ামদ্দির বাপ এবং মামা গিয়ে কনে দেখে আসার পর আর মন খুলে কথা বলে না। তাই বলে বিয়ে মোটেই আটকে থাকে না। বিয়ে হয় বৈশাখের সতেরোয়। কিয়ামদ্দিন জন্মমাসের বাকি দিনগুলো হাত-পা দিয়ে ঠেলতে চায়। শেষ পর্যন্ত ছেলের মেজাজ মর্জির কথা বিবেচনা করে নিজেই পিছিয়ে আসে। কিন্তু বিয়ের পর সেই মানুষই বউমার মুখ দেখে মন্তব্য করে" গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও মুখের গড়ন কেমন সুন্দর দেখেছ! পাড়াপড়শিদের কেউ কেউ মুখ টিপে হাসলেও নববধুর চেহারায় যে আলগা লাবণ্য ছড়িয়ে আছে এ কথা সবাই স্বীকার করে। আর কিয়ামদ্দি তো বাসররাতে গানে গানে গুলজার করে তোলে মধুলগ্ন। বহুদিন পর তার ভরাট কণ্ঠে শোনা যায় গানের পদ: 'সখা হে কীরূপ দেখিনু ঘাটে' চম্পক বরণি বয়সে তরুণী হাসিতে অমিয়ধারা, সুচিত্র বেনী দুলিছে তেমনি কোকিল চামরপারাঃ।' পরদিন সকালে বড় দুলাভাই কান ধরে গান শুধ্রে দেয়।
তোমার বউ তো ভাই 'চম্পক বরণি' নয় একটু শুধরে নাও!
শুধ্রে নিতে একটুও সময় লাগে না কিয়ামদ্দির। শরীরের আড়ামোড়া ভেঁঙ্গে সে গেয়ে ওঠে, 'শ্যামল বরণি, বয়সে তরুণী, হাসিতে অমিয়ধারাঃ।'
দুলাভাই বলে, গায়েন বটে আমাদের কিয়ামদ্দি!
তা ঠিক। গায়েনও বটে। গোঁয়ারও বটে। নইলে নতুন বউ এভাবে কেউ আটকে রাখে? পাশাপাশি গ্রাম, যখন খুশি যাবে আসবে সেটাই তো স্বাভাবিক। সেই গ্রামে ননদ আছে টিয়াপাখি, সেতো বেশ ইচ্ছে হলেই বাপের াবড়ি যেতে পারে আসতে পারে; কেবল রাফিয়ার বেলায় যতো নিষেধাজ্ঞা" যাওয়া চলবে না গোবিন্দপুর। বিয়ের পরপরই যা দু'একবার যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে, তারপর থেকে বছরে একবারের জন্যেও অনুমতি মেলে না। কেন এই কড়াকড়ি বাড়াবাড়ি? গায়েন কিয়ামদ্দিন সহজসরল সহাস্য জবাব, তিলেক দন্ড না দেখিলে বাঁচে না পরান।
কিয়ামদ্দিন স্বভাবটাই এই রকম। সব কিছুকেই চূড়ান্ত মাত্রায় গ্রহণ করে। তার অভিধানে মাঝামাঝি বলে কোনো জায়গা বুঝি নেই। দেখতে দেখতে স্বামীর এই স্বভাবের সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে রাফিয়া। কোনোদিন সে হয় রাধা, কখনো ললিতা, কখনো রাই; কোনো কিছুতেই তার আপত্তি নেই, যেনবা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা অবুঝ চন্দ্রমুখী সে। আকাশের গায়ে চাঁদ হেলে পড়লে, তাকেও হেলে পড়তে হয় অনুগামী হয়ে। বাড়ির সবাই কিয়ামদ্দির অন্তরে রোদপোড়া মাটির রুক্ষতা দেখতে পায়, অথচ সে দ্যাখে সজল মেঘের ম্যামল ছায়া। কচি ধারের চারার মতো নরম, ঝিরঝিরে হাওয়ায় দুলে ওঠে হেসে ওঠে; সে হাসি ফাটা কার্পাসের মতো শুভ্রসফেদ। বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে টিয়া পাখি পটায় রাফিয়াকে" এই ভাবী, চল তোকে নিয়ে যাই গোবিন্দপুর।
