অস্বস্তি কমলেও টানাপড়েন কাটেনি: গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে

অস্থিরতার মধ্যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের  বৈঠকে দৃশ্যত অস্বস্তি কিছুটা কমেছে। তবে রাজনৈতিক টানাপড়েন কাটেনি। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি পায়নি বলে নেতারা মনে করছেন। এ ইস্যুতেই সরকারের সঙ্গে দলটির টানাপড়েন চলছে। এর বাইরে সরকারে থাকা দুই ছাত্র উপদেষ্টার পদত্যাগ, সরকারে থাকা বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার বিষয়ে দলগুলোর দাবির বিষয়ে সরকারের তরফে কোনো কিছু বলা হয়নি। এই ইস্যুতেও সরকারের সঙ্গে কয়েকটি দলের টানাপড়েন রয়েছে। বিএনপি এবং সমমনা দলগুলো একই ধরনের দাবি জানিয়ে আসছে। শনি ও রোববার দুইদিনে ২২টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। ওই বৈঠকে দলগুলোর তরফে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সমর্থন জানানো হয়। একইসঙ্গে নির্বাচন, সংস্কার এবং গণহত্যার বিচারের বিষয়ে নিজ নিজ দাবি তুলে ধরেন নেতারা। নির্বাচন ইস্যুতে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে বেশির ভাগ দল। সরকারের তরফে এ বিষয়ে আগের বক্তব্যই পুনর্ব্যক্ত করে বলা হয়েছে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। এর একদিনও বাইরে যাবে না। সরকার আগে থেকেই এমন বক্তব্য দিয়ে আসছে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে পথ নকশা না দেয়ায় বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে। এই সংশয় দূর করতেই সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দাবি করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় সরকারের তরফে আগের বক্তব্য উপস্থাপন করায় দলগুলোর এই সংশয় কাটেনি। এ নিয়ে সামনে আরও জল ঘোলা হতে পারে বলে কেউ কেউ মনে করছেন। জামায়াতে ইসলামী ও নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ কয়েকটি দল নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর চেয়ে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থেই তারা তাড়াহুড়ো করছে না বলে মনে করা হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করার পরই নতুন অস্থিরতা শুরু হয়। দেখা দেয় উদ্বেগ। এই অবস্থা নিরসনে আলোচনার জন্য দলগুলো আগ্রহ প্রকাশ করে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর পরে বৈঠকের সূচি ঠিক করে। দুইদিনের এই বৈঠকের আগে শনিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পরই জানানো হয় প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন না।

ওই বৈঠকের পরই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধান উপদেষ্টা।  বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার, জুলাই গণহত্যার বিচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে জামায়াতসহ অন্যান্য দল সরকারের কথায় আশ্বস্ত হলেও বিএনপি’র সঙ্গে বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি বলে নেতারা মনে করছেন। কারণ দলটি যেসব বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে তার কোনোটি নিয়েই সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য আসেনি। বৈঠকে নির্বাচন ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা তার আগের অবস্থানই পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এতে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো বার্তা পায়নি দলটি। বৈঠকে কেন বিএনপিকে ডাকা হয়েছে, সে ব্যাপারেও অর্থপূর্ণ কিছু খুঁজে পাননি দলটির নেতারা।

বিএনপি বলছে, বরাবরের মতো এবারো বৈঠকে বিএনপি’র নেতারা বলেছেন আর প্রধান উপদেষ্টা শুনেছেন। তেমন কোনো মতামত দেননি। বৈঠক ছিল কার্যত ওয়ান-সাইডেড, অর্থাৎ ইন্টার-অ্যাকটিভ কোনো আলোচনা হয়নি। এ ছাড়া বিএনপি স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছে, সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টাকেও রাখা হয়েছে। এটাকেও বিএনপি ভালোভাবে নেয়নি। এসব কারণে বৈঠক হলেও সরকারের সঙ্গে টানাপড়েন রয়ে গেছে বিএনপি’র।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ তো উনি (প্রধান উপদেষ্টা) এখনো ঘোষণা করেন নাই। আমরা দাবি রেখে এসেছি। উনি আগের কথাই বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে চেষ্টা করবো, না পারলে জুনের মধ্যে অবশ্যই করবো। তার জন্য উপযুক্ত সময়ের আগেই ঘোষণা (রোডম্যাপ) দেয়া হবে। আর আমাদের দাবি এখনো পুরোপুরি মেনে নেয়া হয়নি। আমরা দাবি জানিয়ে এসেছি, বিতর্কিত তিনজন উপদেষ্টা নানাভাবে এই সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন।

