প্রবন্ধ- 'জাতীয় কবিতা উৎসব ২০০৯-এ পঠিত প্রবন্ধ সাম্রাজ্যবাদের যুগে দুই বিশ্বের কবিতা' by সলিমুল্লাহ খান

Hegemony entails the dominance of a given discourse even among those who are not its beneficiaries. It is the cultural arm of imperialism.

যে ভাবধারায় আপনার স্বার্থ নাই সেই ভাবধারার সম্মুখে আপনিও যখন নতি স্বীকার করেন তখন বলিতে হইবে সেই ভাবধারার আধিপত্য কায়েম হইয়াছে। সাম্রাজ্যবাদের সাংস্কৃতিক প্রকাশ এমনই।
—একবাল আহমদ (২০০৬/ক: ২৩১) 
জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণ পাইয়া আমার মনে হইয়াছিল আরেকবার জন্মগ্রহণ করিবার আমন্ত্রণ পাইয়াছি। কিন্তু লিখিতে বসিয়া টের পাইলাম এই কাজ অতিশয় কঠিন—পাণিগ্রহণের চেয়ে কম কঠিন নহে। কথাটা খুলিয়া বলিব।
শিল্পী মার্ক শাগালের ছবিতে মন্দির ভাঙছে স্যামসন।
আর যে অপবাদই কবিদের দেওয়া যাউক না কেন তাঁহারা বড় সহনশীল এই অপবাদ কেহ দিতে পারিবেন না। কবিরা সমালোচনা ব্যবসায়ীদের কত সহ্য করিতে পারেন তাহা আমার জানা নাই। স্মরণ করুন খোদ জীবনানন্দ দাশের বাক্য। সমারূঢ় সমালোচককে তিনি বরং কবিতা লিখিয়া দেখিবার রূঢ় উপদেশই দিয়াছিলেন। কবিরা শুদ্ধ স্বজনের সমালোচনা শুনিতে প্রস্তুত, তাহার অধিক শুনিবেন না। ইচ্ছায় হই আর অনিচ্ছায় হই, আমি সমালোচনার আদার বেপারি। একদা কবিযশোপ্রার্থীদের সঙ্গে কিছু সময় আমিও কবিতা-জাহাজের খবর লইয়াছিলাম। এই কথা স্বীকার করিতে দোষ নাই। সেই সুবাদে কিনা জানি না: কবিদের সমালোচনা করিবার খানিক অধিকার আমিও হয়তো অর্জন করিয়াছি।



তদুপরি শুনিয়াছি একালের আরবি প্রবাদে আরো একটা কথা চালু আছে। কুল্লু মান কানু আরাবুন ফি লোগাতিহিম, ওয়া সাকাফাতিহিম, ওয়া ওয়ালাইহিম ফা হুম আল-আরাব। অর্থাৎ যে তাহার বাক্যে, আচারে এবং বাসনায় আরব সে-ই আরব। (আহমদ ২০০৬/ক: ৩৭৭)

বাক্যে, আচারে এবং বাসনায় যে কবি সে-ই কবি। এই সংজ্ঞা গ্রহণ করিলে, আমি কবিদের সমালোচনা করিবার অধিকার খানিক অর্জন করিয়াছি কথাটা মনে হয় একেবারে ভিত্তিহীন নয়। 


আফ্রিকা মহাদেশের অন্তঃপাতী গিনি বিসাউ ও সবুজ অন্তরীপ দ্বীপপুঞ্জ (Guinea Bissau and Cape Verde Islands) নামক দেশের নেতা মুক্তিসংগ্রামী ও তত্ত্বজ্ঞানী মহাত্মা আমিলকার কাব্রাল (Amilcar Cabral) তাঁহার দেশ স্বাধীন হইবার দুই বৎসর আগে—১৯৭৩ সনের ২০ জানুয়ারি তারিখে—সাম্রাজ্যবাদী পর্তুগিজ সরকারের লেলাইয়া দেওয়া গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হইয়াছিলেন। তাহারও কয়েক বৎসর পূর্বে—১৯৭০ সনে—এক বক্তৃতায়, উত্তর আমেরিকার কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বলিয়াছিলেন, সাম্রাজ্যবাদ জিনিসটা অনেক বিষাদসিন্ধুই রচনা করিয়াছে। এইসব সিন্ধুর মধ্যে বিষন্নতম সিন্ধুর নাম জার্মানির জাতীয় সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক (ওরফে নাৎসি) দল। (কাব্রাল ১৯৭৩: ৩৯)

অনেকেই হয়তো বলিবেন, ইহা এমন কী নতুন কথা হইল? কাব্রাল বলিয়াছিলেন: নাৎসিরা মরে নাই, সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেই তাহারা বাঁচিয়া আছে। নতুন কথা সম্ভবত ইহাই।
আমিলকার কাব্রাল (১২/১০/১৯২৪ - ২০/১/১৯৭৩) 
কাব্রালের কয়েক বৎসর আগে—১৯৫০ সনের দশকে—ফরাসি দখলাধীন মার্তিনিক রাজ্যের নেতা, কবি ও মুক্তিসংগ্রামী এমে সেজার (Aimé Cesaire) এই কথাই অন্য কায়দায় বলিয়াছিলেন। নাৎসিনেতা হিটলারের পাপ মার্জনার অতীত—ইহা সকলেরই জানা আছে। তবে তাঁহার মতে, সকলের আরো জানা দরকার, ২০ শতকের সুশীল মানবদরদী ও অতি খ্রিস্টান এয়ুরোপীয় বুর্জোয়া ভদ্রলোকটির ভিতরেও একটা করিয়া হিটলার বাস করিতেছে।

* * *
হিটলারকে বুর্জোয়া ভদ্রলোক ঘৃণা করেন কী কারণে, জানেন? হিটলার মানুষের অবমাননা করিয়াছে বলিয়া নহে। হিটলারকে খ্রিস্টান বুর্জোয়া দুনিয়া ঘৃণা করে মানুষের অবমাননাকে সে সাদা মানুষের সীমানা পর্যন্ত টানিয়া আনিয়াছে বলিয়া। হিটলারের আসল অপরাধ তাহা হইলে আর কিছুই নহে। এতদিন যাবৎ এয়ুরোপের খ্রিস্টান বুর্জোয়া জাতি আলজিরিয়ার আরব, হিন্দুস্তানের কুলি আর আফ্রিকার নিগ্রোদের জন্য যে দণ্ড, যে শাস্তি, যে মারধর একপাশে চিহ্ন দিয়া মওজুদ করিয়া রাখিয়াছিল সেই মারধরই আডলফ হিটলার খোদ এয়ুরোপ মহাদেশে টানিয়া আনে। (সেজার ২০০০: ৩৬)

এয়ুরোপের মহাযুদ্ধ বাধিয়াছিল—কে না জানে—পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের উপর, বেশির ভাগ মানুষের উপর এয়ুরোপীয় নানান পরাশক্তির মালিকানা প্রতিষ্ঠার লড়াই আকারে। এই সর্বোয়ুরোপীয় যুদ্ধের প্রথম ভাগে—১৯১৮ সন নাগাদ—নব্য পরাশক্তি জার্মানি পরাজিত হয় বলিয়াই ইহার দ্বিতীয় ভাগে জার্মানির মানুষ হিটলারের নাৎসি দলকে ক্ষমতায় চড়ার সুযোগ দেয়। এই দ্বিতীয় ভাগের যুদ্ধে খোদ হিটলারের পরাজয় হইলেও সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় হইয়াছে—এমন কথা বলার উপায় পাওয়া যায় নাই। উদাহরণ দিয়া বলিতেছি: যখন ব্রিটেন ভারত, পাকিস্তান, বর্মা, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি ছাড়িয়া যাইতেছে, ঠিক তখনই স্বাধীনতার নাম দিয়া তাহারা ফিলিস্তিনে নতুন এয়ুরোপীয় উপনিবেশ—এসরায়েল রাষ্ট্র—বসাইতেছে।
এমে সেজার (Aimé Cesaire, জন্ম. মার্তিনিক ২৬/৬/১৯১৩ - মৃত্যু. মার্তিনিক ১৭/৪/২০০৮) 
অনেকখানি অভিনব কায়দায়, সন্দেহ নাই। তবু পরদেশদখল মানে পরদেশদখলই। আর উপনিবেশ মানে তো উপনিবেশই। (আহমদ ২০০৬/ক: ২৯৮-৩১৭)

ইহার কয়েক বৎসরের মধ্যেই শুরু হইল তথাকথিত ঠাণ্ডা যুদ্ধ। ১৯৫৫ সনের জোট নিরপেক্ষ বান্দুং মেলার সময় এয়ুরোপীয় সাংবাদিকরা ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামক নতুন একটা কথা চালু করিয়া দিলেন।

‘তৃতীয় বিশ্ব’ কথাটার মধ্যেও অভিনব এক লুকাচুরি লুকাইয়া ছিল। এতদিনে বিশ্ব যে প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীন ও পরাধীন দুই ভাগে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে তাহার সত্যকথাটি এই অলঙ্কারের আড়ালে চাপা পড়িয়া গেল। ১৯৯১ সন নাগাদ সাবেক রুশ সাম্রাজ্য ভাঙ্গিয়া পড়িবার পর—এতদিনে—স্পষ্ট হইতেছে, ঠাণ্ডা যুদ্ধের যুগেও বিশ্ব তিন ভাগে নয়, মূলত দুই ভাগেই ভাগ করা ছিল। এতক্ষণে ইহারই ডাকনাম দাঁড়াইয়াছে: উত্তর ও দক্ষিণ।

পৃথিবীকে আমরা যাহার যেমন ইচ্ছা দুই কেন, দুইশ ভাগেও ভাগ করিতে পারি। আমি সেই ভাগাভাগিতে আগ্রহ পোষণ করি না। আমার আবেগ অন্যত্র। বেশি পিছনে নাই বা গেলাম, অন্তত খ্রিস্টানি পঞ্জিকার ১৮ শতক পর্যন্ত গেলেই দেখিতে পাই তখন হইতেই বিশ্ব এক হইয়া গিয়াছে। এই খবর আমার শ্রবণ-প্রতিবন্ধী দুই কানে পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছাইয়াছে। নহিলে ১৯ শতকের গোড়ায় জার্মান মনীষী এয়োহান ফন গ্যেটেই (Johan von Goethe) বা কেন বিশ্বসাহিত্যের (Weltliteratur) ধুয়া তুলিতে যাইবেন? নানান দেশের নানান ভাষার ভেদ কাটিয়া বিশ্বসাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছে। ইহা টের পাইতে না পাইতেই ফের দেখিতেছি: শুদ্ধ অধীন প্রজার দেশে নহে, স্বাধীন রাজার দেশেও একই দুনিয়া আবার—নতুন করিয়া—দুই দুই ভাগে ভাগ হইতে চলিয়াছে।

আমার কথাটা বুঝাইবার প্রয়োজনে আর জায়গার অভাবে মাত্র দুই জন কবির দুইটা কবিতা খুলিয়া দেখাইতেছি। উদ্দেশ্য, সাম্রাজ্যবাদ জিনিসটা কী বস্তু আর ইহাকে কবিরাও বা কেমন করিয়া দেখেন তাহা নির্ণয় করা। অধিক করিতে পারিতাম তো দেখিতাম কবিরা যাহা দেখিতেছেন আমরা তাহা অনেক সময় দেখিতেই পাই না।

