কেচাপের মতোই

বিশ্বকাপে গোল-খরা নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণের আক্ষেপ কোনোভাবে পর্তুগিজদের কাছে পৌঁছে থাকবে! এক ম্যাচেই ৭ গোল করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরা তাই কবির দুঃখ ঘুচিয়ে দিয়েছেন। তবে নির্মলেন্দু গুণ এতে আরও বেশি দুঃখ পেলেন কি না, কে জানে!
তার আগে চাই সমাজতন্ত্র বলে যাঁর কবিতার বই আছে, সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা তুলে ধরে থাকা উত্তর কোরিয়ার এই নিগ্রহ তাঁকে কষ্টই দেওয়ার কথা।
সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস থাকুক না-থাকুক, উত্তর কোরিয়ানদের জন্য যে কারোরই মায়া হবে। ৪৪ বছর পর বিশ্বকাপে গিয়ে প্রথম ম্যাচে প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রাজিলকে ৫৫ মিনিট পর্যন্ত গোল-বঞ্চিত রাখার পর ১-২ গোলে হেরে যে সমীহটা অর্জিত হয়েছিল, তা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পর্তুগিজ গোল-বন্যা। এই ম্যাচেও তো ৫৩ মিনিট পর্যন্ত মাত্র এক গোল। অথচ এরপর কঠিন হয়ে গেল গোলের হিসাব রাখাই!
এই বিশ্বকাপে রাত সাড়ে ১২টার খেলাটাই শুধু শান্তিমতো দেখতে পারছি। বাকি ম্যাচগুলো দেখতে হচ্ছে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অথবা কাজ করতে করতে। গত পরশু ১-০ দেখে টিভির সামনে থেকে একটু সরেছি, ফিরে দুই চোখ বস্ফািরিত—৪-০! দেখতে না-দেখতেই ৫-০, ৬-০...। আর দেখার আগ্রহ থাকল না। মনে পড়ে গেল ফরাসি সাংবাদিক এমানুয়েল গাম্বারডেলার সেই অমর বাণী। ১৯৩৮ বিশ্বকাপে কিউবাকে ৮-০ গোলে হারিয়েছিল সুইডেন। ৫-০ হওয়ার পর প্রেসবক্সে টাইপরাইটার বন্ধ করে দিয়ে গাম্বারডেল ঘোষণা করেন, ‘৫ গোল পর্যন্ত এটা সাংবাদিকতার বিষয়। এরপর নিছক পরিসংখ্যান।’
তা এমন ‘পরিসংখ্যানের ম্যাচ’ বিশ্বকাপ খুব কম দেখেনি। কমপক্ষে ৭ গোলের ব্যবধানে জয়ের সংখ্যা গত পরশু দুই অঙ্কে নিয়ে গেল পর্তুগাল। এই সব কটি ম্যাচের গল্পই এমন একতরফা যে, মাত্র একটিতেই পরাজিত দলের কোনো গোল ফেরত দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
পরিহাসই বলতে হবে, সেটি যারা দিয়েছে, বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের লজ্জাটিও সেই এল সালভাদরের। ১৯৮২ বিশ্বকাপে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ১০-১ গোলে হার। ম্যাচের ৬৪ মিনিটে এল সালভাদরের একমাত্র গোলটি ৫ গোল খাওয়ার পর। গোলদাতা রামিরেজের বাঁধনছেঁড়া উল্লাসই এল সালভাদরের চূড়ান্ত সর্বনাশটা করেছিল। ‘৫ গোল খাওয়ার পর একটা দিয়েই মনে হয় বিশ্বকাপ জিতে ফেলেছিস’—হাঙ্গেরিয়ানরা প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল। ৬৯ থেকে ৮৩—১৪ মিনিটের মধ্যে আরও পাঁচ গোল ‘উপহার’ দিয়ে মিটিয়েছিল সেই রাগ। ওই পাঁচ গোলের তিনটিই বদলি হিসেবে নামা লাসলো কিসের। বিশ্বকাপে কোনো বদলি খেলোয়াড়ের তিন গোল করার একমাত্র ঘটনা হয়ে আছে এটি।
নিজের ৫০তম আন্তর্জাতিক ম্যাচে হাঙ্গেরির প্রথম ও শেষ গোলটি করেছিলেন অধিনায়ক টিবর নিলাসি। এল সালভাদরের খেলোয়াড়দের চেয়েও যেন বেশি বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি, ‘এটা অবিশ্বাস্য! ওদের সঙ্গে আরও এক শ বার খেললেও হয়তো আমরা আরেকবার ১০ গোল করতে পারব না।’ ১০-১ যা বলে, এল সালভাদর যে ততটা খারাপ দল নয়—সেটি বোঝানোও দায়িত্ব বলে মনে করেছিলেন নিলাসি। পরের দুই ম্যাচে তা প্রমাণিতও হয়েছিল। বেলজিয়ামের বিপক্ষে মাত্র এক গোল খেয়েছিল এল সালভাদর। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দুটি।
তবে বয়েই গেছে তাতে, এল সালভাদরকে তো বিশ্বকাপ মনে রেখেছে শুধু ওই ১০-১-এর কারণেই। গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়তে থাকা দেশটির ওই বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে ওঠাটাই ছিল এক বিস্ময়। হাঙ্গেরির কাছে অমন অপদস্থ হওয়ার পর হয়তো ওদের মনে হয়েছিল, বিশ্বকাপে না এলেই ভালো হতো! এল সালভাদর দল যে হোটেলে ছিল, ওই ম্যাচের পরদিন সে হোটেলের ওয়েটাররা পর্যন্ত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে ছিল—বিশ্বকাপ খেলতে এসেছ, আগে আমাদের হারাও তো দেখি! সেই ম্যাচে কী হয়েছিল, কৌতূহল হচ্ছে? না, না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। সে ম্যাচে এল সালভাদর জিতেছিল।
কদিন আগে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো খুব মজার একটা কথা বলেছেন। কোন গ্রেট নাকি তাঁকে বলেছেন, ‘গোল হলো কেচাপের মতো। বোতল থেকে বেরোতে চায় না, কিন্তু যখন বেরোতে শুরু করে, বেরোতেই থাকে।’ কথাটা খুব সত্যি। গোল যখন হয় না, হয়ই না। আর যখন হতে থাকে, হতেই থাকে। বিশ্বকাপে বড় ব্যবধানে জয়ের ম্যাচগুলোই এর বড় প্রমাণ। পর্তুগাল-উত্তর কোরিয়ার ম্যাচটিই যেমন ৫৩ মিনিট পর্যন্ত ছিল ১-০। হাঙ্গেরি-এল সালভাদর ১০-১ ম্যাচটির প্রথম ৫০ মিনিটে গোল হয়েছিল মাত্র ৩টি।
গোল তাহলে আসলেই কেচাপের মতো!

No comments

Powered by Blogger.