আমাদের গণতান্ত্রিক মানসের স্বরূপ -রাজনৈতিক সংস্কৃতি by মোহীত উল আলম

বাংলাদেশ আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার পর এটাই প্রথম বিজয় দিবস পড়ল। এর আগে একাধারে ১৫ বছরের সংসদীয় গণতন্ত্রের পর দুই বছর গেল ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল। সে সময় মানুষ জীবনযাপনে অধিকতর নিরাপদ বোধ করলেও স্বস্তি বোধ করেনি। মানুষ আবার গণতন্ত্রে ফিরে আসতে চেয়েছে। বিপুলভাবে তারা ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট প্রয়োগ করেছে। আমাদের দেশের মানুষ হুজুগে, আবেগপ্রবণ, নিষ্ঠুর; আবার দয়ালু, কিন্তু তারা গণতন্ত্রমনা। আমাদের রাজনৈতিক মানসের স্বরূপ হলো, আমরা রক্তের ভেতর খাঁটি গণতন্ত্রী।
তবে রক্তের ভেতর খাঁটি গণতন্ত্রমনা হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার আরেকটি দিক হলো, আমরা উত্তরাধিকারসচেতন। অর্থাত্ বংশ বা পরিবারসচেতন। এটি পুরো ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতির অংশ। এরই প্রতিফলন ঘটেছে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশে। ভারতে গান্ধী পরিবার, পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার, শ্রীলঙ্কায় বন্দরনায়েকের পরিবার এবং বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু ও জিয়ার পরিবারের কর্তৃত্ব বা শাসন চলছে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে—একটানাভাবে না হলেও।
প্রাচীন ভারতবর্ষীয় এ সামন্তপ্রথা বাংলাদেশে পুরোপুরি বজায় রয়েছে। একদিকে আমরা যেমন চাই যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া পর্যায়ক্রমে দেশটাকে ভাগাভাগি করে চালান, অন্যদিকে আমরা চাই যে দেশের শাসন যেন তাঁদের দুই বংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এদিক থেকে আমরা পুরোপুরি সামন্ততান্ত্রিক। আমাদের গণতন্ত্রের মধ্যে মেঘনা নদীতে পদ্মা নদী যেমন এসে মিশেছে, তেমনি আধুনিক গণতন্ত্রের ধারার মধ্যে মোটা ধারার সামন্ততন্ত্রও মিশে গেছে।
গণতন্ত্রের সঙ্গে সামন্ততন্ত্রের মৌলিক তফাত হলো, প্রথমটা চলে যোগ্যতার ভিত্তিতে, আর দ্বিতীয়টা চলে রক্তের বাঁধনে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মনীষী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন (১৭০৬—১৭৯০) একটি রচনা লিখেছিলেন সেসব ইউরোপবাসীর জন্য, যাঁরা সে সময় আমেরিকায় অভিবাসী হওয়ার কথা চিন্তা করছিলেন। ১৭৮৪ সালে লিখিত এ রচনাটির নাম ছিল, ‘অ্যাডভাইস টু সাচ অ্যাজ উড রিমুভ টু অ্যামেরিকা।’ ফ্র্যাঙ্কলিন আমেরিকায় আগমনে ইচ্ছুক লোকদের আহ্বান জানালেও এ বলে তাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক সমাজে মানুষের পরিচয় হলো, ‘আপনি কে?’ এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া। অর্থাত্ কার ছেলে আপনি বা কার আত্মীয় বা আপনি কোন বংশের? ফ্রাঙ্কলিন জানালেন, কিন্তু, আমেরিকায় মানুষের পরিচয় হলো, ‘আপনি কী?’ অর্থাত্, আপনি কী করেন বা কী জানেন। এটা হলো যোগ্যতার পরিচয়। বংশ বা পরিবার কোনো ব্যাপার নয়।
সম্ভবত নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কিশোরতোষ গল্পে বাংলাদেশের গ্রামের প্রেক্ষাপটে অনুরূপ ভাবের একটি কাহিনী আছে। স্কুলের হেড পণ্ডিত লক্ষ করলেন, একটি নতুন ছেলে এসেছে ক্লাসে। তিনি ছেলেটাকে দাঁড়াতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর নাম কী রে?’ ছেলেটি উত্তরে বলল, ‘বঙ্কু পালের ভাগ্নে আমি’। বঙ্কু পাল হলেন সে গ্রামের ক্ষমতাধর জমিদার।
