জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল গঠন জরুরি by শহীদুল্লাহ ফরায়জী

বিশ্বে যখন মক্কেলরাষ্ট্র স্থাপন বা ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে আধিপত্য বিস্তারের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আকাক্সক্ষা দৃশ্যমান হচ্ছে, অন্য রাষ্ট্রের ভেতর অভিযান পরিচালনা করে সার্বভৌমত্ব করায়ত্ত বা দখল করার প্রবণতা এবং আক্রমণাত্মক সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, শক্তিশালী রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর হামলা, পারমাণবিক অস্ত্রের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি ক্রমাগত বাড়ছে, তখন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা তথা ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল’ গঠন নিয়ে সুগভীর বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি ক্রমাগত বাড়ছে এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ছে। এ বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিলে বিপর্যয়কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী ’৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠেছে। বিশ্ব রাজনীতির আধিপত্যবাদী ও সর্বগ্রাসী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে সশস্ত্রযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিরক্ষা বাহিনীর ঐতিহাসিক ভূমিকা অপরিসীম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা মৃত্যুকে উপেক্ষার মাধ্যমে অসাধারণ সাহসিকতার সঙ্গে, বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কার্যকর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। স্বাধীনতা অর্জনের প্রশ্নে জনগণের সঙ্গে প্রতিরক্ষা বাহিনীর অকুতোভয় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার ঐতিহাসিক মহত্ব এখনো আমরা যথাযথ নির্ধারণ করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের পরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আমরা কোনো সামষ্টিক স্মারক নির্মাণ বা ইতিহাসের ভাগীদারবোধ বা অংশীদারিত্ববোধ নির্মাণ করতে পারিনি। বরং সংকীর্ণ রাজনৈতিক চর্চায় অনেকের অবদানকে ইতিহাস থেকে ক্রমাগত বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছে, দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের অন্তর্ভুক্তি করতে গিয়ে অংশীদারদের বীরত্বকে ছত্রখান করে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে ছাত্র এবং সেনাবাহিনীর অপরিসীম ভূমিকাকে বিলীন করে দিতে চাওয়া হয়েছে। ফলে এখনো পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য কোনো ইতিহাস নির্মিত হয়নি।
বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতার দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সর্বজনগ্রাহ্য নেতৃত্ব, বীরত্ব ও সাহসিকতা-আত্মসাৎ করে যখন ‘এক নেতার এক দেশ’-এর ইতিহাস নির্মিত হয় তখন সমাজ বা দেশ আর সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয় না, সে পরস্পরের ভাগীদারবোধ তৈরি হয় না। জনগণের আকাক্সক্ষা-ভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ না হওয়ায় একেকজন রাজত্ব দখল করেছে, আবার কেউ এসে পূর্বতন রাজত্বকে বাতিল করে আবার নিজের রাজত্ব কায়েম করেছে।

পূর্বের বিশদ আলোচনাযোগ্য বিষয়ের দিকে না গিয়ে এই প্রবন্ধে গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনার রাজত্বের কথা স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করছি। তিনি ক্ষমতায় এসেই বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং জয় বাংলাকে দলীয় সম্পত্তি হিসেবে গ্রহণ করে মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াস, ২রা মার্চের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চের স্বাধীনতার ইশতেহার এবং জিয়াউর রহমানের সেনাবিদ্রোহ-সহ সবকিছুকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। জাতির পিতাকে ব্যক্তিগত পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, বীরউত্তম-এর মতো রাষ্ট্রীয় খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বলার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। মূলত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর অপরিসীম আত্মত্যাগ এবং অন্যান্য অবদানকে শেখ হাসিনা অনবরত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, অবজ্ঞা করেছেন, সর্বোপরি অস্বীকার করেছেন।

বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মধ্যদিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষাবাহিনী তথা সেনাবাহিনীকে নৈতিকভাবে তছনছ করে দেয়া হয়েছে। পেশাদার, দক্ষ ও উচ্চতম নৈতিকতার অধিকারী সেনা কর্মকর্তাদের কারণে-অকারণে বরখাস্ত করা, অব্যাহতি দেয়া, পদোন্নতি রোধ করা-সহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা এবং ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে সেনাদের মনোবল ভেঙে দেয়ায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার চেয়ে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ‘আয়নাঘর’ স্থাপন করে সেনাদের পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিকতা ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক দক্ষ সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন অজুহাতে নতজানু রাখা। উল্লেখ্য, ফ্যাসিবাদী সরকারকে উৎখাতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর অপরিসীম ভূমিকা-দেশকে প্রচণ্ড রক্তাক্তসংঘাত ও নৈরাজ্য থেকে রক্ষা করেছে।

