আলোচনা- 'বাঙ্গালির বদলে যাওয়া' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

ইসলাম ধর্ম যারা প্রচার করেছেন এই পলিমাটির দেশে, তারা তরবারি হাতে তা করেননি। তারা শান্তির বাণী পেঁৗছে দিয়েছেন পলিমাটির মানুষজনকে, তাদেরই পড়শি হয়ে। ফলে বাংলাদেশে যখন সংখ্যার বিচারে মুসলমান গরিষ্ঠ হল, তখনও তার পলিমাটির চরিত্র বদলায়নি

নিজেদের সম্বন্ধে বাঙ্গালির ধারণায় ভাল এবং মন্দ, দুই-ই আছে। বাঙ্গালি বীরের জাতি, এরকম কথা অনেক আগে থেকে বলা হলেও ১৯৭১-এর পর বেশ প্রত্যয় নিয়ে আমরা এটি বলতে পারি। বাঙ্গালি স্বাপি্নক, স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে; বাঙ্গালির স্বভাব কবির, অথবা বাঙ্গালি মা'কে ও দেশকে ভালবাসে জীবন দিয়ে-এরকম কথা তো মুখে মুখেই চলে আসছে বহুদিন থেকে।
আর যে কথাটি দীর্ঘদিন জায়গা করে নিয়েছে সমষ্টির আখ্যানে, তাতে সত্যতা নেই, এমন কথা বলা যাবে না। বাঙ্গালি স্বাপি্নক না হলে বাংলাদেশ হত না; প্রতিবাদী না হলে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে নিয়ে একাত্তর এবং আরো পরে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন হত না। তার পরও বাঙ্গালি যে নিজের সমালোচনা নিজে করে তাতেও সত্যতা আছে। অসন্তুষ্ট না হলে নিজের সমালোচনা কেউ করে না। এই অসন্তুষ্টি বাঙ্গালির মধ্যে একটু বেশি এবং এটি থাকায় বাঙ্গালি বেশ অস্থির-অন্য অনেক জাতির তুলনায় এবং পরিবর্তন কামী।
আমরা এ-ও বলতে পারি, আত্ম-সমালোচনা আছে বলেই বাঙ্গালির মধ্যে পরিবর্তনও হয়। তুরস্ক থেকে আসা ঘোড়া ব্যবসায়ী ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি যেদিন মাত্র ষোলো-সতেরো জন অনুসারী নিয়ে লক্ষণ সেনের রাজধানী আক্রমণ করলেন, নৃপতি সেন সেদিনই কোনো আগ-পাছ বিবেচনা না করে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে পালালেন। য পলায়তি স জীবতি-অথবা এরকম কিছু। আমার সংস্কৃত-জ্ঞান শূন্য, সেজন্য প্রবাদটি নিশ্চয় ভুলভাবে লিখেছি; কিন্তু অর্থটি ধরতে সমস্যা হয়নি-যে পালায়, সে বাঁচে। লক্ষণ সেনের পলায়নের অনেক যুগ পরে পলাশীর আমবাগানে নানান চক্রান্তের শিকার হয়ে নবাব সিরাজুদ্দৌলা ইংরেজের কাছে পরাজিত হলেন। বঙ্গ বিহার উড়িষ্যা জয় করে নিল ইংরেজ। একসময় বিজয়ীর বেশে মুর্শিদাবাদে ঢুকল রবার্ট ক্লাইভ। পরে শহরে ঢোকার ওই দৃশ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে ক্লাইভ লিখেছিল, 'যত মানুষ আমাদের দেখার জন্য রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়েছিল, তারা যদি একটি করে নুড়ি পাথর ছুঁড়ে মারত আমাদের ওপর, তাহলে আমরা পাথরের একটা পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে যেতাম।' বাঙ্গালিরা সেদিন নুড়ি পাথর ছুঁড়ে মারেনি। কী হয়েছে, কী ঘটেছে, তারা বুঝতেই হয় তো পারেনি। যারা পেরেছে, তারা বুঝেছে, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে নতুন দানব হাজির, এদের রুখতে হলে অপেক্ষা করতে হবে। এবং অপেক্ষা করে করে সময় যখন এসেছে, তখন নুড়ি পাথর ঠিকই ছুঁড়ে মেরেছে। ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, কালা বারি, ধলা বারি বাঙ্গালিরই সন্তান। আর মুর্শিদাবাদে ওই দিন ক্লাইভ না ঢুকে যদি অষ্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট টিম ঢুকত, অথবা ব্র্যাড পিট এবং জুলিয়া রবার্টস, তাহলে ওই অত মানুষই হত।
বখতিয়ার খিলজির কথায় ফিরে যাই। কোনো বাধা ছাড়াই বাংলায় ঢুকতে পেরে খিলজি যে মারদাঙ্গা শুরু করেছিলেন, তা নয়। তিনি ধীরে স্থিরে অগ্রসর হয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, বাংলার নৃপতি নিজস্ব কোনো বিবেচনায় পালিয়ে গেলেও মানুষগুলোর ভেতর অহংকার আছে। সেই অহংকারকে তিনি চিনতে পেরেছিলেন। বাইরে থেকে যারাই এসেছে বাংলাদেশে, যোদ্ধা থেকে নিয়ে ধর্মপ্রচারক-সবাই এই জাতিকে সমীহ করেছে এবং এখানেই খানা গেড়ে বসেছে। ইসলাম ধর্ম যারা প্রচার করেছেন এই পলিমাটির দেশে, তারা তরবারি হাতে তা করেননি। তারা শান্তির বাণী পেঁৗছে দিয়েছেন পলিমাটির মানুষজনকে, তাদেরই পড়শি হয়ে। ফলে বাংলাদেশে যখন সংখ্যার বিচারে মুসলমান গরিষ্ঠ হল, তখনও তার পলিমাটির চরিত্র বদলায়নি। সে স্বপ্ন দেখেছে, সে প্রতিবাদী হয়েছে, সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয় বাঙ্গালির জন্য দুর্বিপাকের ছিল না, ছিল ক্লাইভের বঙ্গবিজয়। যেহেতু ক্লাইভ এই পলিমাটির মানুষজনের কাছে যায়নি। তার দানব-শক্তি দিয়ে পদানত করতে চেয়েছে তাদের।
ইতিহাসবিদরা আমাদের জানান, বাংলায় যারা ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছিলেন, তারা প্রধানত ছিলেন সুফী মতবাদের। সুফীরা কখনো জোর খাটানোয় বিশ্বাস
করতেন না। তারা মানুষের সঙ্গে মিশে, তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে, তাদের নমিত ব্যবহারে মানুষের মন জয় করে ধর্মপ্রচার করেছেন। বাংলাদেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ বরাবরই দরিদ্র। তাদের অধিকার বলে কিছু নেই। তারপর যখন শ্রেণী ও বর্ণপ্রথা তাদের উন-জন বিচার করে অস্পৃশ্যতার দূরত্বে ফেলে দেয়। তারা তাদের আত্ম-সম্মানটুকুও হারিয়ে ফেলে। সুফীরা এই মানুষগুলোকে কাছে টেনে তাদের আত্ম-সম্মান কিছুটা হলেও জাগিয়ে দিয়েছিলেন। তারা আত্ম-সম্মানবোধ সম্পন্ন হয়েছে; কিন্তু জিঘাংসা বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়নি। ফলে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঘোরতর বিবাদ তৈরি হয়নি। আমাদের গ্রামগুলোর কাঠামো যুগ যুগ ধরে এমনি যে, ধর্ম-বণর্, নির্বিশেষে সকলকেই তাতে নিজ নিজ জায়গা করে নিতে হয়। সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির অনেক চেষ্টা হয়েছে; কিন্তু মুসলমান হিন্দুকে পরিত্যাগ করেনি; হিন্দুও ছেড়ে যায়নি মুসলমানকে। ফলে এখনও সাম্প্রদায়িক বিরোধের বিবেচনায় উপ-মহাদেশের যে কোনো দেশ থেকে বাংলাদেশ উন্নত অবস্থানে। এখানে বিরোধ যে নেই তা নয়; কিন্তু এই বিরোধ একে অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার দিকে যায়নি, যদিও রাজনীতির কূট-পঁ্যাচালে মাঝে মাঝে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়। রাজনীতির ঠাকুরেরা নানান কায়দায় বিভেদ তৈরি করে ফায়দা লোটে। তারপরও মানুষ তাদের কায়দাগুলোকে প্রতিহত করে। সুফী ঐতিহ্যের বিপরীতে এই যে আমাদের সময়ের উগ্রবাদ, এটি এখন সবচেয়ে বড় বিপদ সৃষ্টি করছে। এখন ইসলামের শান্তির বাণীগুলো অবহেলিত। বরং তলোয়ার, বোমা আর বুলেটে এই উগ্রবাদীদের বিশ্বাস। তারা যদি বাইরে থেকে আসা উগ্রবাদের ঢেউয়ে গা না ভাসিয়ে একটু ভাবত, দেখত, সুফীরা আবেদন রেখেছিলেন মানুষের আত্ম-সম্মানের কাছে ভালবাসা দিয়ে তাহলে নিশ্চয় তাদের আচরণ বদলাতো। একবার আত্ম-সম্মান জাগলে ভালমন্দের বোধটা আপনা থেকেই চলে আসে। তখন মানুষ শান্তি কোথায় বুঝতে পারে। উগ্রবাদীরা ধর্মের নামে যে বোমা মারছে, তাতে ওই আত্ম-সম্মান জাগে না, ভীতি জাগে। বিরোধ জাগে। বাঙ্গালি এগুলো পছন্দ করে না।
বাঙ্গালি যে বাইরের সবাইকে আপন করে নিয়েছে, নিজের ঘরে স্থান দিয়েছে, সে তার চরিত্রের এক চমৎকার দিক। তবে বাইরের যারা, যেমন ইংরেজ, কখনো বাঙ্গালির আপন হতে পারেনি, কেননা, তার অহংকার এবং ঔদ্ধত্য এবং তার ক্ষমতার প্রকাশ তাকে একশ হাত দূরে রেখেছে; কিন্তু যারাই বিনয়ের সঙ্গে, সৌজন্যের সঙ্গে বাঙ্গালির কাছে গিয়েছে, তাদের জন্য ঘর থেকে পিঁড়িটি বের করে দিয়েছে সে। বিদেশী যারাই বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাল কথা লিখেছেন, তারাই এই অতিথিবৎসলতার বর্ণনা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে এই অতিথিবৎসলতার এক বিশাল দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল বাঙ্গালি, যখন শহর থেকে দলে দলে মানুষ গেছে গ্রামে এবং গ্রামের মানুষ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ সাধ্যে যতটুকু সম্ভব সেবা করেছে অতিথির। বস্তুত একাত্তরের বাঙ্গালির আচরণ ছিল আদর্শিক বাঙ্গালির। এর পর থেকেই যেন বাঙ্গালির বদলে যাবার পালা।
