ধুঁকছে কমার্স ব্যাংক, পুনর্গঠনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার প্রস্তাব by ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের (বিসিবিএল) সার্বিক উন্নয়নের পথ খুঁজছে সরকার। ‘সমস্যাকবলিত ব্যাংক’ হিসেবে চিহ্নিত এটি।
সম্প্রতি ব্যাংকটির উন্নয়নের ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে চারটি বিকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতাধীন পুনর্গঠন প্রকল্প প্রণয়ন নামের প্রস্তাবটির ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় সরাসরি ‘না’ করে দিয়েছে। বাকি তিনটির ব্যাপারে যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ব্যাংকটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একটি অবস্থানপত্র জমা দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিসিবিএল সমস্যাকবলিত ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত। সরকার নিযুক্ত পরিচালক ও বেসরকারি পরিচালকদের সমন্বয়ে গঠিত এর পরিচালনা পর্ষদ। অর্থাত্ এটি পরিচালিত হচ্ছে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) ভিত্তিতে। তবে হতাশাজনক যে, গঠনের পর থেকে ব্যাংকটি সরকারকে এক টাকাও লভ্যাংশ দিতে পারেনি। পুঞ্জীভূত লোকসান, সঞ্চিতি ও মূলধন ঘাটতিসহ ব্যাংকটির আর্থিক পরিস্থিতিও খুব খারাপ।
বিসিবিএলের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তারাও এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেননি। তাঁরাও বলছেন, বেসরকারি অন্য ব্যাংকগুলো বছরে যেখানে শত শত কোটি টাকা মুনাফা করছে, সেখানে এ ব্যাংকটি পুরোপুরিই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। নয় বছরে এতে ১৬ জন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা ব্যাংকের উন্নয়নের স্বার্থে ভালো কোনো পদক্ষেপ নেননি বা নিতে পারেননি। বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রতিবছরই যেখানে শাখা বাড়াচ্ছে, সেখানে ২৪ শাখা নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া ব্যাংকটির শাখা এখনো ২৪টিতেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চার প্রস্তাব: বিসিবিএলের উন্নয়নের স্বার্থে অর্থ বিভাগের কাছে চারটি বিকল্প প্রস্তাব জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রস্তাবগুলো হচ্ছে—ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধন বাড়িয়ে ৪০০ কোটি টাকায় উন্নীত করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক পুনর্গঠন প্রকল্প প্রণয়নের মাধ্যমে বর্তমানের অনুমোদিত মূলধনের ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা শেয়ারের একাংশ কোনো সুযোগ্য বিনিয়োগকারীর কাছে এবং বাকি অংশ বিদ্যমান আমানতকারীদের কাছে বিক্রি করা, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাওয়া এবং সরকারি মালিকানায় থাকা শেয়ার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রহণ করলে ব্যাংকটি পুরোপুরি বেসরকারি খাতে চলে যাবে অথবা একীভূত হয়ে যাবে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে।
শেয়ার কিনে নিতে চাইছে দুই প্রতিষ্ঠান: এদিকে সরকার ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংকের হাতে থাকা ব্যাংকটির শেয়ার কিনে নিতে অর্থ বিভাগে আবেদন করেছে দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান সরকারের কাছে থাকা ১০০ টাকা মূল্যমানের ৩০ কোটি টাকার শেয়ার এবং তিন ব্যাংকের কাছে থাকা ১০০ টাকা মূল্যমানের ১০ কোটি টাকার শেয়ার প্রতিটি ১২৫ টাকায় কিনে নিতে চাইছে। অন্য প্রতিষ্ঠানটি চাইছে ১০০ টাকা মূল্যমানের সোনালী ব্যাংকের পাঁচ লাখ শেয়ার এবং অগ্রণী ব্যাংকের দুই লাখ শেয়ার কিনে নিতে।
১৯৯৭ সালে পাস হওয়া বাংলাদেশ কমার্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (পুনর্গঠন) আইনের মাধ্যমে গঠিত বিসিবিএল একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। এর অনুমোদিত মূলধন ২০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৯২ কোটি টাকা।
শেয়ারের শ্রেণী বিভাজন: শুরু থেকেই বিসিবিএলের পরিশোধিত মূলধনকে ক, খ, গ—এমন তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। সরকার হলো ক শ্রেণী; সোনালী, অগ্রণী ও জনতা—এ তিন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক খ শ্রেণী এবং বন্ধ ঘোষিত বিসিআইয়ের আমানতকারীরা গ শ্রেণীর শেয়ারধারী। ব্যাংকটিতে ক শ্রেণীর শেয়ার রয়েছে মোট মূলধনের ৩২ দশমিক ৬০ শতাংশ বা ৩০ কোটি টাকা, খ শ্রেণীর শেয়ার ১০ দশমিক ৮৮ শতাংশ বা ১০ কোটি টাকা এবং গ শ্রেণীর শেয়ার রয়েছে ৫৬ দশমিক ৫২ শতাংশ বা ৫২ কোটি টাকা।
তবে গ শ্রেণীর শেয়ারের মধ্যে জিয়া সার কারখানা, যমুনা সার কারখানা, ঢাকা বিদ্যুত্ বিতরণকারী কোম্পানি (ডেসকো) এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ড—এ চার প্রতিষ্ঠানের আট কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। সে হিসাবে সরকারের হাতে এ ব্যাংকের মোট শেয়ার রয়েছে ৫২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
অর্থ বিভাগের পর্যালোচনা ও মতামত: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাব ও সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে অর্থ বিভাগ যে অবস্থানপত্র তৈরি করেছে, এতে ব্যাংকটির করুণ দশার পেছনে একাধিক কারণের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে পুনর্গঠন প্রকল্প প্রণয়নের ব্যাপারে সরাসরি নেতিবাচক মন্তব্য করেছে অর্থ বিভাগ। অর্থ বিভাগ বলেছে, এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যাংকটির ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত করতে হবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে গোটা ব্যাংকিং খাতে। অর্থ বিভাগের মতে, বিসিবিএলের অবস্থা খারাপ, তবে এর ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার মতো নয়। অন্য তিন প্রস্তাবের বিষয়ে আইনগত বাধা রয়েছে কি না, তা জানতে ইতিমধ্যেই আইন মন্ত্রণালয়ে নথি পাঠানো হয়েছে।
অর্থ বিভাগের মতে, ব্যবস্থাপনায় পেশাদারির অভাব, দুর্বল তদারক, অদক্ষ জনবল, জামানতবিহীন ঋণ দেওয়া ইত্যাদি কারণে ব্যাংকটিতে বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি পুঞ্জীভূত লোকসান, মন্দ ঋণের বিপরীতে সঞ্চিতি ঘাটতি এবং সমন্বিত মূলধন ঘাটতি তো রয়েছেই।
অর্থ বিভাগ আরও বলেছে, বিসিবিএল স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানি না হওয়ায় অবাধে এর শেয়ার হস্তান্তর সম্ভব নয়। আবার বাজারে ব্যাংকটির শেয়ার ছাড়াও এখন সমীচীন হবে না। কারণ, আর্থিক অবস্থার উত্তরণ না হওয়া পর্যন্ত শেয়ার ছাড়লে ভালো দাম পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে ব্যাপকমাত্রায় যেহেতু পুঞ্জীভূত লোকসান ও কু-ঋণ রয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে শেয়ার ছাড়লে উল্টো বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন।

No comments

Powered by Blogger.