এখন বাংলাদেশে গণমুখী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রায়োগিক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে নির্মাণ করা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই অনিবার্য হয়ে পড়েছে। গণহত্যায় দায়ীদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে। ফ্যাসিবাদী সরকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে কাঠামোগত প্রবঞ্চনা এবং ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করার ছলাকলা ছাত্র-জনতা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে উন্মোচিত করে দিয়েছে প্রতারণার যাবতীয় কৌশল।
প্রত্যেক রাষ্ট্রই বৈরী রাষ্ট্রের আক্রমণ থেকে বা অপর কোনো রাষ্ট্রের সীমান্ত অতিক্রমের আকাক্সক্ষা থেকে নিজেকে সুরক্ষার প্রয়োজনে শক্তিশালী ‘প্রতিরক্ষাবাহিনী’র গঠন অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ বিশ্বে বহু শক্তিশালী রাষ্ট্র রয়েছে যারা আত্মরক্ষার প্রয়োজন ছাড়াই শক্তির ব্যবহার করে বা সম্প্রসারণের দ্বারা অন্য রাষ্ট্রকে করায়ত্বে আনে। নিরাপত্তা দেয়াল বা পৃথক্করণ দেয়াল বা শান্তি প্রক্রিয়া কিংবা রোডম্যাপের বয়ান-মূলত বিকল্পহীন চলমান যুদ্ধেরই প্রক্রিয়া। গত কয়েকশ’ বছরে অনেক শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রমাণ করেছে-সাধারণ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে দুর্বল রাষ্ট্রের সীমান্ত গুঁড়িয়ে দিয়ে নিজেদের সীমানাকে বর্ধিত করা যায়। প্রতিপক্ষকে ভীতির মাধ্যমে গ্রাস করার প্রবণতা বিশ্বব্যাপী প্রবল। রাশিয়া ক্রমাগতভাবে ইউক্রেনের দখলীকৃত ভূমি নিজেদের ভূখণ্ডে অন্তর্ভুক্তি করছে। অভিযানের মাধ্যমে রাশিয়ার সীমান্ত বাড়ছে আর ইউক্রেনের সীমান্ত সংকুচিত হচ্ছে। ইসরাইল দিনের পর দিন গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে, দখল করে যাচ্ছে, দখলীকৃত ভূমিতে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করার পরও আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় তা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এই আধুনিক বিশ্বে পরাশক্তি নজিরবিহীনভাবে আধিপত্য বিস্তার করে যাচ্ছে এবং যাবে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শক্তিধর দেশগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর উপর হামলা-অভিযান বা আক্রমণ করার সহজাত এখতিয়ার যেমন প্রদর্শন করে তেমনি আক্রান্ত দেশগুলোর উপর যেকোনো সমরাস্ত্র প্রয়োগ করার ইচ্ছাও আড়াল করে রাখে না। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিবেশী দুর্বল দেশকে নিয়ন্ত্রণ বা দখল করার প্রদর্শনী প্রকল্প হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরাইল-প্যালেস্টাইন। এই আগ্রাসন সংক্রান্ত ইচ্ছাশক্তির বিশ্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব-ঝুঁকিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। বাংলাদেশ-ভারত এবং বাংলাদেশ-চীনের সম্পর্কের গুরুত্বও আমাদের অনুধাবন করতে হবে। বাংলাদেশ যেনো পরাশক্তির দৌড়ের মহড়ার ক্ষেত্রে পরিণত না হয় তাও আমাদেরকে বিবেচনায় রাখতে হবে। আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় সামরিক বা অর্থনৈতিক প্রশ্নে কূটনৈতিক সমর্থন পাওয়া যায় পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায়, কোনোক্রমেই তা মতাদর্শিক নয়। ফলে চিরস্থায়ী বন্ধু বা চিরস্থায়ী শত্রু বলার আখ্যান এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক বিদ্যমান বাস্তবতায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ঝুঁকিকে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিরক্ষা প্রশ্নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এ লক্ষ্যে সংক্ষিপ্ত প্রস্তাবনা নিম্নরূপ-

১) অতি ঝুঁকিবহুল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে আক্রমণাত্মক নয়, প্রতিরোধমূলক নীতির ভিত্তিতে অবিলম্বে ‘জাতীয় প্রতিরক্ষা কাউন্সিল’ গঠনপূর্বক যুগোপযোগী জাতীয় প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করা।
২) ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সকল নারী-পুরুষকে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
৩) র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে (জঅই) সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্তির আইন দ্রুত বাতিল করা।
৪) প্রতিরক্ষাবাহিনী সমূহকে আধুনিক, দক্ষ ও পেশাদার হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অভ্যন্তরীণ সংস্কারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৫) বাংলাদেশকে ‘পরমাণু অস্ত্রমুক্ত’ এলাকা ঘোষণার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৬) যুদ্ধ ও পরমাণু যুদ্ধের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থান স্পষ্ট করা।
আজকের বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থাতে সীমান্তকেন্দ্রিক রাষ্ট্র ও ভৌগোলিক নির্ভর রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রত্যেক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষাবাহিনী অনিবার্য। প্রতিরক্ষাবাহিনীর কৌশলের সাফল্য বা ব্যর্থতার উপর রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কার্যকর জাতীয় ঐক্য এবং পারস্পরিক স্বার্থ ও মর্যাদার ভিত্তিতে অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার আর কোনো বিকল্প নেই। জাতির সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে সুরক্ষা দেয়াই প্রজাতন্ত্রের সকলের নৈতিক কর্তব্য।

লেখক: গীতিকার ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com

mzamin


No comments

Powered by Blogger.