আরইবি’তে সাবেক এমপি শামীমের সাম্রাজ্য: এক প্রকল্প থেকেই ৩০০ কোটি লোপাট by মারুফ কিবরিয়া

কুমিল্লা-৮ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবু জাফর মো. শফিউদ্দিন শামীম। এমপি হয়ে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে গড়ে তুলেছিলেন নিজের সাম্রাজ্য। সংস্থাটির যেকোনো প্রকল্পের ঠিকাদার ছিল শামীমের নিজস্ব মালিকানা প্রতিষ্ঠান টিএস ট্রান্সফরমার। জানা গেছে, আরইবি’র উপকেন্দ্র নির্মাণে ৭৭৩ কোটি টাকার দরপত্র ১ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ ও স্মার্ট মিটার প্রকল্পে বেশি দর দিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় সাবেক এমপি শামীমের সরাসরি সম্পৃক্ততার অভিযোগ করেছেন আরইবি’র একাধিক কর্মকর্তা। তারা জানান, দরপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে বিদ্যুতের এই খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেন সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের এই চেয়ারম্যান। অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও (বিএফআইইউ)। এরই মধ্যে সংস্থাটির পক্ষ থেকে তার ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আরইবি’র খুলনা জোনের উপকেন্দ্র আধুনিকায়নের প্রকল্পেই ২২৭ কোটি টাকা বাড়তি বিল গুনতে হবে আরইবিকে। আগের কাজ শেষ না হতেই আরও একটি লটে সাবেক এমপি শামীমের প্রতিষ্ঠান টিএস ট্রান্সফরমারকে অস্বাভাবিক দরে কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল। তবে সরকারের পটপরিবর্তনের কারণে নতুন লটের যাচাই-বাছাইয়ের দাবি উঠেছে। প্রতিযোগিতামূলক দর নিশ্চিত করা গেলে কমপক্ষে একশ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তারা।

সূত্র আরও জানায়, গত দেড় দশকে শামীম একটানা আরইবি নিয়ন্ত্রণ করে গেছেন। সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তুলেন তিনি। ২০২২ সালে ৮টি প্যাকেজের আওতায় ৩৭টি জিআইএস সাবস্টেশন নির্মাণের দরপত্র চাওয়া হয়। দ্বৈত খাম পদ্ধতির ওই দরপত্রে ৯টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিলেও কৌশলে ৬ প্রতিষ্ঠানকে বাতিল করে দেয়া হয়। এ জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কারণ জানতে চাইলে নানা রকম ভয়-ভীতি দেখানো হয়। নামকরা একাধিক কোম্পানি দরপত্র জমা দিলেও যৌক্তিক কারণ ছাড়াই দরপত্র বাতিল করা হয়। কাজ পাবে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান, সেটি নিশ্চিত করতে যা প্রয়োজন তাই করেছেন প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমান ও দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি (টিইসি)।

প্যাকেজ কেডি ডব্লিউ-১ এর আওতায় ছিল ৫টি (২*১০/১৪ এমভিএ) উপকেন্দ্র। প্যাকেজের প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ২৮৪ ইউএস ডলার। কিন্তু টিএস ট্রান্সফরমার জেভি এনার্জি প্যাককে ১ কোটি ২৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৯ ইউএস ডলারে কার্যাদেশ দেয়া হয়। যা প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। টিএস ট্রান্সফরমার জেভি এনার্জি প্যাককে মোট ৫টি প্যাকেজে ৩৫টি সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ দেয়া হয়, যার প্রত্যেকটিতে ৩০ শতাংশ দর বাড়িয়ে দেয়া হয়। এভাবে ৭৭৩ কোটি টাকার দরপত্রে ১ হাজার কোটি টাকা বিল প্রদান করে আরইবি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরইবি’র এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের উপকেন্দ্র নির্মাণ দরপত্রে প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে এত বেশি বাড়িয়ে দেয়ার ঘটনা নজিরবিহীন। টিএস ট্রান্সফরমার শুধু উপকেন্দ্র নির্মাণে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। স্মার্ট মিটার, ট্রান্সফরমার ও খুঁটি সরবরাহ থেকেও কয়েকশ’ কোটি টাকা লুটপাট করেছে। শফিউদ্দীনের অপর প্রতিষ্ঠান এসকিউ ওয়্যার অ্যান্ড ক্যাবলসের মাধ্যমে ৬ হাজার টাকা দরে যে মিটার দেয়া হয়, একই মিটারের বিপরীতে আগের লটের বিল নিয়েছে ১২ হাজার টাকার উপরে। আরএফ মডিউলসহ সিঙ্গেল ফেজ মিটার ১২ হাজার ২৫৩ টাকা দরে বিল তুলেছে ২০২২ সালে। ওই টেন্ডারের ১০ মাস পর ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এ (প্যাকেজ ২৩-২৪ ঢাকা পিবিএস-১.০ অ্যান্ড এম-১) খোলা দরপত্রে একই মিটার মাত্র ৬৩৮২ টাকায় দর জমা দেয়। এমন সব অসঙ্গতি থাকলেও আরইবি’র তৎকালীন চেয়ারম্যানসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিশ্চুপ ছিলেন।

