গাজা: বিবিসি সাংবাদিকের মর্মস্পর্শী বর্ণনা

সামনে ক্যামেরা গেলে আর কোনো কৌতূহল চোখে পড়ে না। শিশুরা তাকায়ও না ঠিকমতো। এমন এক শিশুকে আর কীইবা চমকে দিতে পারে, যে মৃতদের, মরণাপন্নদের আর মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা মানুষদের মাঝে বেড়ে উঠছে? ক্ষুধায় তারা নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারা সামান্য খাবারের জন্য কিংবা কিছু না পাওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ায়। গাজার শিশুদের নিয়ে এক মর্মস্পর্শী প্রতিবেদনে এভাবেই লিখেছেন সাংবাদিক ফারগাল কিয়ানি। তিনি লিখেছেন, বিবিসির হয়ে কাজ করা আমার সহকর্মী এবং তার ক্যামেরার উপস্থিতি তারা অনেক আগেই স্বাভাবিকভাবে নিতে শিখেছে। এসব শিশুর ক্ষুধা, মৃত্যু এবং তাদের দেহ অথবা দেহের টুকরোগুলো সাদা কাফনে জড়ানোর মুহূর্তগুলো প্রত্যক্ষ করেছেন। নিহত শিশুর যদি নাম জানা যায়, তা কাফনের উপর লেখা থাকে। ১৯ মাসের যুদ্ধে এবং এখন ইসরাইলের নতুন করে শুরু হওয়া হামলার মধ্যে এই স্থানীয় ক্যামেরাম্যান- যার নাম আমি নিরাপত্তার কারণে বলছি না, তিনি হাসপাতালের উঠানে বেঁচে যাওয়াদের কান্না শুনেছেন বারবার। সকালে তিনি খোঁজ করেছেন সিওয়ার আশুরের একটি পাঁচ মাস বয়সী মেয়েশিশুকে। তার কঙ্কালসার দেহ আর ক্লান্ত কান্না খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে তাকে এতটাই নাড়া দিয়েছিল যে, তখন তিনি আমাকে লিখেছিলেন- আমার ভেতরে কিছু একটা ভেঙে গেছে।

সিওয়ারের ওজন তখন মাত্র ২ কেজি (৪ পাউন্ড ৬ আউন্স)। যেখানে একজন পাঁচ মাস বয়সী শিশুর ওজন হওয়া উচিত প্রায় ৬ কেজি বা তারও বেশি। সিওয়ার একটি বিশেষ দুধের ফর্মুলা ছাড়া বাঁচতে পারে না। কারণ সাধারণ দুধে তার অ্যালার্জি দেখা দেয়। কিন্তু যুদ্ধাবস্থা এবং ইসরাইলি অবরোধে সেই ফর্মুলা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আমার সহকর্মী শুনেছেন, সিওয়ার এখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে এবং বাড়িতে আছে। তাই তিনি এসেছেন এই ধ্বংসস্তূপে পরিণত বাড়িঘরের মধ্যে তৈরি করা অস্থায়ী তাঁবু আর টিনের ছাউনির গলিতে।

