নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগেই কি দায়মুক্তি? by মো. আল-আমিন
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০২২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করে আউয়াল কমিশন। এই কমিশন নিয়ে শুরু থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক ছিল। দেশের অন্যতম প্রধান বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ ইসিতে নিবন্ধিত বেশির ভাগ দল তাদের মেনে নেয়নি। ইসির সংলাপের আহ্বানও প্রত্যাখ্যান করে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট। এই কমিশনের পরিচালনায় চলতি বছরের ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনও বর্জন করে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। শুধু আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র দলগুলো ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দেয়া, বিতর্কিত বিভিন্ন সংস্থাকে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে অনুমোদন দেয়া, আইনে নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করার প্রস্তাব দেয়া, ইভিএম ব্যবহার নিয়ে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া মত পাল্টানোসহ কমিশনের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক ছিল। এ ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল পরিবর্তনেরও অভিযোগ উঠে এই কমিশনের বিরুদ্ধে।
বিদায়ী বক্তব্যে সিইসি বললেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন একদলীয় হয়েছে: সংবাদ সম্মেলনে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সিইসি বলেছেন, নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজনও ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে। মধ্যে হয়নি। উইদিন হয়েছে, নট বিটুইন। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি।
বাংলাদেশের বিগত নির্বাচনগুলোর ইতিহাস তুলে ধরে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, দেশের প্রথম সাংবিধানিক সাধারণ নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক ছিল। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসনামলে হয়েছে। ফলাফল নিয়ে বিতর্ক ছিল। ১৯৯১-এর নির্বাচন সম্মত রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, সুক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও, সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচন সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই নির্বাচনে বিএনপি সংসদে মাত্র ২৭টি এবং আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান বিষয়ে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনাসমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দর কষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সে প্রশ্নে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধানমতে দলীয় সরকারের অধীনে হয়েছে।
হাবিবুল আউয়াল বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলই অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচনও ২০২৪ সালের মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। আসন পেয়েছিল মাত্র ৬টি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান কমিশনের অধীনে। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সেই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়টি দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয়।
কিন্তু নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করার মতো সাংবিধানিক এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের ছিল না মন্তব্য করে বিদায়ী সিইসি বলেন, সে কারণে অনেকেই কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন, কী কারণে, কতোদিনের জন্য স্থগিত করা যাবে তাও সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। অতীতে কখনোই কোনো কমিশন নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেননি। সম্প্রতি ভেঙে দেয়া সংসদের ২৯৯টি আসনে নির্বাচন প্রার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে হয়েছে। দলের মধ্যে নয়। ২৯৯ আসনে ১৯৬৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
হবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সকল দোষ বা দায়-দায়িত্ব সকল সময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয়ে থাকে। একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সকল সময় সকল কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায়, আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন-পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে দুর্ভেদ্য মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন প্রয়োজন হবে।
দলীয়ভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়ার কারণে নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে মন্তব্য করে বিদায়ী সিইসি বলেন, এটি সঠিক ও যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি এমন উদাহরণ নেই। সরকার বার বার বলছেন, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত।
বিদায়ী পরামর্শে সিইসি বললেন, ভোট তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হলেই ভালো: বর্তমান ও অতীত থেকে আহরিত অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধি থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছু প্রস্তাব সরকারের বিবেচনার জন্য রেখে যাওয়া কর্তব্য মনে করছেন সিইসি। তিনি বলেছেন, দেশের প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সমরূপতার কারণে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (দলীয়ভিত্তিক) নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আদর্শ ক্ষেত্র হতে পারে। সেইসঙ্গে নির্বাচন চার বা আটটি পর্বে, প্রতিটি পর্বের মাঝে ৩/৫ দিনের বিরতি রেখে আয়োজন করা ব্যবস্থাপনার দিক থেকে সহজ ও সহায়ক হতে পারে। আমাদের প্রবর্তিত অনলাইনে নমিনেশন দাখিল অব্যাহত রেখে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার অপটিমাইজ করতে পারলে উত্তম হবে।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনের একেবারে শেষ ভাগে পদত্যাগের ঘোষণা দেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, সবশেষে জানাতে চাই, আমিসহ কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত বিরাজিত অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনোস্থির করেছি। আমরা আজ পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপনের নিমিত্তে কমিশনের সচিবের হাতে দেবো। পরে কাজী হাবিবুল আউয়াল পদত্যাগপত্রে সই করেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষ করেই হাবিবুল আউয়াল ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে নিজ বাসার উদ্দেশ্যে চলে যান।
সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার আহসান হাবিব ও মো. আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। তবে ইসি ভবনে থাকলেও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা ও আনিছুর রহমান। পদত্যাগের পর চুপিসারে ইসি ভবন ছেড়ে যাওয়ার সময় বিক্ষুব্ধ জনতার সামনে পড়েন এই দুই কমিশনার। দুজনের গাড়িতে জুতা নিক্ষেপ করা হয়।
পদত্যাগেই কী দায়মুক্ত বিদায়ী ইসির?
বিতর্কিত একদলীয় নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করা আউয়াল কমিশন পদত্যাগ করেই দায় এড়াতে পারে না বলে জানিয়েছে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জরুরিভিত্তিতে তাদেরকে দায়বদ্ধ করতে হবে। তারা পার পেয়ে গেলে অন্যরা উৎসাহিত হবে। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিতর্কিত একতরফা নির্বাচনের আয়োজন না করলে এতগুলো হতাহত হতো না। ইতিহাস ভিন্ন হতো পারতো। তাই নিঃসন্দেহে এই কমিশনের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। জরুরিভিত্তিতে তাদের দায়বদ্ধ করা দরকার। কেননা, এই কমিশন পার পেয়ে গেলে অন্যরা উৎসাহিত হবে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদও একই কথা জানান। তিনি বলেন, তাদের পদত্যাগ করার অধিকার আছে। কিন্তু পদত্যাগ করলেই তারা দায়মুক্ত হয়ে যাবেন না বলে মনে করেন এই নির্বাচন বিশেষজ্ঞ।
No comments