১৯৭৪ সালে যখন দুর্ভিক্ষ হল উত্তরবঙ্গে, হাজার হাজার অভুক্ত মানুষ ছুটে এল ঢাকায়; কিন্তু রাজধানীর মানুষ চরম স্বার্থপরতার চর্চায় তাদের দরোজা বন্ধ করে দিল গ্রামের অভুক্ত মানুষগুলোর মুখের ওপর। সেদিনই আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল এই বিষয়টি যে, বাঙ্গালি আর একাত্তরে বাঙ্গালি নেই। বদলে গেছে।
আত্ম-সমালোচক বাঙ্গালিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ যেমন আছেন, নীরদ চন্দ্র চৌধুরীও আছেন। এ দুজনের মধ্যে তফাৎ হল, রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা ছিল ভালবাসা থেকে, নীরদ চৌধুরীর ক্রোধ থেকে। রবীন্দ্রনাথ ভেতো বাঙ্গালির অভিধাটি পছন্দ করতেন না। তক্তপোষে বসে বোতাম-অাঁটা জামার নিজে বাঙ্গালি সন্তান তাস-পাশা খেলে, তার প্রাণ পোষ মানা এই ছবিটাতে তার আপত্তি ছিল। তিনি 'ইহার চেয়ে' আরব বেদুঈন হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ছবি দেখতেন, একটা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি দিগন্ত পানে দুটছেন। রবীন্দ্র গানের ভেতো বাঙ্গালি অবশ্য এখন ছড়িয়ে পড়েছে যারা বিশ্বে। উত্তর মেরু, এভারেস্ট যাচ্ছে; সম্ভব হলে চাঁদেও যাবে।
প্রতিদিন গায়ের লোম-ওঠানো এ্যাডভেঞ্চারে মরুভূমি, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে জীবিকার সন্ধানে ছুটছে ভূগোলের সর্বত্র। এখন আরব বেদুঈনরা বরং ঘোড়া আস্তাবলে রেখে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ডুন-বাগি চড়ে মরুভূমি পার হচ্ছে, তাদের ভুঁড়ি দিয়ে স্টিয়ারিং হুইল চেপে। আরবরা বদলেছে, তাদের বালির নিচের তেল- গ্যাস এক ধাক্কায় তাদের প্রত্যেককে কোটিপতি করে ফেলায়। বাঙ্গালি বদলেছে, কারণ ঘরে বসে থাকলে আয়-উপার্জনের অভাবে তাকে উপোস দিতে হবে; কিন্তু অবাক কাণ্ড, বিশ্বের যে দেশেই বাঙ্গালি গিয়েছে, নিজেকে আইন মান্যকারী ও পরিশ্রমী প্রমাণিত করেছে।
রবীন্দ্রনাথ মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন বাঙ্গালি জাগুক। তিনি বুঝেছিলেন, এই জাগরণ সম্ভব আত্মশক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে। নিজেও প্রায়োগিক চেষ্টা করেছেন বাঙ্গালির জাগরণে। বাঙ্গালির শিক্ষার জন্য স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন, সমবায় আন্দোলনের সূচনা করেছেন, পানীয় জলের ব্যবস্থা করেছেন; কিন্তু বুঝেছেন, বদলানোটা সময়ের ব্যাপার। অধৈর্য হয়েছেন, সমালোচনা করেছেন; কিন্তু আশা ছাড়েননি। নীরদ চন্দ্র চৌধুরী বাংলার বাইরেই কাটিয়েছেন জীবনের বেশির ভাগ সময়, শেষ পঞ্চাশ বছর তো ইংল্যান্ডেই। এক আত্ম-জীবনীতে