আমার কোনো শত্রু নেই - লিউ সিয়াওবো

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী লিউ সিয়াওবোর নিচের বিবৃতিটি প্রথম প্রকাশিত হয় হংকংভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস ইন চায়না’য়। এটিই কারাবন্দী হওয়ার আগে শেষবারের মতো প্রকাশিত লিউ সিয়াওবোর কোনো বিবৃতি। এরপর আর প্রকাশ্যে তিনি কোনো বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাননি। ২০০৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাঁকে গ্রেপ্তার করে চীন সরকার।আমার জীবনের গত অর্ধশতকের মধ্যে ১৯৮৯ সালের জুন মাসটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করি। ছাত্ররাও আমাকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। একই সঙ্গে আমি বুদ্ধিজীবী হিসেবেও নাম কুড়াতে থাকি। আমার প্রবন্ধ ও বই প্রকাশিত হতে থাকে। দেশে ও দেশের বাইরে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে গুণীজন হিসেবে ডাক আসতে থাকে। ওই সময়টায় আমি একজন লেখক ও একজন ব্যক্তি হিসেবে সৎ, দায়িত্বশীল ও আত্মমর্যাদা নিয়ে কাজ করার চেষ্টা চালাই। এই অবস্থানে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ১৯৮৯ সালের আন্দোলনে জড়িয়ে যাই। তাই প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই সময় আমাকে কারাবন্দী করা হয়। আমি আমার শিক্ষকতার পেশা হারাই। চীনে আমার বক্তব্য দেওয়া বা লেখালেখি প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ ও গণতন্ত্রের দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার দায়ে একজন শিক্ষক হারান তাঁর পেশা, একজন লেখক হারান তাঁর লেখালেখির অধিকার, একজন বুদ্ধিজীবী হারান প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়ার অধিকার। এটা একই সঙ্গে আমার জন্য যেমন দুঃখজনক, তেমনি দুঃখজনক চীনের জন্যও। অথচ এই চীনই ৩০ বছর ধরে সংস্কার ও মুক্তবাজারের কথা বলে আসছে।
এসব কথা যখন আমি ভাবি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি, ৪ জুনের পর থেকে আমার অধিকাংশ অভিজ্ঞতাই আদালতসংশ্লিষ্ট। ওই দিনের পর যে দুবার আমি প্রকাশ্যে আমার মতপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছি, তার একটি ছিল ১৯৯১ সালে বেইজিংয়ের মিউনিসিপ্যাল ইন্টারমিডিয়েট পিউপিলস কোর্টে, আরেকটি আজকে।
২০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু সেই ৪ জুনের ভূত এখনো আমাকে তাড়া করে ফেরে। ৪ জুন আমার মধ্যে যে মানসিক পরিবর্তন এনে দেয়, তার ধারাবাহিকতায় ধারণ করা আমার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে নিজ দেশে আমি মতপ্রকাশের অধিকার হারাই। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী আমাকে বছরের পর বছর নজরবন্দী করে রেখেছে, গৃহবন্দী করে রেখেছে, কারাগারে পাঠিয়েছে। তারপরও আমি এ শাসনব্যবস্থায় দাঁড়িয়েই বলতে চাই, আমার কোনো শক্র নেই, আমি কাউকে ঘৃণা করি না। এমনকি যেসব পুলিশ ভাই আমার ওপর নজর রাখেন, তাঁদের না, যেসব আইনজীবী আমাকে মামলায় জড়ান, তাঁদেরও না। আমি আপনাদের পেশাদারিকে সম্মান করি। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্যি, আপনাদের নজরদারি কিংবা আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমি মানি না।আমি মনে করি, ঘৃণা একজন মানুষের বিবেক-বিবেচনা ও ন্যায়বোধকে ধ্বংস করে দেয়। শত্রুতাপূর্ণ মনোভাব একটা জাতির মানসিক শক্তিকে নিঃশেষ করে দেয়, নিষ্ঠুর প্রবৃত্তিকে উসকে দেয়, ধৈর্য ও মানবিকতার দ্বার রুদ্ধ করে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথে একটি জাতির অগ্রযাত্রাকে রুখে দেয়। তাই আমি আমার ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতাকে ভালোবাসা, শুভকামনা ও সেবায় রূপান্তরিত করে আমার জাতির উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের পথ সুগম করতে চাই।প্রত্যেকে জানেন, উন্নয়ন ও সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যেই চীনে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ শুরু হয়। আমার দৃষ্টিকোণ থেকে এসব পদক্ষেপের মানে হচ্ছে, শ্রেণীসংগ্রামের যে নীতিতে মাও সে-তুংয়ের সরকার পরিচালিত হতো, তা থেকেই ক্রমশ সরে আসা। এই সংগ্রামের দর্শন থেকে সরে আসার প্রক্রিয়াটা আরেক অর্থে অন্যের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষের মনোবৃত্তি থেকেও সরে আসার প্রক্রিয়া বলে আমি মনে করি। এটা এমন এটি প্রক্রিয়া, যা দেশে এবং দেশের বাইরে মানুষে মানুষে বিভেদ ঘুচিয়ে পৃথক মূল্যবোধ ও স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় সাধনে সহযোগী ভূমিকা রাখবে। এই সংস্কার ও মুক্ত করার প্রক্রিয়া দেশবাসীর মধ্যে সৃজনশীলতা ও পরদুঃখকাতরতা সৃষ্টির পথকে সুগম করবে। নিজেকে পৃথক করে রাখার মনোবৃত্তি থেকে ক্রমশ সরে আসার প্রক্রিয়া আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতির গতি পরিবর্তন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াকে বেগবান করেছে। এই সংস্কারের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৮ সালে চীন জাতিসংঘের দুটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সনদে স্বাক্ষর করার অঙ্গীকার করে। ২০০৪ সালে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (এনপিসি) সংবিধানে সংশোধনী আনে। প্রথমবারের মতো সংবিধানে যুক্ত হয় ‘রাষ্ট্র এর নাগরিকদের মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও তা রক্ষায় বদ্ধপরিকর’-এর মতো লাইন। এসব পদক্ষেপ এটাই ইঙ্গিত করে যে, চীনের আইনে মানবাধিকার একটি মৌলিক নীতি হিসেবে ইতিমধ্যে স্বীকৃতি পেয়েছে।আমি ব্যক্তিগতভাবে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেও ও দণ্ডভোগ করলেও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, চীনের রাজনৈতিক অগ্রগতি থামবে না। ভবিষ্যতে একটি মুক্ত, স্বাধীন চীন দেখার ব্যাপারে আমি প্রচণ্ড আশাবাদী। এমন কোনো শক্তি নেই, যা মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে রুখতে পারে। আমার দেশও এ মাটিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানবাধিকারে মৌলিক ভিত্তি, মানবিকতার উৎস, সত্যের গর্ভধারিণী। বাকস্বাধীনতার টুঁটি টিপে ধরা মানে মানবাধিকারকে পদদলিত করা, মানবিকতাকে নিষ্পেষিত করা, সত্যের অবদমন ঘটানো। সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত বাকস্বাধীনতার অধিকার ভোগ করা একজন চীনা নাগরিকের সামাজিক দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। আমি এ চর্চা করে কোনো অপরাধ করিনি। শুধু স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করার কারণে যদি আমাকে অভিযুক্ত করা হয়, তবে আমি বলব, আমার কোনো অভিযোগই নেই।
ইংরেজি থেকে ভাষান্তর ইসরাত জাহান
লিউ সিয়াওবো: এ বছর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী চীনা মানবাধিকারকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.