সেদিন জ্যাক জেকব ব্যর্থ হলে কী ঘটত by মিজানুর রহমান খান

জেনারেল জ্যাক ফ্রেডরিক রালফ জেকবের কাছ থেকে একটি ই-মেইল পেয়েছিলাম ১০ ডিসেম্বর। তিনি লিখেছেন, ‘শুভেচ্ছা। গুগলে গিয়ে ইউটিউবে যান। সেখানে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণসংক্রান্ত একটি সবাক শর্ট ফিল্ম পাবেন। আরও কিছু সবাক প্রামাণ্যচিত্র পাবেন ডান দিকে। এর মধ্যে ভুট্টোকে দেখা যাচ্ছে, তিনি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পোলিশ রেজুলেশন ছিঁড়ে ফেলছেন। আপনি চাইলে এসব প্রামাণ্যচিত্র বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ডিস্কে স্থানান্তর করে দেখতে পারেন। এ সবই ইতিহাসের রেকর্ড।’
১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে জেকবকে শুভেচ্ছা জানালাম একাত্তরে তাঁর বীরোচিত ভূমিকার জন্য। ‘একাত্তরের এই দিনটিতে আপনার অবিস্মরণীয় ভূমিকা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। বাইবেলের নিউটেস্টামেন্ট থেকে উদ্ধৃতি দিই। এর সার কথা হচ্ছে—তোমার কাছে যার যা প্রাপ্য, তাকে তা দিয়ে দাও। যে কর আদায় করে, তাকে কর দাও; যাদের শ্রদ্ধা করা উচিত, তাদের শ্রদ্ধা করো; যাদের সম্মান পাওয়া উচিত, তাদের সম্মান করো। শুধু পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার ঋণ ছাড়া কারও কাছে ঋণী থেকো না।’ (রোমীয় ১৩:৭-৮)
এরপর তাঁকে বলি, ‘এবার ঠিক ১৬ ডিসেম্বরে আপনার কী অনুভূতি, জানতে পারলে খুশি হতাম।’ বয়সের কথা ভেবে সতর্ক থাকি। এ বয়সে আমরা অনেকেই যখন ই-মেইলে চিঠির জবাব দিতে আলস্য করি, তখন জেকব ই-মেইলে দারুণ চটপটে, প্রাণোচ্ছল। কিন্তু তার পরও তাঁর বয়স পঁচাশি অতিক্রান্ত। তিনি যা লিখেছেন তার তরজমা নিচে দেওয়া হলো: ‘‘হাই। নিয়াজি একটি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠালেন। এতে নির্দিষ্টভাবে জাতিসংঘের অধীনে সামরিক, আধাসামরিক বাহিনী এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রত্যাহারের কথা বলা হলো। সরকার তুলে দিতে হবে জাতিসংঘের কাছে। যুদ্ধাপরাধের কোনো বিচার করা যাবে না। তাঁর প্রস্তাবে ভারতের কোনো উল্লেখই ছিল না। যুদ্ধাপরাধের প্রস্তাবগুলো ভুট্টো সরাসরি নাকচ করে দেন। ১৫ ডিসেম্বর ভারত একটি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করল। ১৬ ডিসেম্বরের সকালে জেনারেল মানেকশ আমাকে শুধুই জানিয়ে দিলেন, ঢাকায় যাও এবং আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করো। আমি আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করলাম। এই খসড়ার অনুলিপি আগেই দিল্লিতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু দিল্লি থেকে কোনো জবাব আসেনি। এখানে হামুদুর রহমান কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া প্রাসঙ্গিক। হামুদুর রহমান প্রশ্ন রেখেছিলেন জেনারেল নিয়াজিকে:
মি. নিয়াজি, যখন আপনার ২৬ হাজার ৪০০ সেনা ছিল ঢাকায়, তখন মাত্র কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা ছিল ঢাকার বাইরে। আপনি তো অন্তত আরও দুই সপ্তাহের বেশি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারতেন। ওই সময় জাতিসংঘের অধিবেশন চলমান ছিল। এবং আপনি যদি আর একটি দিনও বেশি যুদ্ধটা চালিয়ে নিতেন, তাহলে ভারতীয়দের হয়তো পিছু হটতে হতো। তাহলে কেন আপনি একটি লজ্জাজনক, জনতার সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ কবুল করেছিলেন? কেনই বা আপনি আপনার খোদ এডিসির নেতৃত্বে এমনকি একটি গার্ড অব অনার প্রদানেও রাজি হয়েছিলেন?