কিশোরগঞ্জের আদিগ্রামটির বেশ আবেগী বর্ণনা দিয়েছেন; কিন্তু ওইটুকুই। তার কাছে বাঙ্গালি আত্মঘাতী। আত্মঘাতী বাঙ্গালী নামে একটি বইও লিখেছেন। সেটি পড়ে মনে হয়েছে, বাঙ্গালির উত্থান সম্পর্কে তার কোনো আশাবাদ নেই। এবং বাঙ্গালি যে আত্মঘাতী, সে ব্যাপারটি নিয়ে তার খুব ক্রোধ আছে। তার পরও বাঙ্গালি শেষ পর্যন্ত বাঙ্গালিই। অক্সফোর্ডে তার বাসায় কুড়ি-বাইশ বছর আগে তার সঙ্গে আমি যখন দেখা করতে যাই, তিনি বাঙ্গালি আতিথেয়তা দিয়েই আমাকে বরণ করেছিলেন, তার পরনেও ছিল পাঞ্জাবি। আমার সঙ্গে এক নেপালী অধ্যাপক থাকায় বাংলায় কথা বলতে পারেননি। সেজন্য ফের যেতে হয়েছিল আরেক দিন এবং সেদিন অনেকক্ষণ বাংলায় কথা বলেছিলেন। 'বাঙ্গালি শুধু ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচে, ভাবে সে খুব সুন্দর। সে যে কদর্য, বুঝতে পারে না-' এ রকম অনেক ক্রোধের কথা বলেছিলেন। আবার দেখলাম আপন মনে রবীন্দ্র সঙ্গীতও শোনেন। তার প্রিয় শিল্পী ছিলেন কলিম শরাফী। বাঙ্গালি চরিত্রে যে অনেক বৈপরীত্যের সমাহার, নীরদ চন্দ্র চৌধুরী ছিলেন তার প্রমাণ।
২. পঁচাত্তরে কিছু বাঙ্গালি আমাদের দেখিয়ে ছিল, বাঙ্গালি হাসতে হাসতে শিশু খুন করতে পারে; যে মানুষটির হাত ধরে স্বাধীনতা এল, সে মানুষটিকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারে। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে যদি বাঙ্গালির বীভৎস রূপের একটি প্রকাশ দেখা গিয়েছিল, রক্ষী বাহিনীর হতে বামপন্থী ছাত্র শ্রমিক মারা পড়তে লাগলে যদি এক্সট্রা-জুডিশিয়াল কিলিং কী জিনিস তা জেনে এবং বাঙ্গালি এটি করতে পারে তা ভেবে বিমর্ষ হতে হয়েছে আমাদের। পঁচাত্তর কিন্তু একেবারে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল; কিন্তু বাঙ্গালি যেন জন্মগতভাবেই জলস্নাদ। সেই জলস্নাদদের যারা আশ্রয় দিল, লালন -লালন করল, তারাও জলস্নাদ শ্রেণীর। তাদের হাতও বাঙ্গালির রক্তে রাঙা হয়েছে, অথচ একাত্তরের পর আমরা ভেবেছিলাম, দেশটা এখন সোনার বাংলা হবে। মানুষ সুন্দর হবে। মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব থাকবে এবং বাঙ্গালি থাকবে দুধে-ভাতে। সেই সত্তরের মাঝামাঝি থেকে আমরা মনুষ্যত্ব হারাতে শুরু করেছি।
৩. এক লাফে যদি ২০১০ সালে চলে আসি আমরা, সালটা শেষ হওয়ার আগের মাসে, তাহলে যে ছবি দেখি দেশটার, তা রীতিমত হতাশ করে। খবরের কাগজ খুললেই এখন চোখে পড়ে হানাহানি, সহিংসতা, খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং, এসিড সন্ত্রাস, জমি দখল, অপহরণ-এ রকম ভয়ানক সব অপরাধের খবর। দুর্নীতি তো এখন নি:শ্বাস ফেলা বা খাদ্য গ্রহণের মতো স্বাভাবিক। এখন বাঙ্গালির চরিত্রে জমেছে অনেক কলুষ এবং প্রতিদিন জমছে নিত্য নতুন কলুষ। এমন নয় যে বাঙ্গালি অপরাধ করছে ক্ষুধার জ্বালায়। দেশের অর্থনীতি এখন আগের যেকোনো সময় থেকেই মজবুত। এক সময় গ্রামে গেলেই চোখে পড়ত উলঙ্গ ছেলে-মেয়ের দল। নয়-দশ বছর বয়স পর্যন্ত তাদের গায়ে কাপড় জুটত না। এখন উলঙ্গ শিশু তেমন দেখা যায় না।