শুদ্ধ মনে রাখিবেন, সাম্রাজ্যবাদ কথাটা গালিও নহে, হেঁয়ালি তো কখনোই নহে। বিশেষ দেশের নীতিবিশেষও নহে। সাম্রাজ্যবাদকে ধর্মের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। প্রাচীন যুগে এক দেশের রাজা অন্য দেশ জয় করিলে তাঁহার ‘সাম্রাজ্য’ গড়া হইত। নয়া জমানায় এক দেশের হাতে আর দেশ ধরা পড়িলে লোকে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ কথাটা যোগ করে। দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ বিস্তর আছে। যাহা আছে তাহাও সামান্য কথা নহে। পরদেশদখল ব্যবসায়ের অন্দরমহলে এই অসামান্য পরিবর্তনটা ঘটিয়া গিয়াছে খ্রিস্টের ১৯ শতকে।

জনৈক কনরাড স্মিট (Conrad Schmidt) বরাবর ১৮৯০ সনের ২৭ অক্টোবর তারিখে লেখা এক পত্রযোগে জার্মান মহাত্মা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এই পরিবর্তনের কথাটাই খুলিয়া বলিয়াছিলেন। তাঁহার বয়ান অনুসারে, ১৮০০ সালের আগে এয়ুরোপের নানান পরদেশ-মালিক বা ঔপনিবেশিক শক্তি উপনিবেশ হইতে কি করিয়া সস্তায় মালামাল আমদানি করা যায় সেই ফিকির সন্ধান করিতেছিলেন। শিল্প-কারখানার বিপ্লব তাঁহাদের এই পথ হইতে সরাইয়া নতুন পথে ঠেলিয়া দিল। আনুমানিক ১৮০০ সালের পর তাঁহারা যাঁহার যাঁহার দেশের শিল্প-কারখানার পণ্যসম্ভার বিক্রয়ের স্বার্থে তাঁহার তাঁহার ঔপনিবেশিক বাজার রক্ষা করিতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। (মার্কস ও এঙ্গেলস ১৯৭৫: ৩৯৭-৯৮; হাবিব ২০০৭: ৫৮-৫৯)

কার্ল মার্কস তাঁহার যৌবনের এক সাংবাদিক রচনায় এই অর্থে ১৮১৩ সালকেই সাম্রাজ্যবাদের সূচনাকাল বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলেন। কারণ ভারতবর্ষের সহিত ব্যবসায়-বাণিজ্যে ইংরেজ পূর্ব ভারত কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার রহিত করিয়া ভারতের বাজারে ব্রিটেনের কারখানায় তৈরি সকল পণ্যের প্রবেশাধিকার অবাধ করিয়া দেওয়া হয়। সকলেই জানেন, এই ব্রিটিশ আইনের নাম ১৮১৩ সালের সনদ আইন।

ইহার ফলে ভারতবর্ষের জাতীয় শিল্প-কারখানা ধ্বংসের পথও খুলিয়া যায়। পুঁজি প্রথম খণ্ডে কার্ল মার্কস ব্রিটিশ আইনসভার দোহাইযোগে বলিয়াছিলেন ভারতীয় তাঁতির হাড্ডি জমিয়া হিন্দুস্তানের পথপ্রান্তর সাদা হইয়া গিয়াছে। এই সাম্রাজ্যবাদ-ধর্মেরই অপর নাম ২০ শতকের কোন কোন বিলিতি পণ্ডিত রাখিয়াছিলেন ‘স্বাধীন বাণিজ্যের সাম্রাজ্যবাদ’ (Imperialism of Free Trade)। অধীন দেশের পণ্য লুটিয়াই মাত্র এই সাম্রাজ্যবাদের সাধ মিটিল না। অধীন দেশের পণ্য তৈরির ক্ষমতাও সে লুটিয়া লইল। মহাত্মা আমিলকার কাব্রাল সাম্রাজ্যবাদ বলিতে পতিত দেশের পণ্য তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করিতে সক্ষম এই শক্তিমত্তার কথাই নির্দেশ করিয়াছিলেন।

আমরা এই প্রবন্ধে সেই প্রস্তাবই আমল করিতেছি মাত্র।


খ্রিস্টান পঞ্জিকার ১৮৪৭-৪৮ সনে মহান ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ার (Charles Baudelaire) ‘হাবিল ও কাবিল’ (Abel et Caïn) নামে একটি ছোট্ট কবিতা লিখিয়াছিলেন। ইহা তাঁহার জগদ্বিখ্যাত আবিলের ফুল (Les Fleurs du mal) কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যায়। বিখ্যাত বাংলা অনুবাদক বুদ্ধদেব বসু তাঁহার গ্রন্থে এই কবিতাটি গ্রহণ করেন নাই। (বোদলেয়ার ১৯৮৬: ২২৯-৩০; দেখুন, সংবর্ধনা ১, ২)

কবিতাটির স্বাদ অল্পস্বল্প লইতে হইলেও খ্রিস্টান ও এয়াহুদি পুরাণের গল্পটা কম বেশি স্মরণ করিতে হয়। তাই আমি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ (প্রকাশ কিতাবুল মোকাদ্দস) হইতে ইহার কিছু অংশ হাজির করিতেছি:
হাবিল ও কাবিল,শিল্পী: লরেনজো ঘিবার্তি (Lorenzo Ghiberti, জন্ম. ফ্লোরেন্স ১৩৭৮ - মৃত্যু. ফ্লোরেন্স ১৪৫৫)

    (পরে আদম আপন স্ত্রী হাওয়ার কাছে গমন করিলে তিনি গর্ভবতী হইয়া কাবিলকে প্রসব করিয়া বলিলেন, মাবুদের সহায়তায় আমি মানুষ প্রাপ্ত হইলাম। পরে তিনি হাবিল নামে তাহার সহোদরকে প্রসব করিলেন। হাবিল মেষপালক ছিল, ও কাবিল কৃষক ছিল। পরে কালানুক্রমে কাবিল নজরানারূপে মাবুদের উদ্দেশ্যে ভূমির ফল পেশ করিল। আর হাবিলও নিজের পালের প্রথমজাত কয়েকটি পশু ও তাহাদের চর্বি কুরবানী করিল। তখন মাবুদ হাবিলকে ও তাহার নজরানা কবুল করিলেন; কিন্তু কাবিলকে ও তাহার নজরানা কবুল করিলেন না; এই জন্য কাবিল অতিশয় ক্রুদ্ধ হইল, তাহার মুখ বিষণ্ন হইল। তাহাতে মাবুদ কাবিলকে বলিলেন, তুমি কেন রাগ করিয়াছ? তোমার মুখ কেন বিষণ্ন হইয়াছে? যদি সদাচরণ কর, তবে কি কবুল হইবে না? আর যদি সদাচরণ না কর, তবে গোনাহ্ দরজায় গুঁড়ি মারিয়া রহিয়াছে। তোমার প্রতি তাহার বাসনা থাকিবে, কিন্তু তোমাকে তাহার উপরে কর্তৃত্ব করিতে হইবে। আর কাবিল আপন ভাই হাবিলের সহিত আলাপ করিল, পরে তাহারা ক্ষেত্রে গেলে কাবিল আপন ভাই হাবিলের বিরুদ্ধে উঠিয়া তাহাকে কতল করিল। পরে মাবুদ কাবিলকে বলিলেন, তোমার ভাই হাবিল কোথায়? সে জওয়াব দিল, আমি জানি না; আমার ভাইএর হেফাজতকারী কি আমি? তিনি বলিলেন, তুমি কি করিয়াছ? তোমার ভাইয়ের রক্ত ভূমি হইতে আমার কাছে ক্রন্দন করিতেছে। আর এখন, যে ভূমি তোমার হাত হইতে তোমার ভাইয়ের রক্ত গ্রহণের জন্য আপন মুখ খুলিয়াছে, সেই ভূমিতে তুমি লানতী হইলে। ভূমিতে কৃষিকাজ করিলেও তাহা আপন শক্তি দিয়া তোমার খেদমত আর করিবে না; তুমি দুনিয়াতে পলাতক ও ভবঘুরে হইবে। তাহাতে কাবিল মাবুদকে বলিলেন, আমার অপরাধের ভার অসহ্য। দেখ, আজ তুমি ভূতল হইতে আমাকে তাড়াইয়া দিলে, আর তোমার দৃষ্টি হইতে আমি লুক্কায়িত হইব। আমি দুনিয়াতে পলাতক ও ভবঘুরে হইব, আর আমাকে যে পাইবে, সেই কতল করিবে। তাহাতে মাবুদ তাহাকে বলিলেন, এই জন্য কাবিলকে যে কতল করিবে, সে সাত গুণ প্রতিফল পাইবে। আর মাবুদ কাবিলের জন্য একটি চিহ্ন রাখিলেন, পাছে কেহ তাহাকে পাইলে কতল করে।

    পরে কাবিল মাবুদের খিদমত হইতে প্রস্থান করিয়া এদনের পূর্বদিকে নোদ দেশে বাস করিল। আর কাবিল আপন স্ত্রীর কাছে গমন করিলে সে গর্ভবতী হইয়া হনোককে প্রসব করিল। আর কাবিল একটি নগর পত্তন করিয়া আপন পুত্রের নামানুসারে তাহার নাম হনোক রাখিল। (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘পয়দায়েশ,’ ৪: ১-১৭) 

ভাইয়ের রক্তে ভাইয়ের হাত রাঙ্গাইবার কাহিনী হিসাবে আমরা সচরাচর এই গল্পের ব্যাখ্যা করিয়া থাকি। ইহাতে কিন্তু কয়েকটা জিজ্ঞাসার জবাব মিলিতেছে না। যেমন মাবুদ কী কারণে কাবিলের নজরানা গ্রহণ করিলেন না? আর আর দশ শাস্তির জায়গায় মাবুদ কেন তাঁহাকে শুদ্ধ পলাতক ও ভবঘুরে হইবার দণ্ড বিধান করিলেন? করিলেনই যদি তবে আবার তাঁহাকে নতুন নগর পত্তন করিবার তৌফিকই বা কেন দিলেন?