নিয়াজি উত্তর দিয়েছিলেন, আমাকে এসব করতে জেনারেল জেকব বাধ্য করেছিলেন। জেকব আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে আত্মসমর্পণ ইত্যাদি করিয়েছিলেন। জেনারেল নিয়াজি কিন্তু এই মন্তব্য তাঁর বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা শীর্ষক গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন।’’
গত বছর সেপ্টেম্বরে দিল্লিতে তাঁর আরকে পুরমের স্বল্প আয়তনের নিরাভরণ ফ্ল্যাটে (আমাদের চাকচিক্যের সঙ্গে তুলনা করলে জেকব অপাঙেক্তয়, বড় অভাজন!) আমাকে সাক্ষাত্কার প্রদানের সময়ও লক্ষ করেছি, জেনারেল জেকব ঢাকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান যে দিল্লির হাইকমান্ড কিংবা তাঁর বস জেনারেল মানেকশয়ের পরিকল্পনামাফিক হয়নি, এখানে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রতিফলনজনিত একটি অনন্য কৃতিত্ব রয়েছে, তা তিনি সংযত সন্তোষের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন।
দিল্লি বা জেনারেল মানেকশয়ে নয়, তাঁর একক পরিকল্পনায় ঢাকার পতন ঘটে। বিষয়টি তিনি তাঁর বই সারেন্ডার অ্যাট ঢাকায় বিস্তারিত উল্লেখ করেন। মনে হচ্ছিল, তাঁর এই কৃতিত্ব ভারতের বিভিন্ন মহলে তেমনভাবে স্বীকৃত হয়নি। তাই ঈষত্ হলেও হয়তো তাঁর এ নিয়ে একটি সুপ্ত উষ্মা রয়েছে। ‘আপনার বই প্রকাশের সময় মানেকশ কি বেঁচেছিলেন?’ তিনি দিল্লিতে আমাকে বলেছিলেন, তিনি তখন বেঁচে। মানেকশ তাঁর দাবি খণ্ডন করেননি। জেকব মনে করেন ঢাকাকেন্দ্রিক কোনো পরিকল্পনাই মানেকশর মাথায় ছিল না। তিনি লিখিতভাবে যেটা পেয়েছিলেন তাতে শুধু খুলনা ও চট্টগ্রামের কথাই ছিল। এসব সত্ত্বেও জেকবের দাবির সঙ্গে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। কিন্তু জেকব তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নন। তাঁর দ্ব্যর্থহীন যুক্তি: তাঁর দাবি উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ও দলিলনির্ভর। এসব এখনো অপ্রকাশিত কিন্তু সংরক্ষিত। জেকব দাবি করেন, মানেকশর জারি করা আদেশগুলোতে কখনো ঢাকার উল্লেখ ছিল না। একাত্তরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান পি সি লাল তাঁর মাই ইয়ার্স উইথ দি আইএএফ গ্রন্থে লিখেছেন, ভারতীয় বাহিনী এটা আশা করেনি যে পাকিস্তানি সেনারা এভাবে ভেঙে পড়বে এবং ঢাকার পতন ঘটবে। এখানে আমরা কিন্তু লাল ও নিয়াজির বক্তব্যের মধ্যে একটা যোগসূত্র খুঁজে পাই। তবে একদিন নিশ্চয় বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
জেকবের সঙ্গে দিল্লিতে পর পর দুই দিন প্রায় তিন ঘণ্টা আলোচনা করেছি। তিনি শিশুর সারল্যে বিনম্র চিত্তে তাঁর বাংলাদেশ যুদ্ধবিষয়ক অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন। মুজিবনগর সরকার গঠনের সূচনায়ও তাঁর একটা কার্যকর ভূমিকা ছিল। ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা সম্পর্কে নিজের কৃতিত্ব বলেছেন। কিন্তু সে জন্য তিনি কখনোই অন্যকে খাটো করতে চাননি। ভারত ও বাংলাদেশের বাহিনী-সংশ্লিষ্ট যাদের সঙ্গে তাঁর মতভিন্নতা হয়েছে, তা তিনি যুক্তির নিরিখেই বর্ণনা করেছেন। জেনারেল ওসমানী, জিয়া কিংবা মানেকশ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে তিনি তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যদিও ওসমানী ও মানেকশর বাংলাদেশ যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিগত অনেক মৌলিক তফাত্ ছিল।