দেশতো উন্নতির দিকে যাচ্ছে; কিন্তু কেন মানুষ খারাপ হচ্ছে? আমার তো মনে হয় যাদের কিছু আছে, তারা অনেক পেতে চায় বলে দুনর্ীতি করে। ধনী পরিবারের মাদকাসক্ত ছেলে খুন করছে মাদকের টাকার জন্য। মাদক কেন এত সর্বগ্রাসী? অন্য অনেক কারণের সঙ্গে, পরিবারগুলোর নীতিবোধ নষ্ট হয়ে যাওয়া এর একটি বড় কারণ। এখন এমন পরিবারের সংখ্যাই বেশি শহরগুলোতে, উপজেলা-থানাগুলোতে, যেখানে পিতার আয়ের একটি বড় অংশ আসছে দুনর্ীতির মধ্য দিয়ে। ঘুষ খাচ্ছে পিতা, টেন্ডারবাজি করছে, প্রেমিকার নগ্ন ছবি তুলে তা দিয়ে বস্ন্যাকমেইল করে অর্থ আদায় করছে ছেলে- কাগজগুলোতে এরকম খবর আসছে হর-হামেশা। এ পরিবারগুলোতো এসব না করলেও না খেয়ে মরবে না। তা হলে কেন করছে? করছে, কারণ লোভ। বাঙ্গালি এখন চূড়ান্তভাবে লোভী, বাঙ্গালির এখন একটাই রব- চাই, চাই, চাই।
কাগজে শিরোনাম দেখছি, 'রাত হলেই ছিনতাই', আমি হাঁটতে পছন্দ করি। যানজটে বসে বসে না ঘামার চাইতে দুই-তিনমাইল দূরত্বও আমি হেঁটে পার হতে প্রস্তুত। যদিও হাঁটার মতো ফুটপাত নেই ঢাকায়। তারপরও; কিন্তু সাহস পাই না। সন্ধ্যার পর তো অবশ্যই, এমনকি দিনের বেলাতেও। কত বন্ধু গল্প করেছে ছিনতাইয়ের। একজন হাসপাতালে গেছে চোখে মলম নিয়ে, আরেকজন উরুতে গুলি নিয়ে। তারা এখন এক পাও হাঁটে না রাস্তায়। রাতে গাড়ি নিয়েও বেরোয় না। সারা বাংলাদেশ এখন সন্ত্রাসের জনপদ। পেশাজীবী ছিনতাইকারি, ছিঁচকে চোর, অজ্ঞান-মলম পার্টি বাদ দিলেও আরেক ভয় উগ্রবাদী জঙ্গীর। তারা এখন চুপচাপ, এখন অনেকে বোমাসহ ধরা পড়ছে; কিন্তু সময় ও সুযোগ পেলে তারা মাঠে নামবে এবং তারা মাঠে নামলে কি করতে পারে- পাকিস্তানের দিকে তাকালে তা বোঝা যায়। এক পাকিস্তানী সাংবাদিক ঢাকায় এসেছিলেন ক'মাস আগে। তিনি জানিয়েছিলেন, করাচির কিছু জায়গার মানুষ জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে ভয় পান। প্রায় প্রতি শুক্রবার মসজিদে বোমা ফাটে। মসজিদ যেখানে আক্রমণের লক্ষ্য, সেখানে ধর্ম যে বিপন্ন, তা তো বলাই বাহুল্য।
