খাদ্য সরবরাহে অস্থিরতা তৈরির পাঁয়তারা

খাদ্য সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার পাঁয়তারা করছে একটি পক্ষ। খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার পেছনে খোদ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর যোগসাজশ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। গত ৫ই  আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর খাদ্য সরবরাহ নিয়ে ঘন ঘন সার্কুলার জারি ও পরিবর্তন করা হচ্ছে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

গত ২৪শে আগস্ট খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সরবরাহ-১ শাখার উপসচিব কুল প্রদীপ চাকমা স্বাক্ষরিত সার্কুলারে বলা হয়, বিভিন্ন কর্মসূচি কাবিখা, ভিডব্লিউবি, ভিজিএফ, ওএমএস, খাদ্যবান্ধব, টিআর, জিআরসহ অন্যান্য রেশনিং খাতে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য খাদ্য মন্ত্রণালয় তথা খাদ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন গুদাম হতে বিতরণ করা হয়। বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য গুদাম হতে উত্তোলন/বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা/জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে বিতরণ আদেশ (ডিও) জারি করা হয়। খাদ্যশস্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বিতরণ আদেশ (ডিও) জারি করার তারিখেই অর্থাৎ একই কর্মদিবসের মধ্যে গুদাম হতে খাদ্যশস্য বিতরণ/উত্তোলন করা আবশ্যক।
ওই সার্কুলারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা বলা হয়। যেমন: খাদ্যশস্যের বিতরণ আদেশ (ডিও) জারি করার পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গুদাম হতে খাদ্যশস্য বিতরণ/উত্তোলন করতে হবে; বিতরণ আদেশাধীন খাদ্যশস্য কোনোভাবেই গুদামে মজুত রাখা যাবে না; বিতরণ আদেশাধীন খাদ্যশস্য কোনো গুদামে মজুত পাওয়া গেলে অনিয়মের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আবার গত ৯ই সেপ্টেম্বর স্মারক নং ১৭২ মোতাবেক বলা হয়, খাদ্যশস্যের বিতরণ আদেশ (ডিও) জারি করার পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে গুদাম হতে খাদ্যশস্য বিতরণ/উত্তোলন করতে হবে। একইসঙ্গে গত ২৪শে আগস্টের পত্রটি বাতিল করা হলো।
এর আগের সার্কুলারে সাধারণত সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, আনসার ডেলিভারি আদেশ (ডিও) জারির পর এসব বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মাসের যেকোনো দিন পছন্দমাফিক সময়ে খাদ্য গুদাম থেকে মালামাল উত্তোলন করতে পারতেন। খাদ্য বিভাগের দীর্ঘদিনের রীতি ভেঙে ৫ই আগস্টের পর মালামাল উত্তোলন সংক্রান্ত এমন নির্দেশনা কেন জারি করতে হলো সে সম্পর্কে খাদ্য সচিব কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি।

ডিলারদের অভিযোগ, এভাবে বার বার সার্কুলার পরিবর্তন করা হলে আমাদের গুদাম থেকে খাদ্য উত্তোলন করা অসম্ভব। মালামাল গুদাম থেকে বের করার জন্য পরিবহন, শ্রমিক ও অফিসের কাগজপত্র তৈরি করার বিষয় থাকে, যা সময়সাপেক্ষ। সার্কুলার জারি করে একদিনেই মালামাল উত্তোলন করা বেশ চ্যালেঞ্জ। এটা নিঃসন্দেহে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র।
খাদ্যপণ্য উত্তোলনের নিয়ম: চাল/আটা/গম উত্তোলনের জন্য ডিলারকে চাহিদাপত্র দেয়ার সময় আগের দিনের অবিক্রীত খাদ্যশস্য (যদি থাকে) সমন্বয় করে পরবর্তী দিনের চাহিদাপত্র তৈরি করতে হয়। প্রতিটি দোকানে কমপক্ষে ২ দিনের বিক্রয়যোগ্য খাদ্যশস্য একসঙ্গে উত্তোলন করতে হয়। তবে কোনো ডিলার ইচ্ছা করলে ও সংরক্ষণ সুবিধা থাকলে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দিনের বিক্রয়যোগ্য খাদ্যশস্য উত্তোলন করতে পারে। বিক্রির দিনে খাদ্যশস্যের মূল্য কমপক্ষে একদিন আগে সরকারি কোষাগারে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে চাল/আটা/গম উত্তোলন করতে হয়। সরকারি গুদাম হতে সরবরাহকালে চাল/আটা/গমের নমুনা গ্রহণ করতে হয়। গুদাম কর্মকর্তা ও ডিলারের যৌথ স্বাক্ষরে সিলগালাকৃত একটি করে নমুনা গুদামে ও অপরটি ডিলারের নিকট সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করে একজন ডিলার বলেন, আগের সরকারে সুবিধাভোগী মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।
সাবির্ক বিষয়ে খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন বলেন, বর্তমানে অফিসিয়াল কাজকর্ম অনেক সহজ হয়েছে। দিনে দিনেই খাদ্য উত্তোলন করা সম্ভব। আর স্বচ্ছতা আনয়নের জন্যই আগেরটা বাতিল করে নতুন নিয়মে সার্কুলার দেয়া হয়েছে। এখানে ষড়যন্ত্র দেখার সুয়োগ নেই।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, খাদ্য সচিব ইসমাইল হোসেন তার সিনিয়রকে সুপারসিড করে সচিব হন। খাদ্য অধিদপ্তরের ডিজি ছিলেন ১০ম বিসিএসের কর্মকর্তা শাখাওয়াত হোসেন। আর ইসমাইল হোসেন এনডিসি নিজে ১১তম বিসিএসের কর্মকর্তা।
সচিব ইসমাইল হোসেন সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনির আস্থাভাজন হিসেবে চাঁদপুরের ডিসির দায়িত্ব পালন করার সময় বালুখেকো সেলিম চেয়ারম্যানের মাধ্যমে মেঘনা নদী ধ্বংস করে বালু বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আওয়ামী সরকারের পতনের পর খাদ্য অধিদপ্তরের ক্যাডার কর্মকর্তাদের সময়ের আগে বদলি করার অভিযোগ উঠেছে সচিব ইসমাইল হোসেনের বিরুদ্ধে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায়ে বদলি বাণিজ্য করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বদলির তথ্য সংগ্রহের জন্য গত কয়েক দিন আগে জরুরিভিত্তিতে তালিকা দিতে অধিদপ্তরকে পত্র দিয়েছেন ইসমাইল হোসেন। তার এই বদলি বাণিজ্যের সঙ্গে এজেন্ট হিসেবে খাদ্য অধিদপ্তরের একজন কথিত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে দায়িত্ব প্রদান করেছেন তিনি। বদলি প্রত্যাশীদের কাছ থেকে অর্থ নেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে মাঠপর্যায়ে বদলি আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে জানান এই কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়ে এমন কার্যকলাপে স্থিতিশীল খাদ্য বিভাগ এখন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসমাইল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এসব গল্প ভিত্তিহীন। যারা এসব বলছেন তারা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.