খাদ্য আলোচনা- 'অপুষ্টির প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও অজ্ঞতা' by শেখ সাবিহা আলম

যে পরিবার নিয়মিত মাছ, মাংস, ডিম বা দুধ কিনতে পারে না, ডাল তাদের আমিষের অভাব পূরণ করতে পারে
দেশে ব্যাপক অপুষ্টির প্রধান কারণ দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকায় দেশের এই বিপুলসংখ্যক মানুষ

প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার জোটাতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যথাযথ পুষ্টিজ্ঞানের অভাবও অপুষ্টির বড় কারণ। সামর্থ্য থাকলেও মানুষ সঠিক খাদ্য কিনে খায় না। এ ছাড়া আছে পুষ্টি সম্পর্কিত নীতি ও কর্মকৌশলে দুর্বলতা।
দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক বলেন, বর্তমান সরকার পুষ্টির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আগামী বছর থেকে পুরো দেশকে পুষ্টি কার্যক্রমের আওতায় আনতে চায় সরকার। তিনি বলেন, কৃষি, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের ভিত্তিতে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করারও চেষ্টা চলছে।
সরকারের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) পরিচালক ফাতিমা পারভিন চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, খাদ্যনিরাপত্তার সঙ্গে পুষ্টি পরিস্থিতির নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তবে যাদের সামর্থ্য আছে, তাদেরও অনেকে অজ্ঞতার কারণে পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার কেনে না।
পুষ্টির ওপর খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব: খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পুষ্টির ওপর কী প্রভাব ফেলে, তা জানার জন্য বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি), জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও আইপিএইচএন ২০০৮ সালে যৌথভাবে জরিপ করে। হাউসহোল্ড ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন অ্যাসেসমেন্ট, ২০০৯ শিরোনামের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের প্রতি চারটি পরিবারের একটিতে খাদ্যনিরাপত্তা নেই। ৫৮ শতাংশ পরিবারে খাদ্যাভাব আছে। এসব পরিবারের ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম, ৪৮ দশমিক ৬ শতাংশ খর্বাকৃতির। এসব শিশু দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টির শিকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ২০০৭ সালের সিডর ও একাধিক বন্যা এবং বার্ড ফ্লুর কারণে দেশে খাদ্য উৎপাদন কম হয়েছিল। এ ছাড়া ২০০৮ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকায় তখন খাদ্য আমদানিও কম হয়। এসব কারণে খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে।
গবেষকেরা বলছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র পরিবার মাছ, মাংস, ডিম, দুধ বা দুগ্ধজাত পণ্য তো কম খায়ই, সাধারণ খাদ্যও পরিমাণে কম খায়। অপুষ্টিকর খাদ্য খেতে বাধ্য হয় তারা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুস সাত্তার মণ্ডল ‘রিপিং হোয়াট উই সো’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে বলেছেন, মানুষ খাদ্যপণ্যের দামের সঙ্গে সমঝোতা করে চলছে। ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল ও রংপুরে মাঠ জরিপের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ভাত খাওয়ার পরিমাণ না কমলেও ছোট মাছ, বড় মাছ, দুধ, ডিম, মাংস ও ডাল খাওয়ার পরিমাণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০০৭ সালের তুলনায় ২০০৮ সালে ৬০ ভাগেরও বেশি কমেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে দুই বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) রোমে এক বিশেষ সভার আয়োজন করে। সভায় বলা হয়, দামের অস্থিরতা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশে এফএওর আবাসিক প্রতিনিধি অ্যাড স্পাইকার প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা বিশ্বব্যাপী। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখতে হবে, খাদ্যনিরাপত্তার অর্থ শুধু ধানের পর্যাপ্ত সরবরাহ নয়; ধানের পাশাপাশি শাকসবজি, ফলমূল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
