বিজয় দিবসের প্রত্যাশা -বিজয়কে সামনে এগিয়ে নিতে by আমিন আহমেদ চৌধুরী

একাত্তরের ষোলোই ডিসেম্বর আমাদের জীবনে কেবল নতুন একটি মাত্রা সংযোজন করেনি; বরং চিন্তা-চেতনা ও মননে এক বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করেছে। প্রাদেশিকতার গণ্ডি থেকে বের হয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের পরিমণ্ডলে হঠাত্ করে এক আত্মপ্রত্যয়ী গর্বিত চির উন্নত মম শির উচ্চারিত বিজয়ী এক বাঙালির আবির্ভাব ঘটে। সারা বিশ্ব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে সৌম্য সুহাসে মহীয়ান সেই বাঙালির দিকে, যার প্রতিভূ ছিলেন ফাঁসির মঞ্চে রজ্জু ছিন্নকারী সুপুরুষ—সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা সেদিন কেঁদেছিলাম তাঁর আশু মুক্তির জন্য। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আমরা সেদিন হেসেছিলাম। কোমর বেঁধে নেমে পড়েছিলাম যুদ্ধবিধ্বস্ত সোনার বাংলা পুনর্গঠনে।
প্রাথমিকভাবে আমরা দুরু দুরু পদক্ষেপে সঠিক পথে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের সামনে লক্ষ্য ছিল জনগণের কাছে স্বাধীনতার সুফল বয়ে আনা। সমবায়ভিত্তিক মিশ্র অর্থনীতির স্বপ্নে ছিলাম বিভোর। সেই সময় যাঁরা আমাদের নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ। তাঁরা প্রত্যেকেই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার প্রতীক ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের আপামর দুঃখী জনগণ আশার আলো দেখতে পাচ্ছিল। দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অর্থনীতির বুনিয়াদ ধীরে ধীরে সমাজে গ্রথিত হচ্ছিল। তাঁদের প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তাঁদের নৈতিকতা-সততার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য ছিল। সেখানে ফাঁকিজুঁকি নিতান্তই কম ছিল। তার পরই কুচক্রীদের খপ্পরে পড়ে দেশ ধীরে ধীরে দিক-নির্দেশনাহীনভাবে চলতে শুরু করে। এলোমেলো চিন্তা, দিন এনে দিন খাওয়া দেশের অগ্রগতি দারুণভাবে ব্যাহত করতে থাকে। যদিও বেসরকারি খাতে ও বিচ্ছিন্নভাবে অন্য কয়েকটি খাত নিজেদের প্রচেষ্টায় প্রভূত উন্নতি সাধন করে। নারীশিক্ষার বেলায়ও আমাদের অগ্রগতি লক্ষণীয়। কিন্তু তার পরও সমুন্নত কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এখনো নিতে পারিনি। চিন্তা-চেতনার দৈন্য এবং ধারাবাহিকতার অভাব, কর্মে নিষ্ঠার অভাব। সেই উচ্ছ্বাস-উদ্যম, স্বতঃস্ফূর্ততা সময়ের ব্যবধানে ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যায়। আত্মকলহ, কোন্দল, চিন্তা ও চেতনার দৈন্য আমাদের সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর পরিবেশের দিকে ঠেলে দিতে থাকে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী নয় মাসের মধ্যে বিশ্বমানের সংবিধান প্রণয়ন করেও কিছুদিনের মধ্যে আমরা তা থেকে সরে এলাম এবং ক্রমান্বয়ে সরে আসতে লাগলাম। বলতে গেলে সেই থেকে আমাদের পিছু হটা শুরু। সেই পিছু হটার আর শেষ নেই। পিছু হটতে গিয়ে পঙ্কিলতায় ডুবে গেলাম। শিক্ষাব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসনিক যন্ত্র, বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি এবং রাজনৈতিক মূল্যবোধ থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হয় ধ্বংস করতে থাকি, নতুবা কলুষিত করতে থাকি। শুধু তা-ই নয়, তা থেকে নিস্তার পাওয়ার কার্যকর কোনো পথ আজও বের করতে পারলাম না। এই ৩৭ বছর শুধু ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার বিদ্যায় উত্কর্ষতা লাভ করলাম। স্থিতিশীলতার নামে ন্যক্কারজনক দলীয়করণ কৌশল প্রয়োগে একে অপরকে পরাস্ত করে একেবারে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে আছি। ফলে দেশ রাডারবিহীন অবস্থায় চলতে শুরু করল। তীরে ভেড়ার কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা দেয়নি। এর প্রধান কারণ, এ দেশের শিক্ষিত সমাজের একটি অংশের স্বার্থান্বেষী তত্পরতা। এ দেশের সাধারণ মানুষ অসাধারণ গুণে গুণান্বিত। খেতখামারে খেটে-খাওয়া মান্ধাতার আমলের কৃষক আজও স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে শুরু করে এ দেশের সব কাজের বৈতালিক এবং অর্থনীতির ক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি। তার পরও আমাদের দুর্গতির শেষ নেই। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হিমালয়সম অব্যবস্থা এবং অসুস্থ মনমানসিকতা থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। বর্তমান সরকার জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। এই সরকারের অনেক কিছু করার রয়েছে। বিজয়ের এই মাসে বতর্মান সরকারের কাছে আমার কিছু প্রত্যাশা রয়েছে। আমি মনে করি, আমাদের বিজয়কে এগিয়ে নিতে হলে এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি বলে মনে করছি।
১. সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে অনতিবিলম্বে ’৭২ সালের মূল ও অপরিবর্তিত সংবিধানে ফিরে গিয়ে তা সর্বস্তরে চালু করা।
২. একক বিজ্ঞানমনস্ক সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা। অনতিবিলম্বে মাদ্রাসা বোর্ড ভেঙে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একক সর্বজনীন বাংলা মাধ্যম শিক্ষাব্যবস্থা সর্বস্তরে চালু করা, যেখানে তৃতীয় শ্রেণী থেকে ইংরেজি বাধ্যতামূলক বিষয় থাকবে। খোদ আরব দেশেও মাদ্রাসা বোর্ড বলে আলাদা কোনো বোর্ড নেই, রয়েছে সর্বজনীন শিক্ষা বোর্ড।
. স্বাধীন বিচারব্যবস্থা মুখরোচক কথা হিসেবে ব্যবহার না করে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া। অর্থাত্ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রধান বিচারপতি নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি সব ধরনের বিচারপতিদেরসহ দেশের সার্বিক বিচারব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হবেন। প্রধান বিচারপতি নিয়োগকালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেবেন।
৪. কর্মকমিশন প্রশাসনিক চাহিদা মোতাবেক সব ধরনের রিক্রুটমেন্ট করবে। কর্মকমিশনের অধীনে জ্যেষ্ঠতার তালিকা সংরক্ষণ ও পদোন্নতিসহ আমলাতন্ত্র চলমান থাকবে। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় উপসচিব পদমর্যাদা থেকে নিম্নে স্থানীয় পর্যায়ে বদলি করতে পারবেন। কিন্তু উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মজীবীদের পদোন্নতি দেবে কর্মকমিশন। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে সাচিবিক কাজ করে তালিকাগুলো কর্মকমিশনের কাছে পাঠাবেন পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদাসম্পন্ন সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হবেন এবং সদস্যরা সচিব পদমর্যাদাসম্পন্ন ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হবেন, যাঁদের নাম সংসদীয় কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে।
৫. মন্ত্রিপরিষদ ও সার্বভৌম সংসদ দেশের নীতিনির্ধারক ও আইন প্রণয়নকারী। তাঁদের অধীনে আমলারা তাঁদের সরকারি দায়িত্ব পালন করবেন। তবে প্রশাসনযন্ত্র মন্ত্রিপরিষদ সচিবের অধীনে সরকারি বিধান ও নির্দেশ মোতাবেক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করবে। মন্ত্রণালয়ের সচিব মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অফিসার হবেন। তিনি সব রকম হিসাব-নিকাশের জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
. মানবসম্পদ, জ্বালানি, মানবাধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্বাধীন কমিশন দ্বারা পর্যবেশিত হওয়া একান্তভাবে উচিত। প্রয়োজনে বিষয়ভিত্তিক ন্যায়পাল নিয়োগ করা হবে। অফিসের সময় হওয়া উচিত সকাল ১০টা থেকে বিকেল পাঁচটা। শুক্রবার সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত অফিস হবে এবং কর্মচারীদের মধ্যাহ্নভোজের ব্যবস্থা থাকবে। শনি ও রোববার ছুটি থাকবে।