সূত্র জানায়, ৪ লাখ ৯০ হাজার সিঙ্গেল ফেজ মিটার ক্রয় ও স্থাপনে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে শামীমের বিরুদ্ধে। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিযোগিতামূলক কাজ দেয়া গেলে অর্ধেক দামে মিটার স্থাপন করার সুযোগ ছিল। সাবেক এমপি শামীমের এসব দুর্নীতি ও অনিয়মে আরইবি’র কিছু কর্মকর্তাও সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। যারা আরইবি’র স্বার্থ না দেখে টিএস ট্রান্সফরমারের পক্ষে কাজ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। টিএস ট্রান্সফরমারকে কাজ দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন ওই প্রকল্পের পরিচালক মাহবুবুর রহমান, আরইবি’র সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী।

সূত্রমতে, ৪ লাখ ৯০ হাজার মিটারের সঙ্গে এক হাজার ৬০০টি ডিসিইউ, ছয় হাজার ৪০০টি রিপিটারের মূল্য বিবেচনায় নিলে প্রতিটি মিটারের জন্য সরকারের ব্যয় দাঁড়াবে ২৫ হাজার ২০৬ টাকা। সব মিলিয়ে স্মার্ট মিটার স্থাপনের একটি লটে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার জালিয়াতি করা হয়েছে।
স্মার্ট প্রি-পেইড মিটারের আন্তর্জাতিক বাজারদর হিসাব করে দেখা গেছে, এই প্রকল্পের টেন্ডার জালিয়াতি করে পুকুরচুরি করা হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের দরপত্রে চাওয়া সিঙ্গেল ফেজ ইলেকট্রিক মিটারের দাম ছয় ডলার থেকে শুরু করে ভালো মানের মিটারের দাম ৩৫ ডলার। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে এই মিটারের দাম সর্বনিম্ন ৭০০ থেকে শুরু করে ৪ হাজার ২০০ টাকা (এক ডলার সমান ১২০ টাকা)। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড যদি ভালো মানের মিটারের দরপত্রও আহ্বান করে তাহলে প্রথম লটে প্রতিটি মিটারে প্রায় আট হাজার ৫০০ টাকা বেশি দাম ধরে কাজ দিয়েছে। আর দ্বিতীয় লটের কাজেও প্রায় দুই হাজার ২০০ টাকা বেশি দামে কাজ দেয়া হয়েছে।

স্মার্ট মিটার স্থাপন প্রকল্পে জালিয়াতি করায় সরকারের পাশাপাশি গ্রাহকদের ওপরও বাড়তি অর্থের চাপ পড়েছে। কারণ প্রতিটি মিটার ক্রয়ের অর্থ বাবদ গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি মাসে ২০০ টাকা করে কেটে নেয়া হয়েছে। অর্থাৎ মিটার ক্রয়ে জালিয়াতির কারণে বাড়তি অর্থ গুনতে হয়েছে গ্রাহকদের। যদি সঠিক দামে এসব মিটার কেনা হতো তাহলে প্রতি মাসে মিটার চার্জ বাবদ গ্রাহকদের অনেক কম অর্থ পরিশোধ করতে হতো।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে আরইবি’র সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তীকে কল করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। অন্যদিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টিএস ট্রান্সফরমারের মালিক ও সাবেক এমপি শামীমের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালক মাহবুবুর রহমানও ফোন কলে সাড়া দেননি।  

mzamin

No comments

Powered by Blogger.