পুষ্টিজ্ঞানের অভাব: দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ। পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য কিনে খাওয়ার সামর্থ্য এদের নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের অধিকাংশের পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার সম্পর্কে ধারণা কম। জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রমের নির্বাহী পরিচালক মাঈনুদ্দীন খন্দকার বলেন, বেশির ভাগ মানুষই মনে করে, পেট ভরে ভাত খেতে পারলেই পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০০৫) জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ মানুষের প্রয়োজনীয় ক্যালরির ৭২ থেকে ৭৯ শতাংশ পূরণ করছে ভাত। একজন ব্যক্তির ভাত খাওয়ার পরিমাণ ৩৫০ গ্রাম হওয়ার কথা, কিন্তু তারা খাচ্ছে প্রতিদিন ৪৪৮ গ্রাম। অন্যদিকে ৬০ গ্রাম ডালের পরিবর্তে খাচ্ছে ১৪ গ্রাম, ২০০ গ্রাম শাকসবজির বদলে ১৫৭ গ্রাম, ১৮০ গ্রাম প্রাণিজ আমিষের পরিবর্তে খাচ্ছে ৯৬ গ্রাম।
বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান আখতারুন নাহার বলেন, যে পরিবার নিয়মিত মাছ, মাংস, ডিম বা দুধ কিনতে পারে না, ডাল তাদের আমিষের অভাব পূরণ করতে পারে। তিনি বলেন, বাদাম ও শিমের বীচিতেও প্রচুর আমিষ থাকে। এসব তথ্য সাধারণ মানুষকে জানানো দরকার।
সমন্বয়হীনতা: ১৯৯৭ সালে জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছিল। এরপর প্রতিবছর জাতীয় পুষ্টি সপ্তাহ সাড়ম্বরে পালিত হতো। কিন্তু ২০০১ সালের পর থেকে তা বন্ধ রাখা হয়। জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক সচিব এম এ মান্নান বলেন, চার বছর ধরে পরিষদের কোনো বৈঠকও হয়নি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। আগে পুষ্টি কার্যক্রমে বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ ও হাঁস-মুরগি পালন করা হতো, এখন নেই। বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারণার ব্যবস্থা ছিল, এখন তা-ও বন্ধ। কৃষি মন্ত্রণালয়ও আলাদাভাবে দক্ষিণাঞ্চলে ডাল ও তেলজাতীয় চাষের আবাদ, বৃহত্তর রংপুরে শস্যবহুমুখীকরণ প্রকল্প এবং পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, বগুড়ায় উচ্চমানসম্পন্ন ফসল উৎপাদন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের খাদ্যশস্য বিভাগের পরিচালক শফিকুল আলম জানান, তাঁরা সাধারণভাবে দেশের সব জায়গায় পুষ্টিমানসম্পন্ন শাকসবজি ও ফলমূল চাষের কথা বলছেন।
আখতারুন নাহার বলেন, দেশের অপুষ্টি দূর করতে হলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় করা দরকার। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুষ্টি বিষয়ে ডিগ্রি নিচ্ছে অনেক ছেলেমেয়ে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে দেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
এ ব্যাপারে খাদ্যসচিব বরুণ দেবনাথ বলেন, বর্তমান সরকার ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল মেয়াদি খাদ্যনীতি ও কর্মকৌশল তৈরি করেছে পুষ্টির বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে। এতে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের স্থিতিশীল ও পর্যাপ্ত সরবরাহ, খাদ্যদ্রব্য কেনার ক্ষমতা বাড়ানো, নারী ও শিশুদের জন্য যথেষ্ট পুষ্টি নিশ্চিত করার বিষয়গুলো আছে।
============================
গল্পালোচনা- 'ডান রাস্তার বামপন্থী' by কাওসার আহমেদ  খবর- 'মারা যাবে না একটি শিশুও' -বিলগেটসপত্নী, মেলিন্ডা গেটস  আলোচনা- 'সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের অঙ্গীকারঃ  নিবন্ধ- সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-একটি দেশ একটি কবিতার জন্ম by আলীম আজিজ  আলোচনা- 'আরও একটি সর্বনাশা দেশ চুক্তির বোঝা' by আনু মাহমুদ  গল্পালোচনা- হতাশার বিষচক্র থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে  আলোচনা- 'বেঁচে থাকার জীবন্ত পোট্র্রেট' by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গির  খবর- চলন্ত ট্রেনের নিচে মেয়েকে নিয়ে মা'য়ের আত্মহত্যা  গল্প- 'সেদিন অফিসে যায়নি আন্দালিব' by হাবিব আনিসুর রহমান  বিজ্ঞান আলোচনা- মানবযকৃৎ উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল  খবর- দিলমা রুসেফ । নারী গেরিলা থেকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট  আলোচনা- 'সকল গৃহ হারালো যার' by তসলিমা নাসরিন  রাজনৈতিক আলোচনা- 'বিষয় কাশ্মীর-ইনসাফ ও স্বাধীনতা by অরুন্ধতী রায়


প্রথম আলো এর সৌজন্যে
লেখকঃ শেখ সাবিহা আলম


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...

free counters

No comments

Powered by Blogger.