দেনমোহর স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

ইসলাম দেনমোহর নির্ধারণ করে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় যথোচিত পদক্ষেপ নিয়েছে। বৈবাহিক জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে একজন পুরুষ ও একজন নারী জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে উপনীত হন। দাম্পত্য সম্পর্কের আবর্তে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার বন্ধন শুরু হয়। চাওয়া-পাওয়া ও ন্যায্য অধিকারের বিষয়টিও সমানতালে চলতে থাকে। ইসলামি বিধানে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর যেমন অধিকার ও দায়দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি স্বামীর প্রতি স্ত্রীরও অধিকার ও দায়দায়িত্ব রয়েছে। একজন নারীর অধিকার প্রাপ্তিতে প্রথমেই দেনমোহর প্রাপ্তির বিষয়টি চলে আসে। বিয়ের পর স্ত্রী তাঁর স্বামীর পক্ষ থেকে তাঁর দাবি অনুযায়ী আর্থিক নিশ্চয়তা হিসেবে মোহরানা পাওয়ার অধিকারী। পবিত্র কোরআনে বিবাহ উপলক্ষে নারীকে সন্তুষ্টচিত্তে মোহর প্রদান করার তাগিদ দিয়ে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন, ‘আর তোমরা নারীদেরকে তাদের মোহর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে প্রদান করবে, সন্তুষ্টচিত্তে তারা মোহরের কিয়দংশ ছেড়ে দিলে তোমরা তা স্বচ্ছন্দে ভোগ করবে।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৪)
বিবাহকে বৈধ করার জন্য দেনমোহর একটি অন্যতম মাধ্যম। বিবাহে আল্লাহ তাআলা কর্তৃক নির্দেশিত অপরিহার্য প্রদেয় হিসেবে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী যে অর্থ-সম্পদ অর্জন করে থাকেন এটাই ‘মোহরানা’। বিবাহের সময় স্ত্রীকে মোহরানা দিয়ে ঘরে আনতে হয়। তবে বৈবাহিক সম্পর্ক মমতা ও ভালোবাসার বন্ধনে পরস্পরকে আবদ্ধ করার সম্পর্ক ভোগ বা ব্যবহারের চুক্তি নয়। মোহরানা দিয়ে ভোগের দাবির চিন্তা করা ইসলামি চেতনার পরিপন্থী। ভবিষ্যতে যাতে স্ত্রীকে দাসীরূপে না দেখে বরং সম্মানীয় অভিজাত নারী হিসেবে দেখেন, তার প্রতীকস্বরূপ স্বামী এ মোহর পরিশোধ করেন। প্রতিটি মুসলিম পুরুষের জন্য বিবাহের সময় ধার্যকৃত মোহরানা আদায় করা একটি বাধ্যবাধকতা। রাসূলুল্লাহ (সা.) নারীর মোহরানার অধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা নারীদের মোহরানার হক আদায়ের মাধ্যমে জীবনসঙ্গিনীকে হালাল কর।’
ইসলামে বিবাহবন্ধনে মোহরানার গুরুত্ব অধিক। এটি ইসলামের আবির্ভাবকাল থেকেই মুসলিম সমাজে কড়াকড়িভাবে আরোপিত। মোহরানা নারীর প্রাপ্য অধিকার। বৈবাহিক বিষয়ে লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের নির্দেশনা হলো, স্বামী নববিবাহিতা স্ত্রীকে কিছু অর্থ-সম্পদ ফরজ তথা আবশ্যিকভাবে প্রদান করবেন। মোহরানা প্রদানের হুকুম থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.)ও ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁকে মোহরানা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীদেরকে, যাদের মোহর তুমি প্রদান করেছো।’ (সূরা আল-আহযাব, আয়াত-৫০) অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কিরামকে তিনি মোহর প্রদানের তাগিদ দিয়েছেন। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নবুওয়াত লাভের পূর্বযুগে কোনো ব্যক্তি কন্যার অভিভাবক বা পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিতেন এবং তাঁর মোহর আদায়ের পরে বিয়ে করতেন।’
