নখদন্তহীন দুদক কি তার শক্তি ফিরে পাবে? by বদরুল হুদা সোহেল

অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট এ প্রতিষ্ঠানটিকে সরকার যেন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করতে না পারে তার ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। দেশের জনসাধারণ সাক্ষী গোপাল হয়ে এতদিন সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুদক দুর্নীতির প্রশ্নে আবার সরব হয়েছে। সংস্কার না হলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে এর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাবে। গত মাসের শেষদিকে দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় টিআইবি ৫৫ দফার একটি প্রস্তাব রাখে। এর মধ্যে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়টিও প্রাধান্য পায়।

সেনাসমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদ সরকারের অব্যবহিত পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে দুর্নীতি দমন কমিশনে যোগদানের পর এক সম্মেলনে দুদকের তৎকালীন চেয়ারম্যান গোলাম রহমান দুদককে নখদন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। সেই সঙ্গে বাঘের সব নখ কেটে দেয়ার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ক্ষমতাহীন করার প্রক্রিয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। তার মেয়াদপূর্তিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিদায়কালীন সৌজন্য সাক্ষাতে চার বছরে দুদক আইন সংশোধন করতে না পারার আফসোস ও অসন্তোষের কথাও প্রকাশ করেন তিনি। তার একযুগ পর মহামারি করোনাকালীন ২০২১ সালে হাইকোর্ট এক পর্যবেক্ষণে দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে দন্তহীন বাঘের মতো আচরণ বা দন্তহীন বাঘ হলে চলবে না বলে মন্তব্য করেন। একই সালে দুদকের বিদায়ী চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ দুদককে একটি ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও জনগণের আস্থার প্রতিদান সেভাবে দিতে পারেননি বলেও মন্তব্য করেন। দুদক কাণ্ডারি দুদক চেয়ারম্যানরাই যদি তাদের কার্যাবলী নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তাহলে বুঝতে বাকি নেই ‘ডাল মে কুচ কালা হে’।

গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারী ছাত্রদের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন রাষ্ট্র সংস্কারের কথা ভাবছে। বিগত সরকারের আমলে  সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাগামহীন দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার গল্প এখন গণমাধ্যমগুলোর অন্যতম  খোরাক। ঠিক এই সময়ে সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে দুদক সংস্কার কমিশনে প্রধান হিসেবে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানকে দায়িত্ব দেন। ড. ইফতেখারুজ্জামান নখদন্তহীন দুদককে সংস্কার করে কোথায় নিয়ে যেতে পারবেন, তা সময়ই বলে দিবে। তবে তার হাত লাগলে দুদকে নখদন্ত গজানো শুরু করবে- এমনটা আশা করা যেতেই পারে। দুদকের বর্তমান গতিপথ কোনদিকে তা আলোচনার আগে এর প্রেক্ষাপট নিয়ে একটু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করি।

মূলত দুর্নীতি দমন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত হয়। সমাজের সর্বস্তরে প্রবাহমান একটি শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী সংস্কৃতির চর্চা এবং এর প্রসার সুনিশ্চিত করার রূপকল্প রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। কমিশনের আইনেই স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে যে, এটি হবে একটি স্বাধীন, স্বশাসিত ও নিরপেক্ষ কমিশন। কিন্তু কাগজে লেখা আইনে ‘স্বাধীন’ ও ‘নিরপেক্ষ’ শব্দগুলো বলা হলেও বাস্তবিক পক্ষে কমিশন তার স্বাতন্ত্র্য কতোটুকু ধরে রাখতে পেরেছে? আজ যে ব্যক্তিটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, কয়েক মাস আগেও দুদকেরই করা মামলায় তাকে লোহার খাঁচার তৈরি আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সর্বোচ্চ অসম্মান করা হয়েছে। দুদক আইনজীবীরা মরিয়া হয়ে তার বিরুদ্ধে যেভাবে লেগেছিল, অন্য কারও ক্ষেত্রে এমন হয়েছে বলে জানা নেই। গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ‘ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও চার মামলার প্রস্তুতি ছিল দুদকে’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা আগের মামলাটিও মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রেসক্রিপশন পালনের অংশ ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ইচ্ছা থেকেই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদক অবস্থান নেয় মর্মে যে সংবাদটি এখানে প্রকাশিত হয় তার উত্তর হিসেবে দুদক কী বক্তব্য দিবে? দুদক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করার জন্য এখন পর্যন্ত কি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে?

২০০৭ সালে ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসলে দুদক নড়েচড়ে বসে। দুর্নীতিবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনায় ওই সরকার তৎপর ছিল বলে সাধারণ মানুষের (যারা রাজনীতির বাইরে)  বড় একটি অংশ ভেতরে ভেতরে ওই সরকারকে পছন্দ করে। সে সময় দেড় শতাধিক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনীতিবিদ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ ও অন্যান্য দুর্নীতির অভিযোগে মামলা করা হয় এবং জেলেও পুরে দেয়া হয়।
এই এক-এগারোর পট পরিবর্তনে ড. ফখরুদ্দীন সরকার ক্ষমতায় আসলে দুদক তার ইতিহাসে সবচেয়ে জোরালো পদক্ষেপ নিলেও ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর অজ্ঞাতকারণে দুদকের কার্যক্রম আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে। শুধু চুনোপুঁটি ধরে লোকদেখানো কাজে ব্যস্ত ছিল প্রতিষ্ঠানটি। আর ওদিকে ক্ষমতাসীন সরকারের রাঘববোয়ালরা দুদককে থোড়াই কেয়ার করে করে ১৫টি বছর অতিক্রম করেছে।

