ইমনের মায়ের কান্না থামছে না by শুভ্র দেব

পরিবারের ছোট সন্তান ইমন মিয়া (১৭)। মা-বাবা, ভাই-বোনদের আদরের ছিলেন। বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। বাবা মো. সেলিমের মৃত্যুর পর পরিবারে অভাব দেখা দেয়। তাই বড় ভাইয়ের সঙ্গে সংসারের হাল ধরেন ইমন। বড় ভাই অসুস্থ। সবসময় কাজে যেতে পারেন না। তাই তার আয় কম ছিল। প্রাপ্তবয়স্ক না হলেও ইমনের ওপর সংসারের পুরো দায়িত্ব ছিল। নিজের খরচ, বাড়িতে মায়েরও যাবতীয় খরচ চালাতেন। কিন্তু ১৯শে জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে একটি বুলেটে ইমনের জীবন প্রদীপ অকালেই নিভে যায়। মিইয়ে যায় পরিবারের সব আনন্দ। ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ৩রা আগস্ট না ফেরার দেশে চলে যান ইমন। আদরের ছোট ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন ইমনের মা। ছেলে হারানোর কষ্ট সইতে না পেরে তিনি এখন স্তব্ধ। নিহত ইমন মিয়া গুলশানের একটি হোটেলে চাকরি করতেন। রাজধানীর বাড্ডা নতুনবাজার এলাকার বাঁশেরটেক বস্তির একটি বাসায় বোনের সঙ্গে থাকতেন। তিনি কুমিল্লার মুরাদনগর থানা এলাকার মৃত সেলিম  মিয়া ও রেহেনা বেগমের ছেলে। চার ভাই-বোনের মধ্যে ইমন সবার ছোট ছিলেন।

১৯শে জুলাই সকালে ঘুম থেকে ওঠেন ইমন। নাস্তা করেই গুলশানের কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য রওনা হন। বাসা থেকে বের হয়ে নতুনবাজারের পার্শ্ববর্তী ১০০ ফুট রাস্তা দিয়ে ভাটারা থানার দিকে আসামাত্রই একটি গুলি তার শরীরে লাগে। গুলি লাগা মাত্রই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইমন। তবে কে গুলি করেছে, কোথা থেকে গুলি করেছে তিনি টের পাননি। এদিক-ওদিক তাকানোর সময় পাননি। তবে ওই এলাকায় গত কয়েকদিন ধরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটছিল। ইমনের পেছন পেছন অপরিচিত একজন সেদিক দিয়েই যাচ্ছিলেন। ইমনের গুলি লাগার দৃশ্য দেখে তিনি সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে বনশ্রীর ফরায়েজি হাসপাতালে নিয়ে যান। ইমনের কাছ থেকে মোবাইল নম্বর নিয়ে তার বোনকে ফোন করে জানান। খবর পেয়ে ইমনের বড় বোন তাহমিনা, তার স্বামী ও বড় বোন ইমরান হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছান। তারা গিয়ে দেখতে পান ইমনের শরীর থেকে অঝোর ধারায় রক্ত পড়ছে। চিকিৎসকরা তার রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছিলো না। পরে সেখানকার চিকিৎসকরা তাদের জানিয়ে দেন উন্নত চিকিৎসার জন্য ইমনকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিতে হবে। পরে চিকিৎসকদের কথামতো স্বজনরা তাকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা খরচ সাধ্যের মধ্যে না হওয়াতে ১ ঘণ্টা রেখে প্রায় ১০ হাজার টাকা বিল পরিশোধ করেন। তাকে নেয়া হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। অবস্থা গুরুতর হওয়াতে স্বজনরা ইমনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন।

ইমনের বড় বোন তাহমিনা গতকাল মানবজমিনকে বলেন,  ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকরা আমাদেরকে রক্ত আনার কথা বলেন। ওইদিন চতুর্দিকে ঝামেলা ছিল। তাই কোথাও রক্ত পাওয়া যায়নি। আমার স্বামী অনেক কষ্ট করে রক্ত ম্যানেজ করেন। তারপর তার অস্ত্রোপচার শুরু হয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। সাধারণ বেডে দেয়ার পরে তার সেলাই’র স্থান থেকে নীল বর্ণের পানি বের হচ্ছিল। চিকিৎসকরা পরীক্ষা করে দেখেন সেখানে ইনফেকশন হয়ে গেছে। এ রকম অবস্থায় তার আবার অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরে আবার সেখান দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়। চিকিৎসকরা তখন বলেন, তার পায়খানার রাস্তায় গুলির আঘাত লেগেছে। তখন আবার অস্ত্রোপচার করা হয়। এভাবে একের পর এক অস্ত্রোপচারের পরও তার শরীরে কোনো পরিবর্তন আসছিল না। চিকিৎসকরা সব চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আমাদের জানান, গুলিতে ইমনের শরীরের ভেতরটা ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। এজন্য অস্ত্রোপচারের পরও কোনো উন্নতি হচ্ছে না। তাই আমরা যেন আর কোনো আশা না করি। এভাবে যে কয়দিন সম্ভব বেঁচে থাকবে। আমাদের তখন আর কোনো উপায় ছিল না। চিকিৎসকদের কথা শুনে আমরা আর সইতে পারছিলাম না। চোখের সামনে আদরের ছোট ভাইয়ের এমন অবস্থা দেখে আমরা সবাই ক্রমশ অসহায় হয়ে পড়ি। চিকিৎসকরাও কম চেষ্টা করেননি। এভাবে ৩রা আগস্ট হঠাৎ করে তার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়। তাকে আবার অস্ত্রোপচার করে বেডে দেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।  

তিনি বলেন, ৯ বছর আগে আমার বাবা মারা গেছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। আমার বিয়ে হয়েছিল আগেই। তাই আমি দুই ভাইকে ঢাকায় এনে একজনকে হোটেলে আরেকজনকে মুদির দোকানে কাজে দেই। আমার ভাই ইমরানের বাতজ্বরের সমস্যা। তাই সে বাসায় থাকতো। বেতন কম পেতো। আর ইমন প্রথমদিকে আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে একই হোটেলে চাকরি করতো। ১ মাস বাড়িতে থাকার কারণে তার জায়গায় অন্য লোক নেন হোটেল কর্তৃপক্ষ। পরে গুলি লাগার ১৭ দিন আগে গুলশানের ছোট্ট একটি হোটেলে কাজ নেয়। ১৮ দিনের মাথায় তার গুলি লাগে। হাসপাতালে ১৭ দিন থাকার পর তার মৃত্যু হয়। তাহমিনা আরও বলেন, ইমনকে হারিয়ে মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে কিছুতেই সান্ত্বনা দেয়া যাচ্ছে না। সবসময় তিনি কান্না করছেন। তার চোখ থেকে পানি পড়া বন্ধ হচ্ছে না। এমনিতেই অসুস্থ। উচ্চ রক্তচাপসহ নানা সমস্যায় তিনি ভুগছেন। বয়স ৬৫ পার হয়েছে। বয়সজনিত নানা সমস্যাও আছে। এরমধ্যে ছেলের মৃত্যুর খবর তিনি এখনো মেনে নিতে পারছেন না। একদিকে ইমনের মৃত্যু। অন্যদিকে সংসারে অভাব- অনটন। কারণ ইমন সংসারের বড় খরচ বহন করতো। কিন্তু এখন সবকিছু পাল্টে গেল।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.