বাঙ্গালি এক সময় নিজেকে চেনার জন্য জেগে উঠেছিল। পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ছিল ওই জাগরণের কাল। কি অভূতপূর্ব ছিল এই জাগরণ। বাঙ্গালি অসাম্প্রদায়িকতা এবং সৌহাদর্্যকে চরিত্রে নিয়েছিল। বাঙ্গালি বিশ্বমানব হওয়ার চেষ্টা করেছে। সমাজে বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নতুন নতুন চিন্তা ধারণ করেছে, মন্দের দিকে পিঠ ফিরিয়ে ভালকে আবাহন করেছে। এই ভাল হওয়ার সাধনা বদলে দিয়েছে আমাদের সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা এমনকি চলচ্চিত্রকে। এই সাধনার সর্বোত্তম প্রকাশ ১৯৭১; কিন্তু তারপরই শুরু হয়েছে পতন।
এখন যেন চলছে মন্দ হওয়ার প্রতিযোগিতা। শিক্ষাঙ্গনগুলোর দিকে তাকান, বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে। মাস্তানি আর টেন্ডারবাজি, মাদকাসক্তি আর ঔদ্ধত্য। পড়ালেখা উঠেছে শিকেয়। বাবা-মা যে শাসন করবে ছেলে-মেয়েকে, কোন মুখে? বাবা ঘুষের টাকায় ভুঁড়ি বানিয়েছে, মাও নির্লিপ্তভাবে উৎসাহিত করে যাচ্ছে তাকে, নয়তো সরাসরিই ঘুষের রাস্তায় নামাচ্ছে। কে করবে শাসন? এখন অনেক তরুণকে দেখলে ভয় হয়। আচার-আচরণে কোনো সৌজন্য নেই। অমার্জিত, উদ্ধত। যেখানে তরুণের সমাবেশ সেখানে যান। অর্ধেক তরুণই এমন আচরণ করবে, যেন গলার জোর খাটিয়ে, উদ্ধত ভাবভঙ্গী করে, কদর্য ব্যবহার করে তারা বিশ্ব জয় করবে।
এক বিশাল নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে, যারা শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে; কিন্তু শিক্ষার সংস্কৃতির সঙ্গে নয়। অনেক মানুষ আছে, যারা ধর্মকে জানে; কিন্তু ধর্মের অন্তর্গত মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে জানে না। এই যে ইভটিজিং নামক কদর্য চর্চাটি এখন মহামারি রূপ ধারণ করেছে, তা ওই লোভের সংস্কৃতি থেকে, মূল্যবোধহীন পরিবারগুলোর দিকভ্রান্ত আচার-আচরণ থেকে এবং নৈতিকতাহীন আচার-সর্বস্বতা থেকে উদ্ভূত। কালে কালে এটি বাড়বে, যখন নতুন নতুন প্রজন্ম সংস্কৃতি ও সৌন্দর্যহীন সনদমুখী শিক্ষায় অশিক্ষিত হয়ে পথে নামবে।
৪. আমার ভয়, বাঙ্গালি সত্যি সত্যি আত্মঘাতী একটি জাতিতে পরিণত হচ্ছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান নেই, যার ওপর আস্থা রাখতে পারি। পরিবারগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাও এখন উপরিতলসর্বস্ব। ধর্মকে বিপদগ্রস্ত করছে উগ্রবাদ, নৈতিকতার জায়গায় এখন দুনর্ীতির জয় জয় কার।
কিভাবে তাহলে ভালর দিকে ফিরবে বাঙ্গালি? উন্নত হবে তার চরিত্র? আমার বিবেচনায়। প্রথমেই ফেরাতে হবে পাঠের সংস্কৃতি। একেবারে প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করতে হবে। দৃশ্যমাধ্যম আমাদের তরুণদের সর্বনাশ করছে। এখন পাঠের দিকে ফিরলেই শুধু এই সর্বনাশ থেকে মুক্তি। তারপর সেই শিক্ষাথর্ীদের নিয়ে যেতে হবে খেলার মাঠে। প্রতিদিন প্রতিটি শিশু-কিশোর ছেলে এবং মেয়ে উভয়ই যদি তিনটি ঘণ্টা মাঠে থাকত, তাহলে অনেক সমস্যার যেমন মাদকাসক্তি এবং ইভটিজিং-এর সমাধান হয়ে যেত। তারপর অথবা একই সঙ্গে পরিবারগুলোর ভেতর নৈতিকতার পুনরুত্থান ঘটাতে হবে।