বিশেষ জ্ঞানীরা বলিতেছেন, এই পুরাণের সহিত আগের জমানার আরো একখানা পুরাণ মিশিয়া একাকার হইয়াছে। তাই আমাদের বোধের এই গণ্ডগোল। প্রথমে ছিল কাবিলের নগর-পত্তনের গল্প। সেখানে তিনি বীর বা নায়ক ছিলেন। পরে ভ্রাতৃহত্যার গল্পটা জোড়া দিয়া তাঁহাকে পবিত্র ভূমি হইতে তাড়াইয়া দেওয়ার ঘটনাকে বৈধতা দেওয়া হয়।
শার্ল বোদলেয়ার (Charles Baudelaire; জন্ম. প্যারিস ৯/৪/১৮২১ - মৃত্যু. প্যারিস ৩১/৮/১৮৬৭)

খেয়াল করিলে আরো দেখিবেন, কাবিল প্রথমে কৃষক ছিলেন। কিন্তু হিব্রু ভাষায় কাবিল শব্দের উচ্চারণ ‘কায়িন’ (Kayin), যাহার অর্থ কামার বা ইংরেজিতে যাহাকে বলে Smith, অর্থাৎ কারিকর। আর হাবিল শব্দের হিব্রু উচ্চারণ হেবেল বা এবেল (Hebel)। ইহার অর্থ ‘এক ঝাপটা বাতাস’। পেশায় তিনি মেষপালক, অর্থাৎ ভবঘুরে। এই ঘটনায় গৃহস্থ ভবঘুরে হইল আর ভবঘুরে হইল গৃহস্থ। এক কথায় বিপ্লব ঘটিল। (বেলৎস ১৯৮৩: ৫৬-৫৭, ৬৮-৭০; আসিমব ১৯৮১: ৩৩-৩৪; ইনসায়িট ১৯৮৮; জোনডেরবান ১৯৬৭)

ফরাসি কবি শার্ল বোদলেয়ারকে যাঁহারা এতদিন নিছক রতিগ্রস্ত কবি কিংবা অমঙ্গলবোধের নবি ভাবিয়া তৃপ্তিলাভ করিতেছিলেন তাঁহারা বোধ হয় কল্পনাও করিতে পারেন নাই অন্যায় ও সাম্রাজ্যবাদকে তিনি কতখানি সমার্থক মনে করিতেন। উদাহরণ দিয়া বলিব, বুদ্ধদেব বসু কিংবা আবু সয়ীদ আইয়ুব যদি জার্মান মহাত্মা বাল্টার বেনিয়ামিনের (Walter Benjamin) লেখা দুই-চারি পাতা পড়িবার সুযোগও পাইতেন কি লঙ্কাকাণ্ডটাই না হইত! (বেনিয়ামিন ২০০৬/খ: ৯; বেনিয়ামিন ১৯৯৭: ২২) আমাদের আলোচ্য ‘হাবিল ও কাবিল’ কবিতায় একই বোদলেয়ারকে দেখিতেছি অনশনবন্দি দুনিয়ার বঞ্চিত লাঞ্ছিত সর্বহারার কবি আকারে।

এক্ষণে একটুখানি বিশদ করিতেছি।

এই যুগের সাম্রাজ্যবাদ যে বিষাদসিন্ধুর অপর নাম সেই বিষাদসিন্ধুর তীরে যাহারা ভবঘুরে, পলাতক অর্থাৎ যাহাদের উচ্ছেদ করা হইয়াছে তাহাদেরই নাম প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা। এই সর্বহারাকে কবিজনোচিত কায়দায় ‘শ্রেণী’ না বলিয়া বোদলেয়ার বলিয়াছেন ‘জাতি’। কার জাতি আর? খোদ কাবিলের জাতি। মাবুদ এই কাবিলের জাতির উপর এতখানি নাখোশ কেন? বোদলেয়ারের বিচারে এই বিরোধ ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধমাত্র নহে। এই বিবাদ বোদলেয়ার বলিবেন দুই শ্রেণীর বিবাদ, যদিও তাঁহার ব্যবহৃত শব্দটি ‘দুই জাতির বিবাদ’। এই প্রবন্ধে ইহাকেই আমি বলিয়াছি দুই বিশ্বের বিবাদ। শার্ল বোদলেয়ার লিখিয়াছেন:
    হাবিলের জাত, ঘুমাও, পিয়ে যাও আর খাও
    দিলখোশ মাবুদের মুখে মিঠা হাসি
    কাবিলের জাত, দাও গড়াগড়ি দাও
    পচা কাদায়, আর দাও নিজের গলায় ফাঁসি।

এই স্থলে দুই জোড়া মাত্র উদ্ধৃতি লিখিলাম। এই রকম ১৬ জোড়া কথা তিনি লিখিয়াছেন এই কবিতায়। এই যুগ সর্বহারার যুগ। যাহার নিজের গতর ছাড়া বেচিবার আর কিছুই নাই তাহাকেই সর্বহারা বলে। সেই সর্বহারাকেই বোদলেয়ার ‘কাবিলের জাত’ জ্ঞান করিয়াছেন।

পুরা কবিতাটি আমি এই রচনার শেষে, সংবর্ধনা অংশে, জুড়িয়া দিয়াছি। (দেখুন, সংবর্ধনা ২) এইখানে শুদ্ধ এইটুকু বলিয়া রাখি, শেষমেশ বোদলেয়ার তাঁহার রায় ঘোষণা করিলেন। বলিলেন: হাবিলের জাত, একদিন তোদের মৃতদেহ এই দুর্গন্ধময় মাটির সার হইবে। আর কাবিলের জাতের কর্তব্য তাহাতেই শেষ হইবে না। যেদিন কৃষকের কাঠের ঠেলা লাঙ্গল আসিয়া হাবিলের জাতির তলোয়ার গুড়াইয়া দিবে সেদিন তাঁহাদের লজ্জা লুকাইবার জায়গাও থাকিবে না। আর কাবিলের জাতিকে তিনি এই উপদেশ দিলেন: যাও, ঊর্ধ্বলোকে আরোহন কর, আর খোদ মাবুদকে ছুঁড়িয়া মার এই দুনিয়ায়! (বোদলেয়ার ১৯৮৬: ২২৯-৩০)


এক্ষণে আমার আলোচ্য দ্বিতীয় কবিতা। বাংলাদেশের শামসুর রাহমান তাঁহার দুঃসময়ে মুখোমুখি (১৯৭৩) বইয়ের একটা কবিতার নাম রাখিয়াছেন ‘স্যামসন’। ইহা তাঁহার শ্রেষ্ঠ কবিতার অষ্টম সংস্করণেও পাওয়া যাইতেছে। শামসুর রাহমান শুদ্ধ গ্রিক পুরাণের সেবাকবি—ইহা পুরাপুরি সত্য নহে। এয়াহুদি পুরাণেও তাঁহার অনাস্থা নাই। ‘স্যামসন’ কবিতা ইহারই প্রমাণ। তবে এই এয়াহুদি কাহিনীর পাঠ তিনি ১৭ শতকের ইংরেজ মনীষী ও বিপ্লবী জন মিল্টনের হাত হইতে লইয়াছেন বলিলে বেশি বলা হইবে না। (মিল্টন ১৯৮২; আসাদ ২০০৭: ৭৫)

এই রকম লওয়ায় তিনি কখনোই কাঁচা ছিলেন না। প্রমাণস্বরূপ তাঁহার অনূদিত ফরাসি কবি পল এলুয়ারের (Paul Eluard) বিখ্যাত ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটির কথা উল্লেখ করা যায়। কয়েক পঙ্‌ক্তি বাদ দিলে অনুবাদকর্মটাকে মোটামুটি বিশ্বস্তই বলা চলিত।

ইংলন্ডের ১৭ শতকিয়া গোঁড়া (Puritan) খ্রিস্টান বিপ্লবী কবি জন মিল্টন পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বিশেষ পুরাতন নিয়মের বিধান কেমন করিয়া আপন করিয়া লইলেন তাহা লইয়া অনেক কথা হইয়াছে। শিমশোনকে এয়াহুদি জাতির মুক্তিদাতা বীরযোদ্ধা জ্ঞান করিয়াই তো কবি মিল্টন তাঁহার সহিত আপন আত্মা মিশাইয়াছেন। এয়ুরোপের সাহিত্যে ইহার ভাব অনেক দূর পর্যন্ত গড়াইয়াছে। ‘গাজায় চক্ষুহীন’ (Eyeless in Gaza) হৃতবল বীরের হইয়া আমাদের কবি শামসুর রাহমানও কম বিলাপ করেন নাই:
    … এখন আমার কাজ
    ঘানি ঠেলা শুধু ভার বওয়া শৃঙ্খলের। পদে পদে
    কেবলি হোঁচট খাই দিন-রাত্রি, তোমরা অটল মসনদে।
    (রাহমান ২০০৯: ১০৬; দেখুন, সংবর্ধনা ৩)

লন্ডনে রাজা ২ নং চার্লসের শাসনাধীন জন মিল্টন নিজেকে ‘গাজায় চক্ষুহীন দাসমণ্ডলে যাঁতাপেষা’ স্যামসনের নিকটাত্মীয় ভাবিবেন, ইহাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু স্যামসন যে আত্মহত্যা করিয়া বিজয় লাভ করিল সেই আত্মহত্যায় নির্বিকার থাকাও তাঁহার পক্ষে সম্ভব হইল। কেমন করিয়া সম্ভব হইল?

এই প্রশ্নের মুখে লা-জওয়াব জনৈক স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী ইংরেজ পণ্ডিত এক পর্যায়ে বলিয়াই ফেলিলেন: ‘শেষ পর্যন্ত মিল্টন বুঝিতে পারিয়াছিলেন তিনি জিতিয়াছেন—এই সত্যে সন্দেহ নাই। কিন্তু এই জিত নীতিশক্তি আর বুদ্ধিশক্তিরই জিত। হারানো বেহেস্ত (Paradise Lost) মহাকাব্যের কবি পরিচয়ে তাঁহার ফিরতি প্রতিষ্ঠার ঘটনায় এই সত্যই কায়েম হইয়াছে।’ (প্রিন্স ১৯৮২: ১৩)

মিল্টনের ‘বিবাদী স্যামসন’ (Samson Agonistes) কবিতাটি কি গ্রিক ট্রাজেডি বা বিধির বিধানের সহিত তুলনীয়?১ উত্তরে ২০ শতকিয়া ইংরেজ মহাত্মা স্যার রিচার্ড জেব (Sir Richard Jebb) কহিয়াছিলেন: কদাচ নহে। স্যামসনের চরিত্র খারাপ ছিল মানে তাঁহার চরিত্রে নারীদোষ বিশেষ ছিল। এই কথা তাঁহার স্বজাতীয় এয়াহুদিরাই বলিতেন। তাই একবার তাঁহারা তাঁহাকে হাত পা বান্ধিয়া শত্রু ফিলিস্তিনিদের হাতে সঁপিয়াও দিয়াছিল।

ইহাকে লোভ-লালসার দোষও বলা চলিত। সাধারণ খ্রিস্টান লোকজন তাঁহার দুর্ভোগের সহিত সচরাচর এই চরিত্রদূষণকে কারণ বলিয়া যোগ করেন। আমরা তাহাতে কী করিয়া আপত্তি করিব? কিন্তু জন মিল্টন তো এই দিকটা উপেক্ষাই করিলেন। তা করুন। স্যামসনের করুণ মৃত্যুসংবাদ বহিয়া আনিবার পর দণ্ডায়মান সাংবাদিকের সমক্ষে কোরাস গ্রিক কায়দায় গাহিলেন:
    Chorus
    O dearly-bought revenge, yet glorious!
    Living or dying thou hast fulfill’d
    The work for which thou wast foretold
    To Israel, and now ly’st victorious
    Among thy slain self-kill’d,
    Not willingly, but tangled in the fold
    Of dire necessity, whose law in death conjoin’d
    Thee with thy slaughter’d foes in number more
    Than all thy life had slain before.
    (Milton, 1982: p. 54, ll. 1660–68)

নিচে ইহার খসড়া বাংলা তর্জমা দিতেছি:
    চড়াদামে কেনা প্রতিশোধ তুমি তবু গরীয়ান!
    জীবিত কি মৃত করিয়াছ পালন
    কর্তব্য তোমার, তোমার অপেক্ষায়
    ছিল এসরায়েল এতদিন, আর এখন বিজয়ে শুয়ে আছ
    আপন হাতের মৃতের সঙ্গী তুমি আত্মঘাতী
    ইচ্ছায় কখনো হও নাই, নিদারুণ দরকারের ফাঁদে
    পড়িয়াছ। ইহারই বিধানে জীবৎকালে যত না
    করিয়াছ হত্যা তাহার অধিক করিলে
    হত তুমি মরণের ক্ষণে
    আর সেই শত্রুসঙ্গে তোমাকেও মাখিল এই বিধি।