মোহরানা স্ত্রীর এমন একটি ন্যায্যপ্রাপ্য, যা তিনি স্বামীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আগে পাওনা হন, তবে স্ত্রী স্বেচ্ছায় কিছু সময় দিলে বাকি রাখা যাবে। কিন্তু মোহরানার অর্থ আবশ্যিকভাবে পরিশোধ করতে হবে। স্ত্রী যদি নিজ খুশিমনে স্বামীকে তার কিছু অংশ বা সম্পূর্ণ মাফ করে দেন, তবে তা মাফ হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে বিবাহিত স্ত্রীকে অসহায় মনে করে ছলে-বলে-কৌশলে বা অজ্ঞতার সুযোগে ক্ষমা করিয়ে নিলে তা হবে সুস্পষ্ট জুলুম ও বিরাট প্রতারণা। যাঁরা নগদে পরিশোধ না করে অদূর ভবিষ্যতে সামর্থ্য হলেই আদায় করবেন—এ অঙ্গীকার করে দাম্পত্য জীবন শুরু করেন, কিন্তু মনেপ্রাণে এ অর্থ পরিশোধের ইচ্ছা থাকে না; তাঁরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন এবং নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটির সঙ্গেও প্রবঞ্চনা করে থাকেন। এমন ঘোরতর অন্যায় প্রতিরোধকল্পে নবী করিম (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মেয়েকে মোহরানা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে বিয়ে করেছে, কিন্তু সে মোহরানা আদায় করার ইচ্ছে তার নেই, সে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সামনে ব্যভিচারী হিসেবে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
ইসলামি বিধান অনুসারে মোহর দুই ধরনের হতে পারে। ১. মোহরে মোআজ্জল বা নগদ প্রদেয় এবং ২. মোহরে গায়রে মোআজ্জল বা বিলম্বে প্রদেয়। প্রথমটি নগদ এবং দ্বিতীয়টি চাহিবামাত্র দিতে হয়। মোহরানা এককালীন আদায় করতে অক্ষম হলে উত্তম পদ্ধতি হলো কিছু অংশ নগদ আদায় করে বাকি অংশ পরে সময়মতো আদায় করা এবং তা ধীরে ধীরে কিস্তিতে পরিশোধ করা। তবে মোহরানা আদায় না করলে স্ত্রীর কাছে ঋণী থাকতে হবে এবং স্ত্রী অনাদায়ী মোহর স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে আদায় করে নিতে পারবেন।
শরিয়তের দৃষ্টিতে মোহর প্রদান স্বামীর অন্যতম দায়িত্ব এবং তা স্ত্রীর গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অধিকার। এভাবে বিবাহের মাধ্যমে নারী তথা স্ত্রীর যাবতীয় ব্যয়ভার স্বামীকেই বহন করতে হয়। সুতরাং বিবাহ-সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেনে পুরুষের কোনোভাবে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ও লৌকিকতার খাতিরে মোটা অঙ্কের মোহরানা ধার্য করা মোটেই উচিত নয়। বৈবাহিক উপঢৌকনটি যেখানে সুখের প্রতীক, স্ত্রীর নিরাপত্তার গ্যারান্টি, সেখানে এটি নিয়ে বিয়ের কথাবার্তার সময় এমন দরকষাকষি করা কাম্য নয়, যা বৈরিতার সৃষ্টি করে। কেননা আয়-উপার্জন বা সামর্থ্যের অতিরিক্ত মোহরানা আদায় করা স্বামীর জন্যও বোঝাস্বরূপ। তবে উভয় পক্ষ সন্তুষ্ট হয়ে যে পরিমাণ পারস্পরিক সম্মতিতে মধ্যপন্থা নির্ধারণ করবে, তা-ই গ্রহণযোগ্য হবে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘কম মোহরে বিবাহে বরকত বেশি।’
অথচ আধুনিক সমাজ অধিক পরিমাণে মোহর নির্ধারণ করার প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে স্বামী যেন স্ত্রীকে তালাক দিতে না পারে। কিন্তু মোহরানা হলো এমন একটি বিষয় যা তালাকপ্রাপ্তার প্রাপ্য বিষয় থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিয়ে উপলক্ষে যেমন উপঢৌকন দিতে হয়, তালাকের সময়ও তেমনি প্রদেয় আছে। মোটা অঙ্কের মোহরানা ধার্য করে পরে ছলচাতুরি করে তা পরিশোধ না করা এবং আদায় করার ইচ্ছা নেই, শুধু একটি অংশ স্বীকার করা প্রতারণার শামিল ও কবিরা গুনাহ। সুতরাং মোহরানা কোনো প্রদর্শনীমূলক বিষয় নয়, এটি ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়। এটি নিয়ে যেকোনো ধরনের টালবাহানা বা সীমা লঙ্ঘন করা ইসলামের দৃষ্টিতে জঘন্যতম অপরাধ। দেনমোহর দাম্পত্য জীবনের তাত্পর্যবহ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্মপ্রাণ প্রত্যেক মুসলমানের যত শিগগির সম্ভব মোহরানা আদায়ের মাধ্যমে দায়মুক্ত হয়ে নিশ্চিন্ত থাকা উচিত। ইসলামের বিধান মেনে চলে স্ত্রীর প্রাপ্য মোহর আদায় করলে সমাজে নারী নির্যাতন বহুলাংশে লোপ পেত। এ ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা সৃষ্টিতে মসজিদের ইমাম বা ধর্মীয় নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করা একান্ত প্রয়োজন।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.