দ্বৈত নাগরিকদের সংসদ সদস্য হওয়ার পথে সংবিধানে বাধা রাখা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? by ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের পট-পরিবর্তনের পর সদ্য বরখাস্ত হওয়া মেয়রও ছিলেন দ্বৈত নাগরিক। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদার, এমপির অনেক উপরে। অর্থাৎ দ্বৈত নাগরিকরা প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন মেয়র হতে পারবেন কিন্তু সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এই বাধা বা প্রতিবন্ধকতা যে কেন রাখা হয়েছে তা বুঝে আসে না।
দ্বৈত নাগরিকরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হতে পারবেন এমনকি প্রধান বিচারপতি হতে পারবেন তাতে সাংবিধানিক কোন বাধা নেই। বস্তুত: নিকট অতীতে প্রধান বিচারপতি হবার দৌড়ে ছিলেন আপিল বিভাগের এমন দুজন সিনিয়র বিচারপতি ছিলেন দ্বৈত নাগরিক (বৃটিশ-বাংলাদেশি নাগরিক ছিলেন)। এখনও সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক বিচারপতি আছেন যারা দ্বৈত নাগরিক। খোদ বর্তমান প্রধান বিচারপতিও দ্বৈত নাগরিক।
ইতিহাস সাক্ষী উন্নত বিশ্বে পড়াশোনা করা দ্বৈত নাগরিক সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা তুলনামূলকভাবে অধিকতর যোগ্যতার সাথে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে বিচারকার্য চালিয়েছেন বা চালাচ্ছেন বিদেশে অর্জিত তাদের শিক্ষা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে।
দ্বৈত নাগরিকরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হতে পারবেন কিন্তু এমপি হতে পারবেন না! আচ্ছা এখন প্রশ্ন কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন-একজন এমপি না একজন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি? নিশ্চয়ই সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বলা হয় সংবিধানের গার্ডিয়ান। তাদের আদি ক্ষমতা (inherent power) আছে। তারা শপথ নেন বাংলাদেশের সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান করার, কিন্তু এমপিদের শপথে এ কথাগুলো বলতে হয় না। রাষ্ট্রাচারের ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্ট (Warrant of Precedence) অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা এমপিদের উপরে। এমপিদের ঝবৎরধষ (ক্রমিক) হচ্ছে ১২, পক্ষান্তরে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ক্রমিক হচ্ছে ৯ ও আপিল বিভাগের বিচারপতিদের ক্রমিক হচ্ছে ৮। তাছাড়া মন্ত্রী (যেমন ঢাকা সিটি উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র পূর্ণ মন্ত্রীর পদ মর্যাদার) ও প্রতিমন্ত্রী (যেমন সিলেট সিটি মেয়র) মর্যাদার মেয়র যদি দ্বৈত নাগরিকরা হতে পারেন তাহলে এমপি না হতে পারার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখছি না।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে আনুগত্যের মোড়কে কেন যে এই বাধা রাখা হচ্ছে তার যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা পাইনি। আধুনিক বিশ্বে ও বর্তমান গ্লোবাল ভিলেজে আনুগত্য ঘোষণা ও স্বীকার এক absurd concept (অযৌক্তিক ধারণা)। দ্বৈত নাগরিক নন এবং দেশের প্রতি তথাকথিত পূর্ণ আনুগত্যকারী জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে এমপি হয়েও তো হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করছেন এবং বিদেশে টাকা পাচার করছেন। আবার অনেক দ্বৈত নাগরিক তথ্য গোপন করে এমপি হয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। ‘সরকারের সাথে বা সরকারি দলের হলে সকল কুল মাফ’- এমন ধারণাও বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল। পতিত সরকারের প্রভাবশালী এক এমপি বৃটিশ পাসপোর্ট (হিথ্রো এয়ারপোর্টে আমার নিজের চোখে দেখা) নিয়েও তো বাংলাদেশে এমপি হয়েছেন। তাহলে আনুগত্যের মোড়কে সংবিধানে এই বাধা রাখার হেতু কি?
অপরদিকে দ্বৈত নাগরিক সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক সিনিয়র বিচারপতির কথা জানি সারা জীবন উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পরও ঢাকা শহরে একটি বাড়ি করতে পারেন নি। দ্বৈত নাগরিক (বৃটিশ ও বাংলাদেশি) হবার পরও লন্ডনে ফিস দিয়ে তার সন্তানকে পড়ানোর আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। ভাগ্যিস তার সন্তান গ্রামার স্কুলে স্কলারশিপ পাওয়ায় তার কোনো চিন্তা করতে হয়নি। সুতরাং আনুগত্য ও দ্বৈত নাগরিকত্ব দিয়ে ব্যক্তির গুণাগুণ, সততা ও দেশপ্রেমের বিচার বা পরিমাপ করা যাবে না।
সংবিধানের ৬৬(২)(গ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত সংসদে নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু অযোগ্যতার অন্যতম হলো ‘তিনি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা বা স্বীকার করেন’। দ্বৈত নাগরিকত্ব নিতে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বাংলাদেশি নাগরিকরা তাদের নিজ দেশের নাগরিকত্ব বা আনুগত্য ত্যাগ করতে হয় না। অনেক সময় শপথও (Oath) নিতে হয় না। যেমন, বৃটিশ নাগরিকত্ব নেয়ার সময় একজন আবেদনকারী ঙধঃয এর পরিবর্তে Affirmation করতে পারেন। এক কোটি ৩০ লাখের উপর প্রবাসীরা বাংলাদেশের বাহিরে থাকেন। ইমিগ্রেশন ও প্রায়োগিক (practical) এবং পদ্ধতিগত (procedural) সুবিধার্থে অনেকে বিভিন্ন দেশে দ্বৈত নাগরিকত্ব নেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের নিজ দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বা আনুগত্য ত্যাগ করতে হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে সংবিধানে দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে এই প্রতিবন্ধকতা রাখার দরকারই বা কি?