তার খোঁজ চালানো খুবই কঠিন। কয়েকদিন আগে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেমন আছেন তিনি। জবাব দেন, আমি ভালো নেই। কিছুক্ষণ আগেই ইসরাইলি সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়েছে খান ইউনিসের বেশির ভাগ এলাকা খালি করতে হবে। আমরা জানি না কী করবো। কোথাও নিরাপদ জায়গা নেই। আল-মাওয়াসি এলাকা এখন গাদাগাদি করে থাকা উদ্বাস্ত দিয়ে ভরে গেছে। আমরা দিশেহারা, এখন ঠিক সিদ্ধান্ত কী হবে তাও জানি না।
শেষমেশ তিনি খুঁজে পান একটি এক-কামরার ঝুপড়ি ঘর, যার দরজার জায়গায় ঝোলানো আছে একটি ধূসর-কালো ফুলেল পর্দা। ভেতরে রয়েছে তিনটি গদি, একটি ভাঙা ড্রয়ার এবং একটি আয়না, যা রোদের আলো প্রতিফলিত করে ফেলেছে ছোট্ট সিওয়ার, তার মা নাজওয়া এবং দাদি রিমের সামনে। সিওয়ার শান্ত। তার মায়ের কোলে নিরাপদে আছে। কিন্তু শিশুটির স্বাভাবিক দুধ সহ্য হয় না, কারণ এতে তার মারাত্মক অ্যালার্জি হয়। ২৩ বছর বয়সী মা নাজওয়া জানান, নাসের হাসপাতালে থাকাকালীন অবস্থায় তার শারীরিক অবস্থা একটু ভালো হওয়ায় তাকে এক ক্যান ফর্মুলা মিল্কসহ হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন বাড়িতে সেই একমাত্র ক্যানটি শেষ হওয়ার পথে। আর শিশুটির ওজন আবার কমতে শুরু করেছে। নাজওয়া বলেন, ডাক্তাররা বলেছিলেন সিওয়ার আগের চেয়ে ভালো আছে। কিন্তু আমি মনে করি ও এখনো খুবই দুর্বল। তেমন উন্নতি হয়নি। শুধু এক ক্যান দুধ পেয়েছিল, সেটাও প্রায় শেষ। সিওয়ারের মুখের সামনে মাছিরা ঘুরে বেড়ায়। পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ- বলেন নাজওয়া। মাছিগুলো ওর গায়ে বসতে চায়, আমি ওকে কাপড়ে ঢেকে রাখি যাতে কিছু স্পর্শ না করে।

গত নভেম্বর থেকে জন্মের পর থেকেই সিওয়ার যুদ্ধের আওয়াজে বেড়ে উঠেছে। কামান, রকেট, বোমা-  কাছ থেকে ও দূর থেকে বন্দুকের শব্দ, ইসরাইলি ড্রোনের শব্দ। নাজওয়া বলেন, সে এসব শব্দ বুঝে গেছে। ট্যাংক, যুদ্ধবিমান, রকেটের শব্দ খুবই কাছ থেকে আসে। এসব শব্দে সিওয়ার ভয় পায়, কাঁদতে থাকে। ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে ওঠে আতঙ্কে। গাজার ডাক্তাররা বলছেন, অনেক নতুন মা দুধ খাওয়াতে পারছেন না অপুষ্টির কারণে। সবচেয়ে জরুরি সমস্যা এখন খাদ্য এবং পরিষ্কার পানি।

সিওয়ার জন্মের সময় নাজওয়াও ছিলেন অপুষ্টিতে ভোগা এক মা। তিনি ও তাঁর মা রিম এখনও ঠিকমতো খাবার জোগাড় করতে পারছেন না। এটি তাদের প্রতিটি মুহূর্তের লড়াই। বলেন- আমাদের ক্ষেত্রে, আমরা দুধ বা ডায়াপার দিতে পারি না, দাম আর সীমান্ত বন্ধ থাকার কারণে।

২২ মে ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করে, গাজায় খাদ্য ঘাটতির কোনো প্রমাণ নেই। তারা বলেছে বেশ ভালো পরিমাণে শিশু খাদ্য ও ময়দা কয়েক দিনে গাজায় পাঠানো হয়েছে। তবে সাহায্য সংস্থা, জাতিসংঘ এবং অনেক বিদেশি সরকার, এমনকি বৃটেন এই দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও গাজার মানুষদের ‘অনাহারে ভোগা’র কথা উল্লেখ করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ইসরাইল যে সহায়তা ঢুকতে দিচ্ছে তা এক চামচের মতো। তিনি বলেন, ফিলিস্তিনিরা সম্ভবত এই নির্মম সংঘাতের সবচেয়ে নিষ্ঠুর অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।  জাতিসংঘের মতে, গাজার শতকরা ৮০ ভাগ অঞ্চল এখন হয় ইসরাইলি সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন বা মানুষদের সেখান থেকে সরতে বলা হয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.