আমেরিকায় গণতন্ত্র সে জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। বারাক ওবামাকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে আমেরিকার কুশলী রাজনীতিবিদদের মনে নানা কূটকৌশল কাজ করলেও (যেমন এ চিন্তাটা যে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদী ইসলামের দমনের ক্ষেত্রে একজন শ্বেতাঙ্গ রাষ্ট্রপতির চেয়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতিই বেশি কার্যকর হবে), এটা তো সত্য যে স্রেফ তাঁর যোগ্যতাবলেই ওবামা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পেরেছেন।
কিন্তু আমাদের গণতান্ত্রিক চেতনায় দেখা যাচ্ছে, ‘আপনি কী’-এর চেয়ে ‘আপনি কে’ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সে জন্য দেখা যাচ্ছে, যখন বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরপর আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই দাঁড়াতে পারছিল না, তখন শেখ হাসিনাকে এনে দলের হাল ধরালে দলটি দাঁড়ায়। তখন যে আওয়ামী লীগে যোগ্য নেতা ছিলেন না তা নয়, আব্দুস সামাদ আজাদ, কামাল হোসেনরা তো ছিলেনই, আরও অনেকে ছিলেন। কিন্তু কেউ জনসমর্থন পাচ্ছিলেন না। শেখ হাসিনাকে মানুষ মেনে নিল তাঁর কোনো রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কারণে নয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা বলে। কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু জনপ্রিয়তাভিত্তিক রাজনীতিতে আর দাঁড়াতে পারলেন না। সে রকম আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও অনেকে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে দাঁড়াতে না পেরে আবার আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফিরে এসেছেন। বিএনপিতে কে এম ওবায়দুর রহমান, অধ্যাপক বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী কিংবা কর্নেল অলি আহমদও খালেদা জিয়ার ছায়া থেকে বের হয়ে শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ যেমন সমস্যায় পড়েছিল এবং সে সমস্যার সমাধান হয়েছিল শেখ হাসিনার আগমনে, তেমনি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরও খালেদা জিয়াকে অনেকটা বাধ্য হয়ে রাজনীতিতে নামতে হয় এবং দলের হাল ধরতে হয়। শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় এখন অনেক রাজনীতি শিখেছেন, কিন্তু তাঁদের নিজ নিজ রাজনৈতিক জীবনের প্রারম্ভে একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা, আরেকজন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী। শেখ হাসিনা তাও পৈতৃকসূত্রে কিছুটা রাজনীতি চিনতেন, কিন্তু খালেদা জিয়া ছিলেন একান্তই আগন্তুক। কিন্তু তাঁদের কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনীতি আবর্তিত হতে থাকলে এবং অন্যদিকে দলত্যাগকারী সম্ভাবনাময় নেতা-নেত্রীরা নতুন দল গঠন করে সফল হতে না পারলে বুঝতে পারা যায় যে দেশের মানুষ চায়, বঙ্গবন্ধুর পরিবার এবং জিয়াউর রহমানের পরিবারের নিকটাত্মীয়দের মধ্যে কেউ না কেউ নেতৃত্বে থাকুন। এটা আমাদের সামন্ততান্ত্রিক চাওয়া, কিন্তু এটা বাংলাদেশি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও বটে।
৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১৬ বছর পর বিএনপির কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলে সর্বসম্মতিক্রমে যে খালেদা জিয়ার মামলাপীড়িত জ্যেষ্ঠ ছেলে তারেক রহমানকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসনের পদ সৃষ্টি করে সে পদে বসানো হলো, তাতে প্রকৃত গণতন্ত্রের সমঝদারেরা মাথা চাপড়াতে পারেন, কিন্তু এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। তারেক রহমান, তাঁর বাবার মতো এক জোড়া কালো চশমা পরে লন্ডন থেকে যখন ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে সম্মেলনে উপস্থিত কাউন্সিলরদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখছিলেন, তখন মাঠে উপস্থিত কয়েক হাজার লোক পিনপতন নিস্তব্ধতায় তা শুনছিলেন। তা হলে?
আমাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো বিস্মৃতিপ্রবণতা। অর্থাত্ ভুলে যাওয়া। যে দ্রুতগতিতে আমরা বঙ্গবন্ধুর অশেষ অবদানের কথা ভুলে গেছি (যেন এ দেশটি আমাদের দিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ধিক্কারযোগ্য), ঠিক তার চেয়েও দ্রুতগতিতে আমরা ভুলে গেছি তারেক রহমানকৃত নাজায়েজ কাজগুলো। তা হলে?
বিস্মৃতিপরায়ণতা যদিও নৈতিক দিক থেকে অকৃতজ্ঞতাপূর্ণ মনোভাবের শামিল, কিন্তু সুযোগসন্ধানী মনোভাব ও আধুনিক অর্থে যাকে জঙ্গম বা সচলতা বলা যায়, তারও সমার্থক আচরণ এটি। অর্থাত্, বিস্মৃতিপরায়ণতার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সুযোগসন্ধানী রাজনীতির। আর দুঃখের বিষয় হলো, সুযোগসন্ধানী প্রক্রিয়া ছাড়া রাজনীতি চলে না।
তাহলে আমাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার আরেকটি শেকড় হলো সুযোগসন্ধানী প্রবণতা।
তবে সমাজ নিতান্তই অশিক্ষিত বলে আমাদের গণতান্ত্রিক মানসিকতার স্বরূপ হলো অশিক্ষানির্ভর। রাজনীতির জগতে পদচারণ করছেন এমন কর্মী ও সমর্থক বিশাল বাহিনীর ৮০ থেকে ৯০ ভাগ হচ্ছে প্রায় নিরক্ষর কিংবা লেখাপড়া জানলেও নিজের বিবেচনা বোধ দিয়ে চলতে পারেন না। নিজেরা যাচাই-বাছাই না করে অন্যের কথায় চলতে ভালোবাসে আমাদের জনগণ। ভালো করে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, জিয়াউর রহমানের ব্যাপকভাবে সমালোচিত ছেলে তারেক রহমানের একটি বড় দলের নেতৃত্বে গঠনতান্ত্রিকভাবে এসে যাওয়ার মধ্যে যে চাপটা ছিল, সেটি সামন্ততান্ত্রিক চাপ হলেও তা ছিল একটি কারণ মাত্র, অপর কারণটি ছিল তাঁর পক্ষে যুবদলের একটি অংশ আওয়াজ তুলেছিল। তারা খালেদা জিয়ার ওপর চাপ দিয়ে সিদ্ধান্তটি বের করে নেয়। বিস্মৃতিপরায়ণতার সঙ্গে যখন, এ ধরনের আওয়াজ তোলা হয় তখন রাজনৈতিক ঘটনাপরম্পরায় তারেক রহমানের ভবিষ্যতে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা হলে?
যদি এটিই আমাদের গণতান্ত্রিক ভবিতব্য হয়, তাহলে সে ভবিতব্যকে মেনে নেওয়া কি হবে আরেকটি গণতান্ত্রিক বাস্তবতা? জানি না।
মোহীত উল আলম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি ও মানববিদ্যা বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস।

No comments

Powered by Blogger.