ওদিকে বিএনপি’র সঙ্গে বৈঠকের পর একইদিন জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি’র সঙ্গেও বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনো সময় বেঁধে দেয়নি জামায়াতে ইসলামী। তবে সংস্কার শেষ হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারির মধ্যবর্তী নির্বাচন হতে পারে বলে মনে করছে দলটি। এরপরে টেনে লম্বা করলে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হবে না বলে প্রধান উপদেষ্টার কাছে নিজেদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে জামায়াত। অন্যদিকে বৈঠকে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন এবং আওয়ামী লীগের আমলের সব নির্বাচন আইনিভাবে বাতিলের দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, একটা সুবিধাজনক সময়ের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচনের আগে অবশ্যই সংস্কার এবং বিচারের কিছু প্রক্রিয়া জনগণের সামনে আসতে হবে। সংস্কার শেষ না করে যদি কোনো নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে জনগণ তাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। আর মাঝে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। আপাতত দৃষ্টিতে তা কিছুটা কেটেছে। এর স্থায়ী নিষ্পত্তি করতে হলে দুইটা রোডম্যাপ ঘোষণা করলেই তার অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে। একটা হচ্ছে সংস্কারের রোডম্যাপ, আরেকটা হচ্ছে নির্বাচনের রোডম্যাপ।

এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশনের উপর এনসিপি আস্থা রাখতে পারছে না। এই কমিশন সংস্কার করে যাতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করা হয়। জুলাই গণহত্যার বিচার এবং সংস্কার প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন (গণপরিষদ) এই তিনটির সমন্বিত রোডম্যাপ যাতে ঘোষণা করা হয়, সেই দাবি আমরা জানিয়েছি। এর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমরা চেয়েছি।

ওদিকে রোববার ১৯টি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এই বৈঠকেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপের কথা কিছু বলেননি সরকারপ্রধান। তবে জুনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি প্রধান উপদেষ্টা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন দল ও সংগঠনগুলো। তবে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কথা বলেননি। জুনের একদিন পরেও নির্বাচন যাবে না তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
বৈঠকে অংশ নেয়া রাজনৈতিক ও সংগঠনের চারজন নেতা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, উনি কাজ করতে পারছেন না। হতাশা তৈরি হয়েছিল। সেই অবস্থায় তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বলেছেন, আমরা যুদ্ধ অবস্থায় আছি। রাজনৈতিক দল ও সংঠনগুলো বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপর তাদের সমর্থনের ঘাটতি নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনার পরামর্শও দেয়া হয় এবং তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সকল সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ওদিকে কেউ কেউ ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বললেও প্রধান উপদেষ্টা সুনির্দিষ্ট করে কোনো দিন কিংবা মাসের কথা বলেননি।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত আরও দু’জন নেতা মানবজমিনকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, প্রশাসনে কোনো শৃঙ্খলা নেই, কেউ কারও নির্দেশনা মানেন না, এই অবস্থায় নির্বাচন দিলে যে এলাকায় যারা শক্তিশালী তারা ভোটের বাক্স নিয়ে চলে যাবে। এজন্য প্রশাসন ঠিক করে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে চাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। বৈঠকে কেউ কেউ ডিসেম্বরে সম্ভব না হলেও জানুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন দেয়ার পরামর্শ দিলেও প্রধান উপদেষ্টা জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা আবারো পুনর্ব্যক্ত করেছেন বলে সূত্রটি জানিয়েছেন।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না মানবজমিনকে বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা আগের কথাই বলেছেন, অল্প সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে, আর বেশি সংস্কার চাইলে জুনে নির্বাচন হবে। আর বলেছেন, উনি জুনের পরে যেতে চান, এজন্য লিখিতভাবে যদি দিতে হয়, তাও উনি দিতে পারবেন বলেও জানিয়েছেন।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মানবজমিনকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা অবনতির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন নির্বাচনের জন্য প্রশাসন অপ্রস্তুত। শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা পর্যন্ত কীভাবে নির্বাচন দেবেন সেই বিষয়টিও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। আর নির্বাচন ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে হবে বলে সরকারপ্রধান আমাদের জানিয়েছেন।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম মানবজমিনকে বলেন, সংস্কারের ভিত্তিতে আমরা নির্বাচনের কথা বলেছি। সংস্কারে আমরা সরকারকে সমর্থন করবো বলে জানিয়েছি।

