রায়ের বাজার কবরস্থান: ৩৯ দিনে ১১৪ বেওয়ারিশ লাশ দাফন by শরিফ রুবেল

কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরে সরকার পতনের আন্দোলনের সময়  মোহাম্মদপুর রায়ের বাজার কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের সংখ্যা হঠাৎ বেড়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এই কবরস্থানে গত ২২শে জুলাই থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ১১৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি লাশ দাফন করা হয় জুলাই মাসে। আন্দোলন চলাকালে জুলাই মাসের ২২ তারিখ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত ৬দিনে সেখানে ৪২টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়।  গোরস্থানের ৪ নম্বর ব্লকে ওয়াকওয়ে ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে  বেওয়ারিশ এই লাশগুলো দাফন করা হয়। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রতিদিনই নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে কবরস্থানে মানুষ আসছে। অনেকে আন্দোলনে তাদের স্বজন মারা গেছে- এমন প্রমাণপত্র নিয়ে আসছেন। কেউ কেউ লাশের ছবি, ভিডিও নিয়ে আসছেন। অনেকে আঞ্জুমান থেকে লাশের ছবি দেখে শনাক্ত করে সোজা কবরস্থানে চলে আসছেন। কিন্তু আমরা তাদের লাশ দিতে পারছি না। কোন কবর কার তাও বলতে পারছি না। কারণ দাফন হওয়া ১১৪টি লাশের মধ্যে কোনটি কার কবর সেটা আমাদের জানার সুযোগ নেই। পরিবারকে আমাদের বডি দেয়ার কোনো সাধ্য নেই। এখন লাশ শনাক্ত করতে হলে কবর খুঁড়ে ডিএনএ যাচাই করতে হবে। একজনকে লাশ দিতে হলে ১১৪টি কবর খুঁড়েই ডিএনএ পরীক্ষা করতে হবে। এই প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল ও কষ্টসাধ্য। এজন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। তবে দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে এসব কাজ শেষ না করলে, পরে বেওয়ারিশদের পরিচয় নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে।

সরজমিন দেখা গেছে, কবরস্থানের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে হাতের বামে একটু হেঁটেই ৪ নম্বর ব্লক। এই ব্লকের শেষ মাথায় ৪ ফিট পাকা রাস্তার পাড় ঘেঁষে সারিবদ্ধভাবে ১১৪টি নতুন কবর দেয়া হয়েছে। কবরের মাটিগুলো যত্রতত্র পড়ে আছে। বৃষ্টিতে কবরের উঁচু রেখা মিলিয়ে গেছে। কবরের উপরে ও পাশে মানুষের পায়ের ছাপ দেখা গেছে। কাঁচা ঘাস ছেঁটে কবরের পাশেই ফেলে রাখা আছে। দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে। ওই কবরের পাশে কয়েকজন মানুষকে খণ্ড খণ্ড করে নতুন বাঁশ কাটতে দেখা গেছে। বাঁশগুলো ফেড়ে কবরের পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সারিবদ্ধ ওই কবরের পাশে ৪ থেকে ৫ জন মহিলাকে তাদের স্বজনের লাশ খুঁজতে দেখা গেছে। এই ব্লকে আরও শত শত বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। কবরস্থানের অন্যান্য কবরে মৃত ব্যক্তির নামফলক থাকলেও বেওয়ারিশ কবরগুলোতে কোনো নামফলক দেখা যায়নি। পুরনো অধিকাংশ কবরই ঝোপঝাড়ে পরিণত হয়ে মাটির সঙ্গে মিলিয়ে গেছে। কবরগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

একজন গোরখোদক মানবজমিনকে বলেন, আমরা ২২শে জুলাই শুক্রবার রাত থেকে দাফন শুরু করি। লাশ এসেছে আর দাফন করেছি। একসঙ্গে ১০ থেকে ১২টি লাশও এসেছে। আমি এখানে প্রায় ৫ বছর কাজ করি। এত বেওয়ারিশ লাশ এই গোরস্থানে আগে কখনো আসেনি। আগে এখানে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪টি বেওয়ারিশ লাশ আসতো। এখন অনেক আসতেছে। এই ব্লকে ৯টি লাইন পুরোটাই বেওয়ারিশ লাশের।  

রায়েরবাজার কবরস্থানের বেওয়ারিশ লাশ দাফনের রোস্টার খাতা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম গত ২২শে জুলাই থেকে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত কবরস্থানটিতে ১১৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছে। এরমধ্যে ২২শে জুলাই একদিনেই ১১টি লাশ দাফন করা হয়। এরপর ২৩শে জুলাই ১টি, ২৪শে জুলাই ৯টি, ২৫শে জুলাই ৩টি, ২৭শে জুলাই ৭টি, ২৮শে জুলাই ১১টি। এছাড়া ১২ই আগস্ট ২টি, ১৯শে আগস্ট ৮টি, ২১শে আগস্ট ৭টি, ২২শে আগস্ট ৩টি, ২৬শে আগস্ট ৩টি, ৩১শে আগস্ট ১০টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়।

ওই কবরস্থানের প্রধান গোরখোদক গোলাম রব্বানী মানবজমিনকে বলেন, আঞ্জুমান ছাড়া অন্য কেউ বডি দেয়নি। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে। তখন প্রতিদিন অনেক লাশ আসতো। আমরা আগেই কবর খুঁড়ে রাখতাম। লাশ এলেই দাফন করা হতো। এখন পর্যন্ত আমরা ১১৪টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করেছি। এখানে কারা গুলিতে মারা গেছে, আর কারা স্বাভাবিকভাবে মারা গেছে তা আমাদের জানার সুযোগ নেই। আঞ্জুমান লাশ গোসল দিয়ে প্যাকেট করে নিয়ে আসে। আমরা শুধু দাফন করি। কাফন খুলে দেখার সুযোগ নেই।

কবরস্থানের ইনচার্জ মাওলানা ফেরদৌস আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এই কবরস্থানে ঢাকা মেডিকেল, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও  সোহ্‌রাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ থেকে লাশ এসেছে। আমরা দাফন করেছি। লাশের পরিচয় বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আঞ্জুমান প্রতিটি লাশের ছবি তুলে রেখেছে। যেসব লাশের ফরেনসিক হয়েছে তারা আমাদের সেই ফরেনসিক নম্বরটি দিয়েছে। আমরা আমাদের রোস্টার খাতায় তা লিখে রেখেছি। আর ডাবল লাশ দাফনের তথ্য মিথ্যা। আমাদের এখানে ডাবল বডি দাফন করার কোনো সুযোগ নেই। কে কি অভিযোগ করলো এসব নিয়ে আমরা ভাবছি না।

উল্লেখ্য, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে সারা দেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ৮ শতাধিক মানুষ নিহত হন। আহত হন ২০ হাজারের বেশি মানুষ। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে ঢাকার রামপুরা, বাড্ডা, মালিবাগ, যাত্রাবাড়ী, মহাখালী, মৌচাক, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, প্রগতি সরণি, কাজীপাড়া ও মিরপুর এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়। হেলিকপ্টার থেকে মিরপুর-১০, মিরপুর ৬, মোহাম্মদপুর, রামপুরা ও যাত্রাবাড়ীসহ কয়েকটি এলাকায় আন্দোলকারীদের ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও গুলি ছোড়া হয়।

No comments

Powered by Blogger.