মিটমিট করে হাসে রাফিয়া, জবাব দেয় না। আশ্কারা দেয় টিয়া, আমি সঙ্গে কইরি নিয়ে গেলি, ভাই কিছু বোল্বে না। চ, যাই। অবাক করা জবাব দেয় রাফিয়া। তার নিজেরই নাকি ইচ্ছে করে না কোথাও যেতে। অথচ এই রাফিয়া মাত্র বছর দুয়েকের মাথায় একদিন সকালে উঠে স্বামীর সামনে দিয়েই একবস্ত্রে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যায় বাপের বাড়ি। বাড়ির অন্য কেউ বুঝে ওঠার আগেই ভোরের কুসুম ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি ঘটে যায়। কিয়ামদ্দি একবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, বাধা দেয়; কিন্তু রাফিয়ার সামনে তখন সব বাঁধন যেনবা আলগা হয়ে গেছে। সে তীব্র ক্ষোভে অপমানে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে বেরিয়ে যায়। ঘটা অতিসামান্যই, কিন্তু ভয়ঙ্কর।
রাফিয়ার সেজো ননদ অধিক সন্তান প্রসরের ধকল সইতে না পেরে অসুস্থ শরীরে বাপের বাড়ি পড়ে আছে অনেকদিন থেকে। মাঝে মধ্যেই চন্ডীগ্রাম থেকে তাকে দেখতে আসে তার স্বামী। ননদ অসুস্থ বলে নন্দাইয়ের সেবাযত্নের ভার নিতে হয় বাড়ির বউকেই। কিয়ামদ্দিন মনে ঘোরতর সন্দেহ জেগেছে, নিজের অসুস্থ বউ দেখতে আসার অজুহাতে সিরাজদুলাভাই ঘনঘন এখানে আসে শালাজ বউয়ের সঙ্গে রঙ তামাশা করতে। আর রফিয়ার নিশ্চয় এতে প্রশ্রয় আছে। নইলে এমন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়বে কেন? অসুস্থ মানুষকে সামনে রেখে এত ঢলাঢলি, গড়িয়ে পড়ার কী আছে! সেজো দুলাভাইকে একদিন রাফিয়ার কাঁধে হাত রাখতেও দেখেছে কিয়ামদ্দি।
বেলা উঠতে উঠতে সারা বাড়ি হইচই পড়ে যায়- বউ নেই। নেই মানে? কী হয়েছে তার? গেল কোথায় এই ভোরবেলা? কেন গেল? প্রশ্ন ওঠে অনেক রকম, কিন্তু জবাব দেবে কে? সবার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি কিয়ামদ্দির দিকে, কিন্তু তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে কে? কিয়ামদ্দির চোখমুখ ও ভারি থমথমে। কী প্রশ্নের কোন জবাব দেবেকে জানে। তবু পিতা হিসেবে নৈমদ্দি এসে বউমার খোঁজ করতেই সে বাড়ির বাইরে চলে যায়। কোথায় যায়, কেন যায়, সে কথা কাউকে বলে না।
গোবিন্দপুর নিতান্ত পাশের গ্রাম বলেই অতি সহজে রাফিয়ার অবস্থান জানা সম্ভব হয় কিন্তু কোথা থেকে হঠাৎ কী হয়ে গেল। ভেতরের রহস্য কী এ সবের কিছুই জানা যায় না। পরদিন নৈমদ্দি ছুটে যায় বেয়াইবাড়ি, বউমাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে চায়, সে আসবে না; কী হয়েছে তাও বলবে না। রাফিয়ার মা বাপের মুখে ও কোনো অভিযোগের গন্ধ পাওয়া যায় না। উল্টো তারাই বরং অাঁকড়ে ধরে আসলে কী ঘটেছে তাই শোনার জন্য। তাদেরও আতঙ্কের শেষ নেই। ভোরবেলা রাফিয়া আসার খানিক পরেই হন্তদন্ত হয়ে কিয়ামদ্দি আসে। কিন্তু জামাইয়ের সামনে মেয়ে আসেতই চায় না। কথা বলতেই চায় না। শেষ পর্যন্ত সে মুখের উপর ঘোষণা করে এ বাড়িতে তুমি যদি বাড়াবাড়ি কর, তাহলি আমি গলায় দড়ি দেব না হয় বিষ খাব হঁ্যা।
ভয়ানক চমকে উঠে নৈমদ্দি। ভাবনার কোনো কূলকিনারা পায় না। হলো টা কি! তার ছেলে না হয় গোয়ার মূর্খ কারো কথায় রা কাড়ে না। কিন্তু বউমা তো বলবে সমস্যাটা কোথায়। না সে মা-বাপের কাছেও মুখ খোলেনি। তাহলে কি কিয়ামদ্দির কাছ থেকে এই কড়া ধাঁচের গোঁয়াতর্ুমিটাই সংক্রমিত হয়েছে বউমার মধ্যে? তাও কি হয়?