যদি দুনর্ীতিকে সবাই না বলতে শুরু করে। তারা কিছুটা অসচ্ছল হবে বটে; কিন্তু তাদের নৈতিক বল বাড়বে। পরিবারগুলোর ভেতর বন্ধন শক্ত হবে। সন্তান শুনবে পিতামাতার কথা, পিতামাতা সক্ষম হবেন সন্তানদের মনের ভেতর সম্মানের জায়গা করে নিতে। আর সমাজের দায়িত্ব হবে তরুণ প্রজন্মকে মানবিক মূল্যবোধ শেখানো, বিনয় এবং সৌন্দর্যবোধ শেখানো।
সম্ভব, এখনও সম্ভব। আমি হতাশ কিন্তু বিশ্বাস হারাইনি। যে জাতি একাত্তরে এমনভাবে নিজেকে প্রকাশ করল, সে জাতি আগামীতে আরো একবার জেগে উঠতে পারে। সেজন্য দরকার মানসিকতার পরিবর্তন।
এই পরিবর্তন স্বেচ্ছায় কেউ করতে না চাইলেও দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকবে, তখন ঠিকই করবে। যেদিন পরিবর্তনের বিকল্প হবে ধ্বংস, সেদিন পরিবর্তনটা শুরু হবে। বাঙ্গালি চরিত্রে এই 'ঠেলার নাম বাবাজি' একটা প্রভাব রেখেছে। এই ঠেলা লাগলে আমরা বাঙ্গালিরা বাপ বাপ করতে করতে পথে ফিরব।
এটিই আপাতত আমার আশাবাদ।
===========================
খবর- আফগানিস্তান শান্তি কত দূর?' by তৌহিদ আজিজ  গল্প- 'ঝল্সে ওঠে জরিণ ফিতা' by রফিকুর রশীদ  ফিচার- ‘আক্রান্ত' by জাফর তালুকদার  স্মরণ- 'একজন বিস্মৃতপ্রায় বুদ্ধিজীবী' by আহমাদ মাযহার  গল্প- 'অলৌকিক উপাখ্যান' by হাসান মোস্তাফিজুর রহমান  গল্প- 'জয়মন্টপের জায়াজননী' by জামাল উদ্দীন  আলোচনা- 'তুর্গিয়েনেফ প্রসাদাৎ' by হায়াৎ মামুদ  গল্প- 'একটাই জীবন' by হাজেরা নজরুল  ফিচার- 'এটি একটি সংখ্যামাত্র' by রণজিৎ বিশ্বাস  গল্প- 'সোনালি চিল' by সৈয়দ মোফাজ্জেল হোসেন  গল্প- 'বোবা ইশারা' by মণীশ রায়  গল্প- 'চিরদিনের' by মঈনুল আহসান সাবের  স্মরণ- 'আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহিত্যের এক সর্বসত্তা  আলোচনা- 'বাংলা চর্চা পরিচর্যা ও ইংরেজি শেখা'  আলোচনা- 'আমার ছেলেবেলার ঈদ আর বুড়োবেলার ঈদ'  আলোচনা- 'নৈতিক চেতনা : ধর্ম ও মতাদর্শ' by আবুল কাসেম ফজলুল হক খবর- গণতান্ত্রিক সব শক্তির সঙ্গে কাজ করতে চাই: সু চি  ফিচার- ‘নিজের কথা : বেঁচে আছি' by হুমায়ূন আহমেদ  কবিতা- সাম্প্রতিক সময়ের কিছু কবিতা  আলোচনা- 'মোস্লেম ভারত' পত্রিকায় চর্চিত মুসলিম ধর্ম- দর্শনের স্বরূপ  ইতিহাস- 'চারশ' বছরের ঢাকা লোক ঐতিহ্যের দশ-দিগন্ত' by আনিস আহমেদ  গল্পালোচনা- 'মৃত্যুর মুশায়রা' by সেলিনা হোসেন

দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্য
লেখকঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.