অকার্যকর রাজনৈতিক সম্পর্ক -বিরোধী দলের সংসদে ফেরা উচিত

নবম জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনেও বিরোধী দল নেই। শিগগিরই যে তারা সংসদে যোগ দেবে, এমন আভাস-ইঙ্গিতও মিলছে না। সরকারি দলের পক্ষ থেকেও এমন কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়, যা বিরোধী দলকে সংসদে ফিরে যেতে উত্সাহিত করতে পারে। জাতীয় সংসদের এই অসম্পূর্ণতা বা আংশিক অকার্যকরতা যেন এক স্থায়ী চিত্র হয়ে উঠেছে। আমরা দেখে আসছি, এভাবেই চলছে আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র: অধিবেশনে অনুপস্থিতির কারণে যখন সংসদ সদস্যপদ বাতিল হওয়ার দশা উপস্থিত হয়, তখন বিরোধীদলীয় সাংসদেরা অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে সদস্যপদ রক্ষা করে আবারও বেরিয়ে আসেন। এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক।
গতকাল শনিবার দারিদ্র্য বিমোচন সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে এক মঞ্চে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ঘিরে সংবাদমাধ্যমে এক ধরনের উদ্দীপনা লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া বা তাঁর দল বিএনপি সমাবেশে অংশ নেয়নি। অবশ্য অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, বিভিন্ন উপলক্ষে দুই নেত্রীর মুখোমুখি হওয়া বা কুশল বিনিময় দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনে না।
দুই প্রধান নেত্রী ও তাঁদের দুই দলের মধ্যকার সম্পর্কের প্রতিফলন সংসদেও পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। বিশেষত, দুই নেত্রীর ইচ্ছাতেই নিরূপিত হয় দুই দলের সম্পর্ক। কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এই সম্পর্ক? এটা কি কোনো কার্যকর রাজনৈতিক সম্পর্ক? নাকি এটা সম্পর্কহীনতা? রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর মধ্যে বিরোধ থাকে, সেই বিরোধ কার্যকর হতে হলে তো তাদের মধ্যে যোগাযোগ প্রয়োজন। নৈতিক, আদর্শিক বা কর্মকৌশলগত মতপার্থক্য, আপত্তি, বিরোধ—কোনো কিছুরই কোনো অর্থ থাকে না দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ, সংলাপ, তর্ক-বিতর্ক ছাড়া। তর্ক-বিতর্কের উত্কৃষ্টতম স্থান হলো জাতীয় সংসদ। সেই সংসদই দিনের পর দিন বর্জন করে চলে বিরোধী দল। এটা শুধু বর্তমানের চিত্র নয়, অতীতেও এ রকমই ঘটেছে।
কোনো কারণেই অনির্দিষ্টকাল ধরে সংসদ বর্জন করা উচিত নয়। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে বা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেনি, কী কারণে তারা সংসদ বর্জন করে চলেছে এবং সরকারের তরফে কী করা হলে তারা আবার সংসদে ফিরবে। তবে গত শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে দারিদ্র্য বিমোচন সমাবেশে যোগদানে বিরত থাকার সিদ্ধান্তের কথা জানাতে গিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ভবিষ্যতে বিরোধী দলের সহযোগিতা, জাতীয় ঐক্য চাইলে সরকারকে ‘উপযুক্ত পরিবেশ’ তৈরির আহ্বান জানান। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, সরকারকে যে চারটি বিষয় নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে, সেগুলো হলো: ১. আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ২. বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, ৩. পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্যাতন ও বিরোধী দল দলন বন্ধ করা এবং ৪. সর্বক্ষেত্রে ‘নগ্ন দলীয়করণ’ ও দলবাজি বন্ধ করে সরকারকে দলের সরকার নয়, দেশের সরকারের মতো আচরণ করা।
আমরা জানি না এ বিষয়ে সরকার কী বলবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে—এমন দাবি সরকার করতে পারে, যেমনটি সব সরকারই করে আসছে। সরকার বলতে পারে এবং ইতিমধ্যে বলেছেও যে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করছে, কোনো হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে না। রিমান্ডে নির্যাতন বা বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ সব সরকারই ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয়। আর সর্বক্ষেত্রে ‘নগ্ন দলীয়করণের’ অভিযোগ তো কোনো সরকারই স্বীকার করে না।
তবে অন্তত এসব নিয়েই যদি সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংসদে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়, তাহলে এই যোগাযোগহীনতার অবসান ঘটতে পারে। সে জন্য বিরোধী দলের সংসদে ফিরে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.