জেনারেল জেকব ঢাকায় বেড়াতে এসে যেমন তেমনি তাঁর বাসভবনে সাক্ষাত্কার প্রদানকালে বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা অনেক বড় করে দেখেছেন। তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু ঢাকার প্রকাশনায় সেটি বাদ দিয়ে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আলোকচিত্র ব্যবহার করায় তিনি ব্যথিত। বারবার আক্ষেপ করলেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেষ্ঠত্ব গতকালও তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন অকপটে: বিজয় এসেছিল মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায়। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের অর্জিত বিজয়ের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারাই ডিসাইসিভ (চূড়ান্ত) ভূমিকা পালন করেন। তিনি তাঁর এই ই-বার্তাটি শেষ করেন এই বলে যে ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক। ইতি জ্যাক জেকব।
সংগতকারণেই জ্যাক জেকবের ঢাকার আত্মসমর্পণ পরিকল্পনার যথার্থতা সম্পর্কে মন্তব্য করব না। তবে জেকবের এই বার্তার একটি অংশ আমাকে লন্ডনের পর্যটক আকর্ষণ ট্রাফালগার স্কয়ারের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। লন্ডনে গিয়ে অন্য অনেকের মতো আমিও ওই চত্বরে গিয়ে শুধু সিংহের মূর্তি দেখে আসি। কিন্তু তখনো বুঝিনি যে এর সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের একটি যোগসূত্র সৃষ্টি হয়ে গেছে। অন্তত একজন জ্যাক জেকবের কল্পনায়।
ঝরনাবেষ্টিত ট্রাফালগার স্কয়ারে চারটি সিংহ। প্রহরারত সিংহগুলো আগলে রেখেছে নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে বহু লড়াইয়ের নন্দিত নায়ক হোরেসিয় নেলসনকে। এই নেলসনই (জন্ম ১৭৫৮) ট্রাফালগার অভিমুখে ব্রিটিশ নৌ বহরের নেতৃত্ব দেন। ১৮০৫ সালে তিনি ট্রাফালগার যুদ্ধেই নিহত হন। ফরাসিদের বিরুদ্ধে ১৮০১ সালের কোপেনহেগেনের যুদ্ধে তিনিই ছিলেন অধিনায়ক। তাঁর এক চোখ তখন অন্ধ। অ্যাডমিরাল হাইড পারকার ছিলেন নেলসনের বস। যেমন জেকবের কাছে ছিলেন মানেকশ। নেলসন যখন অমিত বিক্রমে কোপেনহেগেনের পতন ত্বরান্বিত করছিলেন। তখন অ্যাডমিরাল পারকার পতাকা দুলিয়ে তাঁকে যুদ্ধবিরতির সংকেত দেন। বিস্মিত নেলসন কৌশলী হন। তিনি তাঁর হাতে থাকা টেলিস্কোপ তাঁর অন্ধ চোখের সামনে ধরেন। আর বলেন, ‘আমি সত্যিই কোনো সংকেত দেখতে পাচ্ছি না!’ নেলসনের সেই প্রত্যুত্পন্নমতিত্বে ডেনিশ সেনারা সেদিন পরাজিত হয়। পারকার সমালোচিত হন। তাঁকে তলব করা হয়। তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ভাইস অ্যাডমিরাল থেকে অ্যাডমিরাল হন নেলসন।
জেকবের যুক্তি: যুদ্ধক্ষেত্রে ওপরের আদেশ উপেক্ষার ওই নজির আমার জানা ছিল। ‘নেলসনের কোপেনহেগেনের মতো আপনি ঢাকায় পাকিস্তানিদের পতন ঘটাতে চোখের সামনে একটি টেলিস্কোপ(!) তুলে ধরেছিলেন?’ গতকাল সন্ধ্যায় জেকবের জবাব পাই: ‘একদম ঠিক বলেছেন।’ ২ জুলাই ১৮০১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। নেলসন থেকে জেকব। মাঝখানে ১৭০ বছর। জেকব ব্যর্থ হলে কী ঘটত?
১৬ ডিসেম্বর ২০০৯ জেকব নিজেই তা উল্লেখ করে লিখেছেন: ‘ধরুন নিয়াজির প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতিকে যদি একটি নিঃশর্ত প্রকাশ্য আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে, যা কি না ইতিহাসের একমাত্র উদাহরণ, পরিণত করতে সেদিন আমি ব্যর্থ হতাম, তাহলে জাতিসংঘ সেনা প্রত্যাহারের একটি আদেশ দিত এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের দায়িত্বভার তুলে নিত।’
পুনশ্চ: জেকব গতকাল তাঁর সন্ধ্যার ই-মেইলে আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ও আমাদের মধ্যে এক অত্যুত্কৃষ্ট ঐক্যবদ্ধ সম্পর্ক ছিল। পূর্ব কমান্ডে কর্মরত ও মুক্তিযোদ্ধারা হাজির ছিলেন। আমরা স্মরণ করি যে সেটা ছিল আমাদের যৌথ প্রচেষ্টা, যা আমাদের বিজয় এনে দেয়।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.