ভাসানী জনশক্তি পার্টির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু মানবজমিনকে বলেন, বৈঠক ফলপ্রসূ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, আমরা একটা যুদ্ধ অবস্থায় বিরাজ করছি। আর প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, উনি পদত্যাগ করবেন না।

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী মানবজমিনকে বলেন, বৈঠকে নির্বাচন, সংস্কার, বিচার ও নারী কমিশন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি না করে সুনির্দিষ্টভাবে রোডম্যাপ ঘোষণার করার কথা আমরা বলেছি। আর ধর্মীয় স্বার্থবিরোধী কোনো কিছু তার দ্বারা হবে না বলে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের জানিয়েছেন।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন মানবজমিনকে বলেন, এই বৈঠককে আমরা চলমান সংকট উত্তরণের অগ্রগতি মনে করি। এর মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো গণঐক্যের দিকে হাঁটা শুরু হলো।

গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় অমীমাংসিত রয়ে গেছে

সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ আরও অনেক বিষয় অমীমাংসিত থেকে গেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে বেশকিছু সুপারিশের বিষয়ে আরও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখছেন তিনি।

এর মধ্যে বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের কাঠামো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতোবার নির্বাচিত হতে পারবেন, একজন সংসদ সদস্য কতোগুলো পদে থাকতে পারবেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া কী হবে- এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অমীমাংসিত থেকে গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম পর্বের সংলাপ শেষে অগ্রগতি তুলে ধরতে গতকাল সংসদ ভবনের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলন করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এ সময় কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।  

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার মধ্যদিয়ে জুলাই মাসের মধ্যেই একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মে মাসের শেষে বা জুনের শুরুতে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হবে। আমরা আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় একটি জাতীয় সনদ তৈরি করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের বিষয়ে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি।

সংবিধান সংস্কারে যেসব বিষয়ে একমত হওয়া গেছে তা তুলে ধরতে গিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ‘বহুত্ববাদ’ না রাখার ব্যাপারে অধিকাংশ দল মতামত দিয়েছে। অন্য চারটি মূলনীতির ব্যাপারে এক ধরনের ঐকমত্য আছে। তবে অনেক দল এই চারটির বাইরেও অন্যান্য বিষয় যুক্ত করার কথা বলেছে।
তিনি বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কিছু দল অবশ্য এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের প্রশ্নে এক ধরনের ঐকমত্য রয়েছে দলগুলোর মধ্যে। তবে এর পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। যারা সংসদের উভয় কক্ষের পক্ষে এবং যারা এক কক্ষবিশিষ্ট আইন সভার পক্ষে, উভয়ই আইন সভায় ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধী দল থেকে দেয়ার পক্ষে বলে জানান তিনি।
আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধানের ৪৮(ক) অনুচ্ছেদ যা কার্যত রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নির্ধারণ করে, তা সংশোধনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য কীভাবে হবে, সেই প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে।
আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা রদ করে আপিল বিভাগের প্রবীণতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করার প্রস্তাবে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। কোনো কোনো দল প্রবীণতম তিন বিচারকের মধ্যে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।

নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ক কমিশনের যেসব সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে তা তুলে ধরতে গিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, দল নিরপেক্ষ, সৎ, যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বিধান করার ব্যাপারে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা শপথ ভঙ্গ করলে মেয়াদ শেষে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করবে প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি। এরপর সেই কমিটি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ পাঠাবেন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে। এ বিধানের বিষয়ে বেশির ভাগ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখার প্রশ্নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে দলগুলো। এর আইনি দিক বিবেচনার জন্য অধিকাংশ দল গুরুত্ব দিয়েছে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে গণহত্যা ও নিপীড়নের সঙ্গে জড়িত এবং ভোট জালিয়াতি ও দুর্নীতির সঙ্গে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন প্রশ্নে অধিকাংশ দল একমত পোষণ করেছে।

তিনি বলেন, বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে পুনর্গঠন করে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করার ব্যাপারে বেশির ভাগ দল নীতিগতভাবে একমত পোষণ করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, দেশের পুরনো চারটি বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে বিভক্ত করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা, বিদ্যমান জেলা পরিষদ ব্যবস্থা বাতিল করা, ওয়ার্ড মেম্বারদের ভোটে পৌরসভার চেয়্যারম্যান নির্বাচিত হওয়া এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদটি বিলুপ্ত করার প্রস্তাবে বেশির ভাগ দল একমত হয়নি।
দুদক সংস্কার কমিশনের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, দুদক সংস্কারে কমিশনের সব সুপারিশের পক্ষেই মোটাদাগে রাজনৈতিক দলগুলো নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.