কোরাসের গলার ঘরে এই স্বর কার স্বর? কে সে জন? জন মিল্টন না ঈশ্বর? একটু পরই আমরা দেখিব এই স্থির অবিনশ্বর স্বর আর কাহারো নহে, খোদ স্বাধীনতা-ব্যবসায়ীর স্বর ইহা। ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ তারিখে দুনিয়া আবারও শুনিল সেই স্থির স্বর। শামসুর রাহমান তাই আজও অমর।
ইসরায়েলের দিমোনায় অবস্থিত গোপন পারমাণবিক রিয়্যাক্টরের এই ছবি লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয় ১৯৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। দিমোনা রিয়্যাক্টরের নিম্নপদস্থ নিউক্লিয়ার টেকনিশিয়ান মোরদেশাই ভানুনু (Mordechai Vanunu) এই ছবিসহ গোপন নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরের প্রমাণাদি দেন সানডে টাইমস কর্তৃপক্ষকে। এরপর ইসরায়েলের সিক্রেট সার্ভিস তাঁকে লন্ডন থেকে অপহরণ করে রোম হয়ে ইসরাইলে ফেরত নিয়ে যায়। মরক্কোয় জন্ম নেওয়া ইহুদি পিতার সন্তান ভানুনুর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১৮ বছর জেলদণ্ড হয়। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ এই এগারো বছর তাঁকে বন্দি রাখা হয় ৬ বর্গমিটারের একটি সেলে। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগের বিপরীতে ১৯৮৭ সালে আশকেলন জেলখানায় বসে I Am Your Spy শিরোনামে নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন ভানুনু। উল্লেখ্য, ইসরায়েলের বাণিজ্যিক টেলিভিশন সংস্থা চ্যানেল টু ২০০২ সালের ১৮ জানুয়ারি তারিখে সর্বপ্রথম জনসমক্ষে দিমোনা রিয়্যাক্টরের ভয়াবহতা তুলে ধরে। এরপরও কয়েক বছর কারাগারে কাটাতে হয় ভানুনুকে। নজরবন্দি ভানুনু তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে আসছেন। নিচের ছবিটি ১৯৯৯ সালে আদালতে ভানুনুকে হাজির করার দৃশ্য।

বর্তমান যুগের এসরায়েল রাষ্ট্রে শিমশোন ওরফে স্যামসনকে দুর্ধর্ষ এয়াহুদির উদাহরণ বলিয়া পরিচয় দেওয়া হয়। একালের মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়ার শ্রেষ্ঠ সামরিক শক্তি এসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারের নাম রাখা হইয়াছে ‘স্যামসন অপশন’ (The Samson Option) বা স্যামসন কৌশল। শামসুর রাহমান কোনোদিন এই কথা জানিতে পারিয়াছিলেন কিনা তাহা জানিতে আমার বড় সাধ জাগে। (আসাদ ২০০৭: ৭৬)

ইহার মানেও আর কিছুই নহে: ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে।’ দুঃখের মধ্যে, নিজেকে মারিয়া হইলেও শত্রু নিধন করিবার কৌশলের পারমাণবিক সংস্করণের নামই এসরায়েল রাখিয়াছে স্যামসন কৌশল। হাতের চেটোর মতন ছোট্ট এক টুকরা ফিলিস্তিন নামক দেশে এই বোমা ফাটাইলে আপন শত্রুর সঙ্গে খোদ এসরায়েলও ধ্বংস হইবে। এই অকল্পনীয় বর্বরতার সভ্য নামই দাঁড়াইতেছে দি স্যামসন অপশন।

বলা হয়তো বাহুল্য, এই নাম বা এই চিন্তার জন্ম মোটেও ২০০১ সনের ১১ সেপ্টেম্বরের পরে নহে, খানিক আগেভাগেই বটে। ১১ সেপ্টেম্বরের আত্মঘাতী বোমারুদের আমরা যদি সঙ্গত কারণেই ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলিয়া থাকি তবে স্যামসনকে আমরা কোন উপাধি দান করিব?

আজিকালি এসরায়েল রাষ্ট্রের পাঠ্যাপাঠ্য সকল বইতে স্যামসনকে স্বাধীনতা সংগ্রামী কিংবা মুক্তিযোদ্ধা বলিয়াই প্রশংসা করিতে দেখা যায়। শুদ্ধ এসরায়েল কেন, খোদ বিপ্লবী ইংরেজ কবি অন্ধ জন মিল্টনও শেষ বয়সে নিজেকে স্যামসন ভাবিতেন। বন্দি স্যামসনের চক্ষুযুগল শত্রু ফিলিস্তিনিরা উপড়াইয়া লইয়াছিল। আর মিল্টনও অন্ধ হইয়া গেলেন। মিল্টনের পথ ধরিয়া শামসুর রাহমানও কি তাহাই করিলেন? তাঁহারও চক্ষু গেল গেল! ১৯৭৩ সন নাগাদ তিনিও প্রকাশ করিলেন বীরগাথা ‘স্যামসন’। ততদিনে বাংলাদেশ বিদেশি বন্দিশিবির হইতে স্বাধীন স্বদেশ হইয়া দাঁড়াইল। কবি গাহিলেন:
    ক্ষমতামাতাল জঙ্গী হে প্রভুরা ভেবেছো তোমরা,
    তোমাদের হোমরা-চোমরা
    সভাসদ, চাটুকার সবাই অক্ষত থেকে যাবে চিরদিন?
    মৃত এক গাধার চোয়ালে, মনে নেই ফিলিস্তিন,
    দিয়েছি গুঁড়িয়ে কত বর্বরের খুলি? কত শক্তি
    সঞ্চিত আমার দুটি বাহুতে, সেওতো আছে জানা। রক্তারক্তি
    যতই কর না আজ, ত্রাসের বিস্তার
    করুক যতই পাত্র-মিত্র তোমাদের, শেষে পাবে না নিস্তার।
    (রাহমান ২০০৯: ১০৫-০৬)

স্যামসন শব্দটির হিব্রু মূল উচ্চারণ ‘শিমশোন’। অর্থ ‘সূর্যের সন্তান’ বা ইহার কাছাকাছি কিছু। এসরায়েলি পুরাণ অনুসারে ফিলিস্তিনের একাংশের সমুদ্রতীরে যখন প্রাচীন ফিলিস্তিনি জাতি বসবাস করিত তখনো এয়াহুদি জাতির মধ্যে রাজতন্ত্র তথা রাজার পদই চালু হয় নাই। তখন দেশনেতাদের কাজি (হিব্রু ভাষায় ‘সোফেতিম’) উপাধি দেওয়া হইত। আমাদের শিমশোন ওরফে স্যামসন ছিলেন কাজিগণের মধ্যে সর্বশেষ বা ১২ নম্বর। (আসিমব ১৯৮১: ১৪৮-৫৩; ইনসায়িট ১৯৮৮; জোনডেরবান ১৯৬৭)

জন মিল্টন কিংবা শামসুর রাহমান উভয়েই শিমশোনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবেই দেখিয়াছেন। ১৭ শতকের ইংলন্ডে রাজতন্ত্রবিরোধী বিপ্লবের পরাস্ত অর্থাৎ বেহাত অবস্থায়, পুনরুদ্ধারপ্রাপ্ত রাজতন্ত্রের অধীনে—১৬৬৭ সনের পর কোনো এক সময়—মিল্টন তাঁহার ‘বিদ্রোহী স্যামসন’ লিখিয়াছিলেন। ইহা তাঁহার ফিরিয়া পাওয়া বেহেস্ত (Paradise Regained) কাব্যগ্রন্থের তপশিল আকারে প্রথম ছাপা হয়।

শামসুর রাহমানও তাঁহার ‘স্যামসন’ কবিতা লিখিয়া থাকিবেন ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে বা সামান্য পরে।২ আমাদের দুই কবির এক চিন্তার মধ্যে একটা সমস্যা কিন্তু থাকিয়াই যাইতেছে। ইহার দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াই আমি আমার কর্তব্য পালনের চেষ্টা করিব।


শামসুর রাহমান যদি আজও বাঁচিয়া থাকিতেন তো জিজ্ঞাসা করিতাম: ২০০১ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ইয়র্ক শহরে বিমানযোগে হামলা করিয়া যাহারা ৩,০০০ মতন মনুষ্য মারিয়া ফেলিল আর সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও ছাই হইয়া গেল তাহাদিগকে আপনি কি স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মুক্তিযোদ্ধা বলিতে রাজি হইবেন? উত্তর উনি কি দিতেন তাহা আপনারা নিঃসংশয়ে আন্দাজ করিতে পারেন।

সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিতাম: শিমশোনকে তবে আপনি কোন যুক্তিতে মুক্তিযোদ্ধার সম্মান দিতেছেন? তিনিও তো আত্মঘাতী হামলায় একযোগে ৩,০০০ লোক মারিয়াছিলেন। মারেন নাই? অধিক, জীবনকালেও তিনি লোক মারিতেন। ইহা তাঁহার এক প্রকার পেশা ছিল বলিলে কি অত্যুক্তি হইবে? পবিত্র ধর্মগ্রন্থ নবিদের কিতাবেও কি একই কথা লেখা নাই? আছে: ‘তিনি জীবনকালে যত লোক হত্যা করিয়াছিলেন, মরণকালে তদপেক্ষা অধিক লোককে হত্যা করিলেন।’ (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৬: ৩০)

কথাটা মহাত্মা শামসুর রাহমানও আমল করিয়াছেন। ‘স্যামসন’ কবিতায় স্যামসনের স্বগতোক্তিযোগে আমরা তাই পড়িতে পাই:
    আমার দুরন্ত কেশরাজি পুনরায় যাবে বেড়ে,
    ঘাড়ের প্রান্তর বেয়ে নামবে দুর্দমনীয়, তেড়ে
    আসা নেকড়ের মতো। তখন সুরম্য প্রাসাদের সব স্তম্ভ
    ফেলবো উপড়ে, দেখো কদলী বৃক্ষের অনুরূপ। দম্ভ
    চূর্ণ হবে তোমাদের, সুনিশ্চিত করবো লোপাট
    সৈন্য আর দাস-দাসী অধ্যুষিত এই রাজ্যপাট।
    (রাহমান ২০০৯: ১০৭)

শিমশোনের জীবনচরিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বয়ান অনুযায়ী যাঁহারা পড়িবেন তাঁহারাই তাঁহাকে পুরাদস্তুর ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলিবেন। অথচ শামসুর রাহমান কোথাও ইহার আভাসমাত্র দিয়াছেন বলিয়া আমার মনে হইল না। ইহা কী করিয়া সম্ভব?
শামসুর রাহমান (জন্ম. ঢাকা ২৪/১০/১৯২৯ - মৃত্যু. ঢাকা ১৭/৮/২০০৬); ছবি. হাসান বিপুল