সংবিধানে যখন প্রায় দেড় যুগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল তখন দ্বৈত নাগরিক প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার প্রধান উপদেষ্টা হতে পারতেন-যেমন হাইকোর্টের বিচারপতি, পরবর্তীতে আপিল বিভাগের বিচারপতি, পরে প্রধান বিচারপতি, শেষে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি (last retired Chief Justice) হয়ে। অথচ এমপি হতে পারতেন না। ব্যাপারটি হাস্যকর মনে হয়। এমনকি ড. ফখরুদ্দিন আহমদ ও ড. ইফতেখারুজ্জামান তাদের দুজনের দ্বৈত নাগরিকত্ব ছিল বলে সর্বজন বিদিত, অথচ তারা ১/১১ পরবর্তী সরকারের যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী পদমর্যাদায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে প্রায় দুবছর দেশ চালিয়েছেন।
গণতন্ত্রের সূতিকাগার বৃটেনে বিদেশি পাসপোর্ট ও দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েও এমপি হওয়া যায়। কমনওয়েলথ নাগরিক হিসেবে বৃটেনে পার্লামেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াবার জন্য এক্ষেত্রে দুটি শর্ত: ভোটার তালিকায় নাম থাকতে হবে এবং অন্তত: (বিদেশি পাসপোর্টে) ইনডিফিনিট লিভ তথা সেটেল্ড স্ট্যাটাস থাকতে হবে। বৃটিশ সিটিজেন হওয়া বা বৃটিশ পাসপোর্ট থাকা মোটেই আবশ্যিক (compulsory) নয়। শুধু তাই নয়, দ্বৈত নাগরিক বা বৃটেনে পার্মানেন্ট রেসিডেন্টধারী (স্থায়ীভাবে বসবাসকারী) বিদেশি নাগরিক বৃটেনে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হতে পারেন যদি তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন ও বৃহৎ দলের নেতা নির্বাচিত হোন। সাংবিধানিক কোনো বাধা নেই। তাহলে আমরা কি গণতন্ত্রের সূতিকাগার বৃটেনের চেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক হয়ে গেছি?
বৃটেন অন্যান্য ক্ষেত্রেও অনেক উদার। কানাডা নামক ভিন দেশের নাগরিক ও ভিন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মার্ক কার্নিকে এনে বৃটেনে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর পর্যন্ত বানিয়েছে বৃটিশ সরকার। কই তার বিদেশি রাষ্ট্র কানাডার প্রতি আনুগত্য নিয়ে তো কোনো প্রশ্ন তুলা হয়নি। তাহলে আমরা কেন বাস্তব ও প্রায়োগিক কারণে দ্বৈত নাগরিকত্ব নেয়া জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য সংবিধানে এই বাধা রাখছি? এতে কিন্তু পক্ষান্তরে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সফল গণ-অভ্যুত্থানে পট পরিবর্তনের প্রাক্কালে সময় এসেছে সংবিধান থেকে এই অযৌক্তিক বাধা দূর করা। বাংলাদেশের বাইরে প্রচুর দ্বৈত নাগরিক কিন্তু জন্মসূত্রে বাংলাদেশি নাগরিক আছেন যারা শিক্ষা-দীক্ষায় ও অভিজ্ঞতায় অনেক অগ্রসর (advanced)। সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলে তারা তাদের উন্নত বিশ্ব থেকে নেয়া শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের আইন প্রণয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাদেরকে অযথা আনুগত্যের মোড়কে সাংবিধানিক বাধা দিয়ে আটকিয়ে রাখা উচিৎ নয়। সাংবিধানিকভাবে দ্বৈত নাগরিকরা যদি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি হতে পারেন তাহলে এমপি হতে বাধা থাকবে কেন? সংবিধান থেকে এই অযৌক্তিক ও হাস্যকর বাধা দূর করা আশু প্রয়োজন যদি বাংলাদেশের রাজনীতি, আইনপ্রণয়ন ও সরকার পরিচালনায় গুণগত পরিবর্তন আনতে হয়।
লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email:
ahmedlaw2002@yahoo.co.uk
No comments