মোটা দাগে বলা যায় দুদক নামক প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ দাবি করলেও বিগত বিভিন্ন সরকার তাদের মর্জিমাফিক কলকাঠি নেড়ে প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করেছে। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুদকের উপর বিগত সরকারের কোনো প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল কিনা তা এখন জানার সময় এসেছে। দুদক কি সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান? যদি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদক প্রমাণিত হয়, তাহলে এর পেছনে দুদকের কোন কর্মকর্তারা দায়ী। এত বড় প্রতিষ্ঠানে এমন অনেকেই নিশ্চয়ই আছেন যারা টিকে থাকতে নিরুপায় হয়ে হয়তো সরকারের ইশারা ইঙ্গিতে সাড়া দিয়ে কাজ করে গেছেন।

সরকারের করায়ত্ত কীভাবে দুদকের ওপর বজায় রাখা যায় তার জন্য কিছু দুর্বল আইন বা বিধি আমার নজরে এসেছে। এর কয়েকটি নমুনা দেয়া যাক। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ক্রমিক নং ২৪ এ একদিকে বলা আছে “এই আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে কমিশনারগণ এই আইনের অধীন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন”। অপরদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭-এর অষ্টম অধ্যায়ে বলা আছে “কমিশন ইহার নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে প্রেষণে অন্যত্র নিয়োগের জন্য সরকারকে অনুরোধ করিতে পারিবে এবং সরকার উক্তরূপভাবে অনুরোধপ্রাপ্ত হইলে উক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা উহার অধীন সংস্থা বা অধিদপ্তর বা পরিদপ্তরের সমমর্যাদাসম্পন্ন পদে প্রেষণে নিয়োগ করিতে পারিবে”। একই অধ্যায় আরও বলছে যে, ‘কমিশন ইহার দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে সরকারের যেকোনো মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগ বা উহার অধীন সংস্থা বা অধিদপ্তর বা পরিদপ্তর হইতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রেষণে নিয়োগের জন্য সরকারকে অনুরোধ করিতে পারিবে’। উপরোক্ত বিধিমালার মোদ্দা কথা হলো সরকার অত্যন্ত সুচারুভাবে সুকৌশলে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য দুদকে তার পছন্দসই ব্যক্তি ঢুকানো বা দুদক থেকে তার অপছন্দের ব্যক্তিকে বের করে দেয়ার একটি মসৃণ পথও রেখে দিয়েছে। এই কারণে এই বিধিমালার সঙ্গে দুদকের ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি সাংঘর্ষিক বলেই পরিগণিত হচ্ছে।

তাছাড়াও দুদক আইনে কমিশনার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রদানের উদ্দেশ্যে যে বাছাই কমিটির কথা বলা হয়েছে সেখানেও নিরপেক্ষ কমিশনার পাওয়ার পথ অমসৃণ রয়েছে। উক্ত কমিটিতে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বা দলনিরপেক্ষ প্রথিতযশা কোনো সিনিয়র সাংবাদিককে সম্পৃক্ত করলে নিরপেক্ষ কমিশনার পাওয়ার পথটি সহজতর হতো। কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা প্রশ্নে আইনে, শিক্ষায়, প্রশাসনে, বিচারে বা শৃঙ্খলা বাহিনীতে অন্যূন ২০ বছরের অভিজ্ঞতার কথা বলা হলেও কমিশনার নির্বাচনে শিক্ষা খাত সবসময় উপেক্ষিত থেকেছে।

মূল কথা হলো দুদককে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার দিতে হলে বিদ্যমান আইন সংস্কারসহ সম্পূর্ণ দুদককে ঢেলে সাজাতে হবে। দুদককে সরকারের প্রভাবমুক্ত করতে না পারলে প্রতিপক্ষকে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। সরকার ও আমলাতন্ত্রের করায়ত্ত থেকে দুদককে উদ্ধারের রাস্তা দেখানোর এখনই মোক্ষম সময়। দুদকের নিজস্ব ক্ষমতাকে শক্তিশলী করার জন্য এর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন কিছু বিষয়-যেমন মানিলন্ডারিং আইন, কর আইন বা সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তে পূর্বানুমতি-এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। কেননা, আইনের সঙ্গে আইনের সংঘর্ষ হলেই যেকোনা উদ্যোগ ভেস্তে যাবে।
অপরাধ দমনের উদ্দেশ্যে সৃষ্ট এ প্রতিষ্ঠানটিকে সরকার যেন ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করতে না পারে তার ব্যবস্থা এখনই নিতে হবে। দেশের জনসাধারণ সাক্ষী গোপাল হয়ে এতদিন সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দুদক দুর্নীতির প্রশ্নে আবার সরব হয়েছে। সংস্কার না হলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এলে এর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যাবে। গত মাসের শেষদিকে দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় টিআইবি ৫৫ দফার একটি প্রস্তাব রাখে। এর মধ্যে দুদকের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়টিও প্রাধান্য পায়। যেহেতু দুদকের মূল আইনটির খসড়া প্রণয়নে টিআইবি’র অবদান ছিল, সেহেতু দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামানই ভালো বুঝবেন দুদককে কীভাবে ‘নখ-দন্ত-থাবা’ ফিরিয়ে দেয়া যায়।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ।
ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, কিশোরগঞ্জ।

mzamin

 

No comments

Powered by Blogger.