সম্ভব—কারণ আমরা যাহা পড়ি তাহা হয়তো পড়ি নেহায়েত শব্দের ঝঙ্কারে, শব্দেরই প্রেমে পড়িয়া। সত্য স্পর্শ করিয়া হাত ময়লা করিব কোন দুঃখে? অর্থ লইয়া মাথা ঘামাইতে যাইব কেন? এই গুণ শুদ্ধ শামসুর রাহমানের নহে, এই গুণ আমাদের সকলের—আমরা যাহারা কাবিলের জাত হইয়াও হাবিলের অভিনয় করিতেছি তাহাদের সকলের। আমাদের নাম তাই ইংরেজি বাক্যে ‘লিবারেল’। লিবারেলের বাংলা সচরাচর করা হয় ‘উদারনৈতিক’। আমি সবিনয়ে বলিব: ইহার অনুবাদ করিবেন ‘স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী’। সেই ক্রমে লিবারেলিজম মানে দাঁড়াইবে ‘স্বাধীনতা-ব্যবসায়’। শামসুর রাহমানও কি তবে লিবারেল অর্থাৎ স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী কবি? দুর্ভাগ্যের মধ্যে আমাকে হ্যাঁ উত্তরই দিতে হইতেছে। সাম্রাজ্যবাদের যুগে—আমাদের বড় দুর্ভাগ্য—এই জাতের কবিরাই প্রধান। তাই তাঁহাদের বাড়ি ঢাকায় হইলেও তাঁহারা প্রথম বিশ্বেরই কবি—তাঁহারা হাবিলের জাত।

শিমশোনের গল্পটা দিয়াই আমি আমার এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের সংহার ঘটাইব। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ লিখিতেছেন:
    আর শিমশোন তিম্নায় নামিয়া গেলেন, ও তিম্নায় ফিলিস্তিনীদের কন্যাদের মধ্যে একটি রমণীকে দেখিতে পাইলেন। পরে ফিরিয়া আসিয়া আপন পিতামাতাকে খবর দিয়া বলিলেন, আমি তিম্নায় ফিলিস্তিনীদের কন্যাদের একটি রমণীকে দেখিয়াছি; তোমরা তাহাকে আনিয়া আমার সহিত শাদী দাও। তখন তাঁহার পিতামাতা তাঁহাকে বলিলেন, তোমার জ্ঞাতিগণের মধ্যে ও আমার সমস্ত স্বজাতির মধ্যে কি কন্যা নাই যে, তুমি খত্নাবিহীন ফিলিস্তিনীদের কন্যা শাদী করিতে যাইতেছ? শিমশোন পিতাকে বলিলেন, তুমি আমার জন্য তাহাকেই আনাও, কেননা আমার দৃষ্টিতে সে মনোহরা। (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৪: ১-৩)

বিবাহ করিতে যাইবার পথে তিম্নার আঙ্গুর ক্ষেত্রে শিমশোন একটা যুবা সিংহ দেখিতে পাইলেন। মাবুদের রুহুর জোরে হাতে কিছু না থাকিলেও শিমশোন ছাগলের বাচ্চা ছিঁড়িবার মতন ঐ সিংহকে ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। বিবাহের আসরে তিনি বাজি ধরিয়া একটি ধাঁধা বলিয়াছিলেন। ইহার সঠিক উত্তর শুদ্ধ তাঁহার স্ত্রী ছাড়া আর কেহ জানিতেন না। কিন্তু এই ধাঁধার উত্তর তাঁহার হবু স্ত্রীর মুখ হইতে গোপনে জানিয়া লইবার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা তাঁহাকে অপ্রস্তুত করিয়াছিল। ইহাতে তাঁহার হবু স্ত্রীও দোষী ছিলেন। তাই নিরুপায় শিমশোন হার স্বীকার করিয়া লইলেন। আর বিবাহ করিব না বলিয়া আসর হইতে উঠিয়া গেলেন।

ইহার পর ক্রুদ্ধ শিমশোন অস্কিলোন নামক জায়গায় গিয়া ৩০ জন লোককে অকারণে আঘাত করিয়া তাহাদের বস্ত্র খুলিয়া লইলেন আর সেই বস্ত্র দিয়া ধাঁধার বাজিতে হারিয়া যাওয়ার টাকা পরিশোধ করিলেন। তিনি বউ ফেলিয়া চলিয়া যাইবার পর আর আসিবেন না মনে করিয়া তাঁহার হবু বউকে অন্য একজনের সহিত বিবাহ দেওয়া হইল।

কিছুকাল পর গম কাটার সময় শিমশোন ফিরিয়া আসিলেন। আসিয়া স্ত্রীর সঙ্গ দাবি করিলেন। তাঁহাকে অনুরোধ করা হইল, তিনি যেন স্ত্রীর ছোট বোনকে বিবাহ করেন। তিনি রাজি হইলেন না। পাল্টা এতদিনে স্ত্রী পরস্ত্রী হইয়া গিয়াছে শুনিয়া এক মহাকাণ্ড করিলেন। ধর্মগ্রন্থ লিখিতেছেন:
    পরে শিমশোন গিয়া তিন শত শৃগাল ধরিয়া মশাল লইয়া তাহাদের লেজে লেজে যোগ করিয়া দুই দুই লেজে এক একটি মশাল বাঁধিলেন। পরে সেই মশালে আগুন দিয়া ফিলিস্তিনীদের শস্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দিলেন; তাহাতে বাঁধা আটি, ক্ষেতের শস্য ও জলপাই গাছের বাগান সকলই পুড়িয়া গেল। (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৫: ৪-৫)

ততক্ষণে ক্রুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা তাঁহার হতভাগিনী স্ত্রী ও স্ত্রীর পিতা মহাশয়কে আগুনে পুড়াইয়া মারিল। আর শিমশোন তাহাদিগকে আঘাত করিলেন। তখন তাঁহার স্বজাতি লোকেরা তাঁহাকে বাঁধিয়া ফিলিস্তিনিদের হাতে সমর্পণ করে। বাঁধন দুই গাছা নতুন দড়ি।
    … তখন মাবুদের রূহ্ সবলে তাহার উপরে আসিলেন, আর তাঁহার দুই বাহুস্থিত দুই দড়ি আগুনে পোড়া শণের ন্যায় হইল, এবং তাঁহার দুই হাত হইতে বেড়ি খসিয়া পড়িল। পরে তিনি একটি গাধার চোয়ালের হাড় দেখিতে পাইয়া হাত বিস্তারপূর্বক তাহা লইয়া তাহা দ্বারা হাজার লোককে আঘাত করিলেন। আর শিমশোন বলিলেন, ‘গাধার চোয়ালের হাড় দ্বারা রাশির উপরে রাশি হইল, গাধার চোয়ালের হাড় দ্বারা হাজার জনকে হানিলাম।’ (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৫: ১৪-১৬)

শিমশোনের এই আবিল বীরত্বের বন্দনাই শুনি কবি শামসুর রাহমানের অনাবিল কণ্ঠে। আগেই উদ্ধার করিয়াছি কবির কথা:
    মৃত এক গাধার চোয়ালে, মনে নেই ফিলিস্তিন,
    দিয়েছি গুঁড়িয়ে কত বর্বরের খুলি? কত শক্তি
    সঞ্চিত আমার দুটি বাহুতে, সেওতো আছে জানা। রক্তারক্তি
    যতই কর না আজ,…
    (রাহমান ২০০৯:১০৫-০৬)

পাঠিকা বিশ্বাস করিবেন কিনা জানি না, তবু বলিব: এই নিবন্ধে হাত দিবার আগে আমি কিন্তু কদাচ খেয়াল করি নাই শামসুর রাহমান নামটির অর্থও প্রকারান্তরে এই শিমশোন ওরফে স্যামসনই। ‘দয়াময়ের সূর্য’ আর ‘সূর্যের সন্তান’—কি এমন দূরত্ব! দূরত্বের মধ্যে ঐ এক মিল্টনই।

ইংলন্ডের পীড়িত অন্ধ কবির দৃষ্টিতে শিমশোন বীর হইবেন সন্দেহ নাই। ১৯৭১ সনের বাংলাদেশের একজন বাঙালি কবিও সেই দৃষ্টির চক্ষু ধার লইলেন কেন? ইহার পরীক্ষাই আমাদের প্রার্থনীয়।


খ্রিস্টানি পরম্পরায় কাজি শিমশোনকে কিছু পরিমাণে নৈতিক স্খলনের দোষে দোষী করিবার রেওয়াজও আছে। ইহা আমরা কিছু আগেই দেখিয়াছি। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মহত্যা করিয়া সেই পাপ হইতে মুক্ত হইলেন। দেশবাসী তাহাঁকে বীর মুক্তিযোদ্ধার, বীরশ্রেষ্ঠের সম্মান জানাইল। তাঁহার সন্ত্রাসবাদ লইয়া কেহ বেশি উচ্চবাচ্য করিল না।

আধুনিক ধনতন্ত্রের ধনী দোসর ‘স্বাধীনতা-ব্যবসায়’ ওরফে লিবারেলিজম। এই ব্যবসায়ের ব্যবসায়ীরাও সন্ত্রাসী শিমশোনকে মুক্তিসংগ্রামীর মর্যাদা দিতেছেন। ঘন ঘন—প্রায় বাতিকগ্রস্থের মতন—বেশ্যাগমনের সহিত স্বাধীনতা-ব্যবসায়ের সম্পর্ক একটা থাকিলেও থাকিতে পারে। সেই সম্পর্ক কী আমরা কিন্তু জানি না। তবে আত্মঘাতী বোমাবাজ ওরফে আদমবোমারুও যে শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা-ব্যবসায়েরই অন্তর্গত সেই সত্য আমরা এতদিনে অনুধাবন করিতে পারিতেছি। আরব নৃতত্ত্ব-বিজ্ঞানী মহাত্মা তালাল আসাদের একটি বক্তৃতায় তাহার আভাস পাওয়া যায়। (আসাদ ২০০৭: ৬৫-৯৬; দেখুন, প্রবন্ধ ৪)

শিমশোন অমিতবিক্রম বীর এই সত্যে আমার সন্দেহ নাই। সাক্ষী পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কহিতেছেন:
    আর শিমশোন গাজাতে গিয়া সেখানে একটা বেশ্যাকে দেখিয়া তাহার কাছে গমন করিলেন। তাহাতে, শিমশোন এই স্থানে আসিয়াছে, এই কথা শুনিয়া গাজানিবাসীরা তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া সমস্ত রাত্রি তাঁহার জন্য নগর দ্বারে লুকাইয়া থাকিল, সমস্ত রাত্রি চুপ করিয়া রহিল, বলিল, সকালে দিন হইলে আমরা তাঁহাকে কতল করিব। কিন্তু শিমশোন মাঝরাত পর্যন্ত শয়ন করিলেন, মাঝরাতে উঠিয়া তিনি নগর-দ্বারের শিকলশুদ্ধ দুই কবাট ও দুই বাজু ধরিয়া উপড়াইয়া ফেলিলেন এবং স্কন্ধে করিয়া হিব্রোণের সম্মুখস্থ পর্বত-শৃঙ্গে লইয়া গেলেন। (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৬: ১-৩)

শিমশোনের প্রেমের শেষ নাই। তবে এই প্রেমই শেষ পর্যন্ত তাঁহাকে শেষ করিল। তাঁহার সর্বশেষ প্রেমিকার নাম দলীলা। পণ্ডিতেরা কহিতেছেন শিমশোন মানে যেমন সূর্য (অর্থাৎ দিবা) তেমনি দলীলা (ওরফে লীলা ওরফে লায়লা) মানেও রাত্রি। (আসিমব ১৯৮১: ২৫১; ইনসায়িট ১৯৮৮; জোনডেরবান ১৯৬৭)