দুই পরিবারের সব চেষ্টাই একরকম ব্যর্থ হয়। ছেলে-মেয়ে কেউ কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করে না। অথচ কাউকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সরানোও যায় না। দুজনেই অনড়। টিয়া এসে আছড়ে পড়ে, ভাবীকে জাপটে ধরে কত রকম অনুরোধ করে, কিন্তু পাথর গলাতে পারে না।
মাসখানেক পরে গোবিন্দপুরের বটতলায় বৈশাখী মেলার আয়োজন হলে সবার অলক্ষে অনড় এই পাথর গলার সুযোগ রচিত হয় । এই মেলার ঐতিহৗ অনেক পুরানো। এখন সেই বটগাছও নেই, সামনে সেই নদীও নেই। নানা সময়ে নানান কারণে সতীশ মাস্টারের মতো অনেক হিন্দু দিনে দিনে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে, ফলে সেই চাকচিক্যময় মেলার আয়োজন হবে কী করে। পুরানো বটগাছ নেই। তবু বৈশাখ এলেই বসে বটতলার মেলা। এবার নাকি গানবাজনারও বিস্তর আয়োজন হয়েছে। সতীশ মাস্টারের হারানো শিষ্যের একত্রিত হয়ে যাত্রাপালা নামাবে, এমন কথাও শোনা গেছে। টিয়াপাখি ভাবীর কাছে মেলায় যাবার প্রস্তাব দিয়েও সাড়া পায়নি। আসলে রাফিয়ার বাপের বাড়ির পাশেই মেলাপ্রাঙ্গনে সেজেগুজে না বেরুলেও সবই দেখা যায় শোনা যায়।
রাত একটু ভারি হতেই মঞ্চ থেকে ভরাট কণ্ঠের গান ভেসে আসে। রাফিয়া কান খাড়া করে পরিচিত পদের সুর শুনে 'রূপ লাগি অাঁখি ঝুরে গুণে মনভোর, প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে প্রতিঅঙ্গ মোরঃ।' শুধু সুর হবে কেন, এই কণ্ঠও যে তার নিবিড়ভাবে চেনা! কত না রাত জেগে রাধার মানভঞ্জনের পদ শুনিয়েছে। তাহলে এতদিন পর সেই আবার মঞ্চে নেমেছে! ওই যে গাইছে হিয়ারও পরশও লাগি হিয়া মোর কাঁদেঃ।' রাফিয়া সহসা রাধা হয়ে যায়, রাই হয়ে যায়। সব বাধা ভুলে ছুটে আসে মঞ্চের সামনে। কিয়ামদ্দি তখন দুচোখ মুদে পাগলের মতো প্রলাপ বকে চলেছে, 'আমার সঙ্গ কাদে, রাই অঙ্গসঙ্গ লাগি আমার অঙ্গ কাঁদে।ঃ'
সবাইকে অবাক করে রাফিয়া হঠাৎ মঞ্চে উঠে এসে দুহাতে জাপটে ধরে কিয়ামদ্দিকে হায় মাধব, বলে ডুকরে ওঠে, তখনই বৈশাখী আকাশে বিদু্যৎ ঝলসে ওঠে জরিণ ফিতার মতো।
============================
ফিচার- ‘আক্রান্ত' by জাফর তালুকদার  স্মরণ- 'একজন বিস্মৃতপ্রায় বুদ্ধিজীবী' by আহমাদ মাযহার  গল্প- 'অলৌকিক উপাখ্যান' by হাসান মোস্তাফিজুর রহমান  গল্প- 'জয়মন্টপের জায়াজননী' by জামাল উদ্দীন  আলোচনা- 'তুর্গিয়েনেফ প্রসাদাৎ' by হায়াৎ মামুদ  গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল  ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস  গল্প- 'সোনালি চিল' by সৈয়দ মোফাজ্জেল হোসেন  গল্প- 'বোবা ইশারা' by মণীশ রায়  গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা  আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা'  আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ'  আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি  ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ  কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা  আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন  গল্প- 'বৃষ্টি নেমেছিল' by ইমদাদুল হক মিলন  গল্প- 'সড়ক নভেল' by হাসনাত আবদুল হাই  গল্প- 'জানালার বাইরে' by অরহ্যান পামুক  স্মৃতি ও গল্প- 'কবির অভিষেক' by মহাদেব সাহা  ইতিহাস- 'ভাওয়ালগড়ের ষড়যন্ত্র' by তারিক হাসান


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ রফিকুর রশীদ


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.