৭. ঢাকা শহরকে বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করে টঙ্গীর তুরাগ নদ পর্যন্ত একটি বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ করে রাখা। কোনো অবস্থাতেই নগরায়ণ ও আবাসনের নামে ফসলি জমি, জলাশয়, নদী-নালা ভরাট করে ব্যবহার করা যাবে না। অনতিবিলম্বে ব্যক্তিগত প্লট বরাদ্দ বন্ধ করে অবৈধ স্থাপনা স্থাপনকারী, রাজউকের সদস্যসহ সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া। আবাসিক ও অন্যান্য এলাকায় খেলার মাঠের চারপাশে কমপক্ষে ২০ তলা ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি অথবা বরাদ্দ দেওয়া। জয়দেবপুর থেকে খিলক্ষেত এবং সদরঘাট হয়ে আশুলিয়া পর্যন্ত শহরের চারদিকে সার্কুলার রেলপথ, হাইওয়ে ও বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা। আব্দুল্লাহপুর থেকে টিএসটি চত্বর পর্যন্ত (একটি বিশ্বরোডের ওপর দিয়ে যাবে) এবং দাউদকান্দি থেকে গাবতলী পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণ করা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে অবৈধ পার্কিং, স্টেডিয়ামসহ আবাসিক এলাকার রাস্তার শেষ মাথায় ঘরবাড়ি বা স্থাপনা নির্মাণ চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
৮. ভূমি সংস্কার কমিশন সব অবস্থায়ই ভূমির সদ্ব্যবহার, পরিবেশ সংরক্ষণ, বিশেষ করে ফসলি জমির পরিমাণ এবং উত্পাদন যাতে ব্যাহত না হয়, সেদিকে খবরদারি করবে।
৯. সিভিল সার্ভিস ও পুলিশ সার্ভিসসহ সব সার্ভিসের ক্যাডারদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কমপক্ষে আড়াই বছর হবে। বর্তমান প্রশিক্ষণ একাডেমিগুলো ধুলোর সঙ্গে মিশে গেছে। এগুলোকে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশ বা কোনো ইউরোপীয় দেশের সঙ্গে চুক্তি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা (পুলিশ সার্জেন্ট/কাস্টম/ইনকাম ট্যাক্স সুপারভাইজারসহ) যাতে নৈতিকতা ও সামাজিক মূল্যবোধ তাদের মনে গ্রথিত হয়। দেশপ্রেমে উদ্ভাসিত সুনাগরিক হিসেবে তাঁরা দেশের সেবা করবেন। আমলাসহ সর্বস্তরের কর্মজীবীদের বেলায় মেধা সর্বাগ্রে স্থান পাবে। দেশের চাহিদা অনুযায়ী ৪০টির অধিক মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয়তা নেই। সেই অনুযায়ী করপোরেশনসহ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে ৫০-৬০ জনের বেশি নিয়োগ না করা।
১০. রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা সর্বস্তরে অবশ্যই হতে হবে। বার্ষিক সম্মেলন যদি নাও করা হয়, তাহলেও প্রতি তিন বছরে একবার অবশ্যই করতে হবে এবং প্রতি সম্মেলনে দলের যাবতীয় খরচ, অডিট করা আয় ও ব্যয়ের হিসাব সব সদস্যকে দিতে হবে এবং তা সম্মেলনে দাখিল করতে হবে।
১১. আমার প্রস্তাব হচ্ছে, তিন স্তরবিশিষ্ট রাজনৈতিক অবকাঠামো সৃষ্টি করে দেশকে পরিচালিত করা। স্তরগুলো হলো স্বশাসিত ইউনিয়ন কাউন্সিল, স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদ ও সার্বভৌম জাতীয় সংসদ। ইউনিয়ন কাউন্সিল আয়তনধর্মী না হয়ে জনসংখ্যাভিত্তিক হতে হবে। থানা প্রশাসন জেলা প্রশাসনের অধীনে ইউনিয়নের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে সদা সচেষ্ট থাকবে। উচ্চতর ও কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থাও অঞ্চলভিত্তিক হতে পারে।
বিভাগীয় প্রশাসন ভূমি জরিপ থেকে শুরু করে ভূমি-পরিবেশের ব্যবহার তদারক করবে, সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা ও জেলা প্রশাসনের কাজ তদারক করবে। জাতীয় সংসদের সদস্যরা আইন প্রণয়নের কাজে ব্যাপৃত থাকবেন। উপজেলা বা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ঠেলাঠেলি না করে, প্রশাসনিক পদে না থেকে এলাকার প্রশাসনে নজরদারি করবেন।
যাঁর যা দায়িত্ব, তাঁকে তা নির্ভয়ে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালনে উদ্বুদ্ধ করাই ক্ষমতাসীন সরকারের আরব্ধ কাজ হওয়া উচিত। তাঁবেদারি নয়, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সামনের দিকে এগোনোর ক্ষেত্রে প্রজ্ঞাবান হতে হবে। তবেই দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠালাভের পথ সুগম হবে। নৈতিকতার যে ধস আমাদের সমাজে নেমেছে, সর্বশক্তি দিয়ে তা রোধ করতে হবে। প্রচলিত আইনকে আত্মস্থ করে চিন্তা-চেতনার ধারাবাহিকতা বহমান রাখা ও আত্মশুদ্ধিই একমাত্র উত্তরণের পথ। এবারের বিজয় দিবসে এটাই হোক আমাদের চাওয়া।
মেজর জেনারেল (অব.) আমিন আহমেদ চৌধুরী (বীর বিক্রম): মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত।

No comments

Powered by Blogger.