রাত্রির নিকট সূর্য যেমন দলীলার নিকট শিমশোনও তেমন। একদিন প্রেমিকা দলীলার পীড়াপীড়িতে তিনি ধরা দিলেন। তাঁহার অমিততেজের গোপন কথা ফাঁস হইয়া গেল। শ্রীমতি দলীলা নিজের হাঁটুর উপর তাঁহাকে ঘুম পাড়াইয়া লোক দিয়া তাঁহার সাত গুচ্ছ চুল কামাইয়া দিল। শিমশোন দুর্বল হইলেন।
    তাই তিনি মনের সমস্ত কথা ভাঙ্গিয়া বলিলেন, তাহাকে বলিলেন, আমার মস্তকে কখনও ক্ষুর উঠে নাই, কেননা মাতার গর্ভ হইতে আমি আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে নাসরীয় [উৎসর্গিত]; চুল কামাইলে আমার বল আমাকে ছাড়িয়া যাইবে, এবং আমি দুর্বল হইয়া অন্য সকল লোকের সমান হইব। (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৬: ১৭)

তখন ফিলিস্তিনিরা তাঁহাকে ধরিয়া তাঁহার দুই চক্ষু উঠাইয়া ফেলিল, এবং তাঁহাকে গাজায় আনিয়া পিতলের দুইটি শিকলে বাঁধিল। তিনি কয়েদখানায় যাঁতা পেষণ করিতে লাগিলেন।

শামসুর রাহমান দেখি শিমশোনের দুঃখে তাঁহার চাইতেও বেশি কাতর। কয়েদখানার যাঁতা বন্দির প্রাণের চেয়ে কবির প্রাণকেই যেন বেশি পেষণ করিতেছে। কবি লিখিতেছেন:
    আমাকে করেছো বন্দী, নিয়েছো উপড়ে চক্ষুদ্বয়।
    এখন তো মেঘের অঢেল স্বাস্থ্য, রাঙা সূর্যোদয়
    শিশুর অস্থির হামাগুড়ি, রক্তোৎপল যৌবন নারীর আর
    হাওয়ায় স্পন্দিত ফুল পারি না দেখতে। বার বার
    কী বিশাল দৃষ্টিহীনতায় দৃষ্টি খুঁজে মরি। সকাল সন্ধ্যার
    ভেদ লুপ্ত; মসীলিপ্ত ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষে চকিতে মন্দার
    জেগে উঠলেও অলৌকিক শোভা তার থেকে যাবে নিস্তরঙ্গ
    অন্তরালে। এমন-কি ইঁদুরও বান্ধব অন্তরঙ্গ
    সাম্প্রতিক, এমন নিঃসঙ্গ আমি নিজ দোষে আজ
    চক্ষুহীন, হৃতশক্তি; দুঃস্বপ্নপীড়িত। এখন আমার কাজ
    ঘানি ঠেলা শুধু ভার বওয়া শৃঙ্খলের। পদে পদে
    কেবলি হোঁচট খাই দিন-রাত্রি, তোমরা অটল মসনদে।
    শত্রু-পরিবৃত হয়ে আছি, তোমাদের চাটুকার
    উচ্ছিষ্ট-কুড়ানো সব আপনি-মোড়ল, দুস্থ ভাঁড়
    সর্বদাই উপহাস করছে আমাকে। দেশবাসী
    আমাকে বাসেতো ভালো আজো—যাদের অশেষ দুঃখে কাঁদি হাসি
    আনন্দে? পিছনে ফেলে এসেছি কত যে রাঙা সুখের কোরক,
    যেমন বালক তার মিষ্টান্নের সুদৃশ্য মোড়ক।
    আমাকে করেছো অন্ধ, যেন আর নানা দুষ্কৃতি
    তোমাদের কিছুতেই না পড়ে আমার চোখে। স্মৃতি
    তাও কি পারবে মুছে দিতে? যা দেখেছি এতদিন—
    পাইকারি হত্যা দিগি¦দিক রমণীদলন আর ক্ষান্তিহীন
    রক্তাক্ত দস্যুতা তোমাদের, বিধ্বস্ত শহর, অগণিত
    দগ্ধ গ্রাম, অসহায় মানুষ, তাড়িত, ক্লান্ত; ভীত
    —এই কি যথেষ্ট নয়? পারবে কি এ-সব ভীষণ
    দৃশ্যাবলি আমূল উপড়ে নিতে আমার দু-চোখের মতন?
    দৃষ্টি নেই, কিন্তু আজো রক্তের সুতীব্র ঘ্রাণ পাই,
    কানে আসে আর্তনাদ ঘন-ঘন, যতই সাফাই
    তোমরা গাও না কেন, সব-কিছু বুঝি ঠিকই। ভেবেছো এখন
    দারুণ অক্ষম আমি, উদ্যানের ঘাসের মতন
    বিষম কদম-ছাঁটা চুল। হীনবল, শৃঙ্খলিত
    আমি, তাই সর্বক্ষণ করছো দলিত।
    (রাহমান ২০০৯: ১০৬-০৭)

তবে কোনো কথাই এই দুনিয়ায় শেষ কথা নহে। দিনের সূর্য রাতে অন্ধ হয়, তাহার চক্ষু উঠাইয়া ফেলে। সেই সূর্যই সকালবেলা আবার ফিরিয়া আসে। ধীর ধীরে তাহার আলোকরশ্মি তেজীয়ান হইতে থাকে। শিমশোনের চুলও গজাইল এবং গজাইলে তাঁহার হৃতশক্তিও আবার ফিরিয়া আসিল।

ইহা ‘ক্ষমতামাতাল জঙ্গী প্রভুরা’ আমল করেন নাই। ইহাতেই শিমশোন তাঁহার শেষ বীরত্ব (অথবা সন্ত্রাস) দেখাইবার সুযোগ পাইলেন। পরে কোনো একদিন ফিলিস্তিনি ভূপালেরা নিজেদের দেবতা দাগোনের উদ্দেশ্যে মহাযজ্ঞ ও আমোদ প্রমোদ করিতে একত্র হইলেন। তাঁহাদের অন্তঃকরণ প্রফুল্ল হইলে তাঁহারা বলিলেন: শিমশোনকে ডাক, সে আমাদের কাছে কৌতুক করুক।
    … তাহাতে লোকেরা কয়েদখানা হইতে শিমশোনকে ডাকিয়া আনিল, আর তিনি তাহাদের সামনে কৌতুক করিতে লাগিলেন। তাহারা স্তম্ভ সকলের মধ্যে তাঁহাকে দাঁড় করাইয়াছিল। পরে যে বালক হাত দিয়া শিমশোনকে ধরিয়াছিল, তিনি তাহাকে বলিলেন, আমাকে ছাড়িয়া দাও, যে দুই খামের উপরে ঘরের ভর আছে, তাহা আমাকে স্পর্শ করিতে দাও; আমি উহাতে হেলান দিয়া দাঁড়াইব। পুরুষে ও স্ত্রীলোকে সেই ঘর পরিপূর্ণ ছিল, আর ফিলিস্তিনীদের সমস্ত ভূপাল সেখানে ছিলেন, এবং ছাদের উপরে স্ত্রী পুরুষ প্রায় তিন হাজার লোক শিম্শোনের কৌতুক দেখিতেছিল। (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৬: ২৫-২৭)

শিমশোন প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। ‘তখন শিমশোন মাবুদকে ডাকিয়া বলিলেন, হে খোদাবন্দ মাবুদ, মেহেরবানী করিয়া আমাকে স্মরণ করুন; হে আল্লাহ্, মেহেরবানী করিয়া কেবল এই একটি বার আমাকে বলবান করুন, যেন আমি ফিলিস্তিনীদিগকে আমার দুই চোখের জন্য একেবারেই প্রতিশোধ দিতে পারি।’ (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৬: ২৮)
    পরে শিমশোন, মধ্যস্থিত যে দুই খামের উপরে ঘরের ভার ছিল, তাহা ধরিয়া তাহার একটির উপরে ডান বাহু দ্বারা, অন্যটির উপরে বাম বাহু দ্বারা নির্ভর করিলেন। আর ফিলিস্তিনীদের সহিত আমার প্রাণ যাক, ইহা বলিয়া শিমশোন নিজের সমস্ত বলে নত হইয়া পড়িলেন; তাহাতে ঐ ঘর ভূপালগণের ও যত লোক ভিতরে ছিল, সমস্ত লোকের উপরে পড়িল; এইরূপে তিনি জীবনকালে যত লোক হত্যা করিয়াছিলেন, মরণকালে তদপেক্ষা অধিক লোককে হত্যা করিলেন। (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৬: ২৯-৩০)

নির্জলা হত্যা করা কিংবা নিজে হত হইয়া অপরকে হত্যা করা কোনটাই শেষ কথা নহে। আমরা যাহারা এই গল্প পড়িলাম বা শুনিলাম তাহারা পড়িয়া শুনিয়া কী করিব শেষ কথা তাহাই। পবিত্র ধর্মগ্রন্থের লেখকও এই ঘটনায় আপনকার প্রীতি কিংবা সন্তোষ গোপন করিতে পারেন নাই। তাঁহার চোখও শিমশোনের ভাইবেরাদরের চোখই। তিনি জানাইতেছেন: ‘পরে তাঁহার ভাইয়েরা ও তাঁহার সমস্ত পিতৃকুল নামিয়া আসিয়া তাঁহাকে লইয়া সরা ও ইষ্টায়োলের মধ্যস্থানে তাঁহার পিতা মানোহের গোরস্তানে তাঁহাকে দাফন করিল। তিনি বিশ বৎসর ইস্রায়েলের আচার বিচার করিয়াছিলেন।’ (কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই: ‘কাজীগণের বিবরণ,’ ১৬: ২৮) ১৬: ৩১)


আমার এখনো বাকশক্তি গজায় নাই যে বলিব এই ঘটনার অর্থ ষোল আনা বুঝিয়াছি। শিমশোন জীবনকালে অনেক লোককে হত্যা করিয়াছিলেন, আর মরণকালেও তদপেক্ষা অধিক লোক হত্যা করিলেন। এই অধিক—মানে ৩,০০০—লোকের মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী উভয় জাতির লোকই ছিল। অথচ ইহাতে আমাদের স্বাধীনতা-ব্যবসায়ী কবিদের কেহই সামান্যতম কাঁপিয়া উঠিয়াছেন কি? না মিল্টন না রাহমান—কেহই ওঠেন নাই।

যদি না উঠিয়া থাকেন তবে অনুমান করিব: আত্মঘাতী হত্যাকাণ্ডে, পুরুষ-স্ত্রী নির্বিশেষ হত্যায়—তাঁহাদেরও অনুমোদন মিলিয়াছে বৈ কি! আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্তু স্বদেশ ও স্বজাতি (কেহ কেহ বলিবেন স্বধর্ম বা স্ব-আদর্শ) রক্ষা করিতে হইলে স্বপ্রাণ নিধনও শ্রেয়।

আলায়হেসসালাম হজরত ইসার জন্মের ১,০০০ বৎসর আগের এই মহাত্মা কাজি শিমশোনের আত্মহত্যার বিনিময়ে ফিলিস্তিনি মরিয়াছিলেন অন্যূন ৩,০০০। আর এই ঘটনার আনুমানিক ৩,০০০ বৎসর পর ২০/২২ জন আরব্য বোমাবাজের প্রাণের বিনিময়ে আবারও মার্কিন নারী-পুরুষ মিলিয়া লোক মরিল কিছু কম ৩,০০০। ফিলিস্তিনি বাড়ির বড় খাম ছিল দুইটা, বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের বড় খাম বা দালানও (Twin Tower) ছিল সেই দুইটাই। আশ্চর্য!

সংখ্যার এই মিল কেন? সত্য বলিতে কাহারও ইহার উত্তর জানা নাই। থাকিলে বলিবেন বলিয়াই আশা করি। ৪, ৭ কিংবা ১৩ প্রভৃতি সংখ্যা কেন অশুভ বলিয়া গণিত হয়? ইহার জবাব খুঁজিতে হইবে ৩, ৬, কিংবা ১২ সংখ্যার মধ্যেই। শিমশোন কেন ১২ নম্বর কাজি তাহা কেহ বলিবেন কি? এখানে ১২ মানে শেষ কাজি।

কিতাবুল মোকাদ্দস গ্রন্থের ‘পয়দায়েশ’ কিতাবে লেখা হইয়াছে, মাবুদ মোট ৬ দিনে এই দুনিয়া সৃষ্টি করিলেন। কেহ বলিবেন কি তিনি কেন ৫ কিংবা ৭ দিনে করিলেন না? আর ৭ দিনের দিন তিনি বিশ্রাম গ্রহণ করিলেন। ঠিক আছে। কেন ৬ দিনের দিন বা ৮ দিনের দিন করিলেন না?

৩৬৫ কিংবা ৩৬৬ দিনে বৎসর হয়। মাস হয় ২৮, ২৯ কিংবা ৩০ দিনে। ৩১ এমনকি কখনো কখনো ৩২ দিনেও হয়। কেহ বলিবেন কি সপ্তাহ কেন ৭ দিনে হয়? ফরাসি তত্ত্বজ্ঞানী জাক লাকাঁ বলিতেন, অজ্ঞান ৬ পর্যন্ত গুণিতে জানে। কে জানে ইহার কী অর্থ?

৩,০০০ সংখ্যা ৩,০০০ বৎসর পর আবারও ৩,০০০। একবার ৩,০০০ মুক্তিযোদ্ধার, আরবার ৩,০০০ সন্ত্রাসবাদীর। কারণ কী? ইহার উত্তর সাম্রাজ্যবাদের যুগে দুই বিশ্বের কবিতায় খুঁজিয়া কোথাও পাইলাম না।

এই দুঃখ রহিয়াই গেল।

***

বিখ্যাত মার্কিন সমালোচনা ব্যবসায়ী ফ্রেডরিক জেমিসন (Fredric Jameson) একদা দাবি করিয়াছিলেন বহুজাতীয় ধনতন্ত্রের জমানায় তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য প্রথম বিশ্বের সাহিত্য হইতে আলাদা প্রকৃতির মাল হইয়া গিয়াছে। তাঁহার মতে, জাতীয়তাবাদ জিনিসটা মোটেও ভালো মাল নহে তবে তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য এক প্রকার না আর প্রকারের জাতীয়তাবাদ ছাড়া চলিতেই পারে না। সুতরাং এই বহুনিন্দিত জাতীয়তাবাদ ব্যবসায়টাকে অবিমিশ্র মন্দ জিনিসও বলা যাইতেছে না।

জেমিসনের কথার মধ্যে সত্য দুই আনাও নাই—তাহা বলিতেছি না। তবে এই পর্যন্তই। আরো আগাইয়া তিনি বলিয়াছেন আসলে এই দুনিয়ায় প্রভু ও ভৃত্য ছাড়া আর কিছুই নাই। সুতরাং দুইয়ে মিলিয়া দুনিয়া একটাই। জেমিসনের এই কথা যদি সত্য হয় তো স্বীকার করিতে হইবে, তৃতীয় বিশ্ব বলিয়া কোনো আলাদা মাল নাই।
হাবিলের দেহ খুঁজে পেল আদম আর হাওয়া (১৮২৬), শিল্পী: উইলিয়াম ব্লেইক (William Blake; জন্ম. লন্ডন ২৮/১১/১৭৫৭ - মৃত্যু. লন্ডন ১২/৮/১৮২৭)

জার্মান মহাত্মা হেগেলের নাম ভাঙ্গাইয়া জেমিসন বলেন, প্রভু ছাড়া ভৃত্যের যেমন চলিবে না, তেমনি ভৃত্য ছাড়াও প্রভুর প্রভুত্ব কায়েম হইবে না। ইহাই সত্য। কিন্তু এক জায়গায় আসিয়া এই সত্য উল্টাইয়া পড়িতেছে। খোদ হেগেলই এই সত্যের আবিষ্কারক। তিনি বলিয়াছিলেন, এই দুনিয়া প্রভুর এবং ভৃত্যের বটে। কিন্তু শেষ বিচারে এই দুনিয়া শুদ্ধ ভৃত্যেরই। কারণ যে সব করে সে-ই সব জানে। ভৃত্য বা শ্রমিক সব করে তাই সে-ই সব জানে। অলস প্রভুর ভৃত্য ছাড়া চলিবে না। কিন্তু চলিতে ফিরিতে যে জ্ঞান না হইলেই নয় তাহার নাম অজ্ঞান। তাহা শুদ্ধ ভৃত্যের অধিকারে। কারণ সব রসুনের এক গোড়া। সেই গোড়ার নাম মানুষের শ্রম, শ্রমিকশ্রেণীর মেহনত। (জেমিসন ২০০১: ৩৩৫-৩৬)

জেমিসনের মতে তৎকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের’ সাহিত্য ব্যক্তি মানুষের গল্প বলিতে একেবারেই অপারগ, একান্তই অক্ষম। ব্যক্তির কথা বলিতে বলিতে সে অজান্তে কেবল জাতির গল্পই বলিয়া বসে। উদাহরণের ছলে তিনি চিনের মহান লেখক লু সুন (Lu Xun) আর সেনেগালের সেম্বেনে ওসমানের (Sembene Ousmane) কথা পাড়িয়াছেন। আমরা ফরাসি শার্ল বোদলেয়ার আর বঙ্গীয় শামসুর রাহমানের দৃষ্টান্তযোগে দেখাইলাম জেমিসনের বক্তব্য সত্য না-ও হইতে পারে। তাঁহার বিশ্ববিভাজন, ‘তিন দুনিয়া পৃথক্করণের তত্ত্ব’ বাসি হইয়াছে। ইহা অজ্ঞান হইলে আরো ভয়াবহ। বর্ণবাদের গাঢ় প্রলেপ তাহার গায়ে লাগিয়াছে।

পাক-ভারতীয় ধুরন্ধর এজাজ আহমদ (Aijaj Ahmad) লিখিয়াছেন, একই কারণে কোনো দেশের সাহিত্যকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিশ্বের বলিয়া আলাদা করাটা বর্ণবাদের অর্থাৎ পুরাতন উপনিবেশবাদের জের। জেমিসন মার্কিন জাতীয়তাবাদীর মতন লিখিলেও লোকে ভাবে তিনি বুঝি মার্কস ব্যবসায়ীও বটেন। এজাজ আহমদ তাঁহার মুখোশ কিছু পরিমাণে আলগা করিয়া দিয়াছেন। (আহমদ ১৯৯৫: ৯৫-১১২)

দুনিয়ার সকল দেশের ভাষাতেই দুই বিশ্বের সাহিত্য গড়িয়া উঠিতেছে। আমেন।

জাতীয় কবিতা পরিষদের সেমিনারে পঠিত ‘জাতীয় কবিতা উৎসব,’ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৯
==============================


সংবর্ধনা ১

Abel et Caïn

Charles Baudelaire

I
Race d’Abel, dors, bois et mange;
Dieu te sourit complaisamment.
Race de Caïn, dans la fange
Rampe et meurs misérablement.
Race d’Abel, ton sacrifice
Flatte le nez du Séraphin!
Race de Caïn, ton supplice
Aura-t-il jamais une fin?
Race d’Abel, vois tes semailles
Et ton bétail venir à bien;
Race de Caïn, tes entrailles
Hurlent la faim comme un vieux chien.
Race d’Abel, chauffe ton ventre
À ton foyer patriarcal;
Race de Caïn, dans ton antre
Tremble de froid, pauvre chacal!
Race d’Abel, aime et pullule!
Ton or fait aussi des petits.
Race de Caïn, cœur qui brûle,
Prends garde à ces grands appétits.
Race d’Abel, tu croîs et broutes
Comme les punaises des bois!
Race de Caïn, sur les routes
Traîne ta famille aux abois.

II
Ah! race d’Abel, ta charogne
Engraissera le sol fumant!
Race de Caïn, ta besogne
N’est pas faite suffisamment;
Race d’Abel, voici ta honte:
Le fer est vaincu par l’épieu!
Race de Caïn, au ciel monte,
Et sur la terre jette Dieu!

……………
Les Fleurs du mal, 1857

সংবর্ধনা ২

হাবিল ও কাবিল
শার্ল বোদলেয়ার


হাবিলের জাত, ঘুমাও, পিয়ে যাও আর খাও
দিলখোশ মাবুদের মুখে মিঠা হাসি
কাবিলের জাত, দাও গড়াগড়ি দাও
পচা কাদায়, আর দাও নিজের গলায় ফাঁসি।
হাবিলের জাত, তোর লোবান আতরদান
নজরান সুড়সুড়ি দেয় ফেরেশতার নাকে!
কাবিলের জাত, তোর যাতনার অবসান
কখনো হবে না হাজার কাতর ডাকে?
হাবিলের জাত, তোর মাঠের ধান বাড়ে
মোটা তাজা হয় তোর গরু যত
কাবিলের জাত, তোর পেটের ভোক ঘাড়ে
খালি কঁকায় নেড়ি কুত্তার মত।
হাবিলের জাত, চোদ্দপুরুষের চুলা জ্বেলে
পোহা রে আগুন, গতর তাতা
কাবিলের জাত, মাটির তলায় গর্ত মেলে
কাঁপ তোরা, গায় দে খেকশিয়ালের কাঁথা!
হাবিলের জাত, প্রেমে মশগুল হ, বাড়া!
ঝাড়বংশ, বাড়া রে সোনাদানা।
কাবিলের জাত, হে প্রাণ পোড়া
প্রেম করতে তোর মানা।
হাবিলের জাত গাল ফোলা পেট খোলা
খেয়ে খেয়ে যেমন ফোলে ঘূণপোকা!
কাবিলের জাত, পথে পথে বস পথভোলা
সংসার তোর পথে বসা হে বোকা।


আহা, হাবিলের জাত, একদা তোর লাশ
করবে সবুজ পোড়া ছারখার জমিন!
কাবিলের জাত কাজ তোর নাগপাশ
আজও হয় নাই ছেঁড়া, জীবন কি সঙ্গিন
হাবিলের জাত, তোর লাজ ঢাকবে কে আজ
লোহা খান খান হবে যে চেলাকাঠে!
কাবিলের জাত, উঠ আসমানে আসমানবাজ
যা মাবুদরে ঠেলে ফেল এই দুনিয়ার মাঠে!

……………
অনুবাদ: সলিমুল্লাহ খান, জাতীয় কবিতা উৎসব; ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৯

সংবর্ধনা ৩

স্যামসন
শামসুর রাহমান

ক্ষমতামাতাল জঙ্গী হে প্রভুরা ভেবেছো তোমরা,
তোমাদের হোমরা-চোমরা
সভাসদ, চাটুকার সবাই অক্ষত থেকে যাবে চিরদিন?
মৃত এক গাধার চোয়ালে, মনে নেই ফিলিস্তিন,
দিয়েছি গুঁড়িয়ে কত বর্বরের খুলি? কত শক্তি
সঞ্চিত আমার দুটি বাহুতে, সেওতো আছে জানা। রক্তারক্তি
যতই কর না আজ, ত্রাসের বিস্তার
করুক যতই পাত্র-মিত্র তোমাদের, শেষে পাবে না নিস্তার।
আমাকে করেছো বন্দী, নিয়েছো উপড়ে চক্ষুদ্বয়।
এখন তো মেঘের অঢেল স্বাস্থ্য, রাঙা সূর্যোদয়
শিশুর অস্থির হামাগুড়ি, রক্তোৎপল যৌবন নারীর আর
হাওয়ায় স্পন্দিত ফুল পারি না দেখতে। বার বার
কী বিশাল দৃষ্টিহীনতায় দৃষ্টি খুঁজে মরি। সকাল সন্ধ্যার
ভেদ লুপ্ত; মসীলিপ্ত ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষে চকিতে মন্দার
জেগে উঠলেও অলৌকিক শোভা তার থেকে যাবে নিস্তরঙ্গ
অন্তরালে। এমন-কি ইঁদুরও বান্ধব অন্তরঙ্গ
সাম্প্রতিক, এমন নিঃসঙ্গ আমি নিজ দোষে আজ
চক্ষুহীন, হৃতশক্তি; দুঃস্বপ্নপীড়িত। এখন আমার কাজ
ঘানি ঠেলা শুধু ভার বওয়া শৃঙ্খলের। পদে পদে
কেবলি হোঁচট খাই দিন-রাত্রি, তোমরা অটল মসনদে।
শত্র“-পরিবৃত হয়ে আছি, তোমাদের চাটুকার
উচ্ছিষ্ট-কুড়ানো সব আপনি-মোড়ল, দুস্থ ভাঁড়
সর্বদাই উপহাস করছে আমাকে। দেশবাসী
আমাকে বাসেতো ভালো আজো—যাদের অশেষ দুঃখে কাঁদি হাসি
আনন্দে? পিছনে ফেলে এসেছি কত যে রাঙা সুখের কোরক,
যেমন বালক তার মিষ্টান্নের সুদৃশ্য মোড়ক।
আমাকে করেছো অন্ধ, যেন আর নানা দুষ্কৃতি
তোমাদের কিছুতেই না পড়ে আমার চোখে। স্মৃতি
তাও কি পারবে মুছে দিতে? যা দেখেছি এতদিন—
পাইকারি হত্যা দিগ্বিদিক রমণীদলন আর ক্ষান্তিহীন
রক্তাক্ত দস্যুতা তোমাদের, বিধ্বস্ত শহর, অগণিত
দগ্ধ গ্রাম, অসহায় মানুষ, তাড়িত, ক্লান্ত; ভীত
—এই কি যথেষ্ট নয়? পারবে কি এ-সব ভীষণ
দৃশ্যাবলি আমূল উপড়ে নিতে আমার দু-চোখের মতন?
দৃষ্টি নেই, কিন্তু আজো রক্তের সুতীব্র ঘ্রাণ পাই,
কানে আসে আর্তনাদ ঘন-ঘন, যতই সাফাই
তোমরা গাও না কেন, সব-কিছু বুঝি ঠিকই। ভেবেছো এখন
দারুণ অক্ষম আমি, উদ্যানের ঘাসের মতন
বিষম কদম-ছাঁটা চুল। হীনবল, শৃঙ্খলিত
আমি, তাই সর্বক্ষণ করছো দলিত।
আমার দুরন্ত কেশরাজি পুনরায় যাবে বেড়ে,
ঘাড়ের প্রান্তর বেয়ে নামবে দুর্দমনীয়, তেড়ে
আসা নেকড়ের মতো। তখন সুরম্য প্রাসাদের সব স্তম্ভ
ফেলবো উপড়ে, দেখো কদলী বৃক্ষের অনুরূপ। দম্ভ
চূর্ণ হবে তোমাদের, সুনিশ্চিত করবো লোপাট
সৈন্য আর দাস-দাসী অধ্যুষিত এই রাজ্যপাট।

……………
দুঃসময়ে মুখোমুখি, ১৯৭৩

বোধিনী
১. গ্রিক Agonistes শব্দের তর্জমা বিবাদী কিংবা বিপথগামী দুইটাই হতে পারে। মহাকবি মিল্টন মনে হইতেছে প্রথম অর্থের দিকেই বেশি ঝুঁকিয়া ছিলাম।

২. কবিতাটির রচনাকাল ৫ অক্টোবর ১৯৭১। এই তথ্য জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত জাতীয় কবিতা উৎসব ২০০৯ সেমিনারে জানাইয়াছিলেন প্রখ্যাত প্রকাশক (সাহিত্য প্রকাশের স্বত্বাধিকারী) মফিদুল হক। এই প্রসঙ্গে তাঁহার ঋণ স্বীকার করিতেছি।

দোহাই
১. শামসুর রাহমান, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ৮ম মুদ্রণ (ঢাকা: সাহিত্য প্রকাশ ২০০৯)।

২. কিতাবুল মোকাদ্দস, বাংলা অনুবাদ (ঢাকা: মঞ্জিল-ই-কিতাবুল মোকাদ্দস, সনতারিখ নাই)।

৩. Aijaj Ahmad, ‘Jameson’s Rhetoric of Otherness and the “National Allegory”,’ in In Theory: Classes, Nations, Literatures, 2nd imp. (Delhi: Oxford University Press, 1995).

৪. Eqbal Ahmad, The Selected Writings of Eqbal Ahmad, eds. Carollee Bengelsdorf et al. (New York: Columbia University Press, 2006/ka).

৫. Talal Asad, On Suicide Bombing (New York: Columbia University Press, 2007).

৬. Issac Asimov, Asimov’s Guide to the Bible, 2 vols. in 1, (New York: Gramercy Books, 1981).

৭. Charles Baudelaire, Baudlaire: the complete verse, vol. I, trans. Francis Scarfe (London: Anvil Press Poetry, 1986).

৮. Walter Beltz, God and the Gods, trans. Peter Heinegg (Harmondsworth, UK: Penguin Books, 1983).

৯. Walter Benjamin, ‘The Paris of the Second Empire in Baudelaire,’ trans. Harry Zohn, in Selected Writings, vol. 4 (1938–1940), eds. Howard Eiland and Michael W. Jennings, reprint (Cambridge, MA: Harvard University Press, 2006/kha).

১০. Walter Benjamin, Charles Baudelaire: A Lyric Poet in the Era of High Capitalism, trans. Harry Zohn, reprint (London: Verso, 1997).

১১. Amilcar Cabral, Return to the Source: Selected Speeches of Amilcar Cabral, ed. Africa Information Service (New York: Monthly Review Press, 1973).

১২. Aimé Cesaire, Discourse on Colonialism, trans. Joan Pinkham, reprint (New York: Monthly Review Press, 2000).

১৩. Irfan Habib, ‘Understanding 1857,’ in ed. Sabyasachi Bhattacharya, Rethinking 1857 (Hyderabad, 2007), pp. 58–66.

১৪. Fredric Jameson, ‘Third-world Literature in the Era of Multinational Capitalism,’ in The Jameson Reader, eds. Michael Hardt and Kathi Weeks, reprint (Oxford: Blackwell Publishers, 2001).

১৫. Insight on the Scriptures, 2 vols. (New York: Watchtower Bible and Tract Society of New York, 1988).

১৬. Karl Marx and Frederik Engels, Selected Correspondence, 3rd revised ed. (Moscow: Progress Publishers, 1975).

১৭. John Milton, Samson Agonistes, ed. F. T. Prince, 2nd imp. (Delhi: Oxford University Press, 1982).

১৮. F. T. Prince, ‘Introduction,’ in John Milton, Samson Agonistes, ed. F. T. Prince, 2nd imp. (Delhi: Oxford University Press, 1982), pp. 7–17.

১৯. The Zondervan Pictorial Bible Dictionary, ed. Merill C. Tenney (Grand Rapids, Michigan: Regency Reference Library, 1967).

প্রথম প্রকাশ: জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত জাতীয় কবিতা উৎসব ২০০৯ সেমিনারের মূল প্রবন্ধ হিসেবে লিখিত এবং এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।

পরিমার্জিত সংস্করণ: সলিমুল্লাহ খান, আদমবোমা, আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান সম্পাদিত, ইতিহাস কারখানা ২ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী এবং এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ২০০৯)।
===================================
সলিমুল্লাহ খান
পেশাদার লেখক, অনুবাদক ও সম্পাদক
salim_khan@yahoo.com

জন্ম
কক্সবাজার, ১৯৫৮

প্রকাশিত বই
১. সত্য, সাদ্দাম হোসেন ও স্রাজেরদৌলা, এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ঢাকা ২০০৭।
২. বেহাত বিপ্লব ১৯৭১; সম্পাদিত, অন্বেষা প্রকাশন ও এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ঢাকা ২০০৭।
৩. প্লাতোন রচনা সংগ্রহ (প্রথম খণ্ড: সক্রাতিসের সাফাই, এয়ুথোফ্রোন, ক্রিতোন), অনূদিত ও সম্পাদিত, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ঢাকা ২০০৫।
৪. জাক লাকাঁ বিদ্যালয় (প্রথম ভাগ: ফ্রয়েড পড়ার ভূমিকা), সম্পাদিত, এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ঢাকা ২০০৫।
৫. বাংলাদেশ: জাতীয় অবস্থার চালচিত্র, প্রথম সংস্করণ: প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, ঢাকা ১৯৮৩; দ্বিতীয় সংস্করণ : বাণিজ্য বিচিত্রা প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৩; তৃতীয় সংস্করণ, বাঙলা, ঢাকা ২০০৩।
৬. আল্লাহর বাদশাহি : ডরোথি জুল্লের কবিতা, অনূদিত, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা ১৯৯৮।
৭. এক আকাশের স্বপ্ন, প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, ঢাকা ১৯৮১।

সম্পাদিত পত্রিকা
প্রাক্সিস জর্নাল, ১৯৭৮-১৯৮৭
রাষ্ট্রসভা পত্রমালা, ২০০১
=============================
উপন্যাস- 'রৌরব'  by লীসা গাজী »»»   (পর্ব-এক) # (পর্ব-দুই) # (পর্ব-তিন) # (পর্ব-চার শেষ)   গল্প- 'পান্নালালের বাস্তু' by সিউতি সবুর   গল্প- 'গোপন কথাটি' by উম্মে মুসলিমা  আহমদ ছফার অগ্রন্থিত রচনা কর্ণফুলীর ধারে  আলোচনা- 'খানিক ছফানামা' by কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর  প্রবন্ধ- অল্পবিদ্যা কংকরবোমা : 'ফ্রয়েড, এডোয়ার্ড স. প্রবন্ধ- 'তাদের সঙ্গে, তাদের এলাকায়' by আকিমুন রহম  প্রবন্ধ- 'রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে ও গদ্যে মুসলমানের.   প্রবন্ধ- 'কবিতা, মানবজাতির মাতৃভাষা' by মাসুদ খান   প্রবন্ধ- 'কাজী নজরুল:রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের পার.


bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ সলিমুল্লাহ খান

এই প্রবন্ধ'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.