শহীদি মার্চ থেকে বিচারের প্রত্যয়

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক মাস পূর্তিতে ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচি পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে এই মিছিলে রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার লাখো মানুষ অংশ নেন। গতকাল বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাষ্কর্য থেকে মার্চটি শুরু হয়ে রাজধানীর নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, ধানমণ্ডি, সংসদ ভবন, ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। কর্মসূচি শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে ৫ দফা দাবি পেশ করা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। শহীদি মার্চে জাতীয় পতাকা হাতে অংশ নেয়া ছাত্র-জনতা স্লোগানে স্লোগানে জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার দাবি করেন। তারা বৈষম্যমুক্ত দেশ গঠনের দাবি এবং ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধেও নানা স্লোগান দেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাষ্কর্য থেকে বিকাল ৩টায় এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে মিছিল নিয়ে টিএসসি অভিমুখে রওনা দেয় শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে আসতে থাকেন টিএসসি এলাকায়। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষও যোগ দেয় মিছিলে।

অনেক অভিভাবকও তাদের সন্তানদের নিয়ে মিছিলে যোগ দেন। বিকাল ৩টার পর হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ঢলে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ সময় তারা ‘খুনি হাসিনার বিচার চাই, স্বৈরাচারের বিচার চাই, আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেবো না, শহীদের স্মরণে, ভয় করিনা মরণে, আমাদের শহীদেরা আমাদের শক্তি, আবু সাঈদ-মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ, লাল সবুজের পতাকায় শহীদদের দেখা যায়, জেগেছে রে জেগেছে ছাত্র সমাজ জেগেছে, লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে, হই হই রই রই ছাত্রলীগ গেলি কই, আমার ভাইয়ের খুনি ধর খুনি হাসিনার বিচার কর, উই ওয়ান্ট জাস্টিসসহ বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। এদের বেশিরভাগেরই মাথায় ছিল বাংলাদেশের পতাকা বাঁধা। কারও হাতে ছিল পতাকা। কেউ আবার লাল-সবুজের পতাকা জড়িয়ে এসেছিলেন গায়ে। অনেকেই আবার ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলার প্রতিবাদে সেদেশের পতাকা নিয়ে এসেছিলেন শহীদি মার্চে। পূর্ব ঘোষিত এই কর্মসূচি বিকাল ৩টায় শুরুর কথা থাকলেও হাজার হাজার লোকসমাবেশ নিয়ে বিকাল ৪টায় রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু হয় শহীদি মার্চ। আইনশৃঙ্খলা বহিনীর ব্যাপক নিরাপত্তায় মিছিলটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, ধানমণ্ডি-৩২ নম্বর, সংসদ ভবন, ফার্মগেট, শাহবাগ, টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। এ সময় মিছিলের অগ্রভাগে ছিল র‌্যাব, পুলিশের সদস্যদের গাড়ি। এরপর ছিল মোটরসাইকেল র‌্যালি। তারপর ছিল ছাত্র-জনতার মিছিল। মিছিলের পিছনেও ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি। আর মিছিল যেসব রাস্তা অতিক্রম করেছে সেসব রাস্তা পুরো যানমুক্ত করে রাখে ঢাকার ট্রাফিক বিভাগ। মিছিল চলাকালে মানিক মিয়া এভিনিউ, খামারবাড়ী, কাওরান বাজার, শাহবাগসহ রাস্তার গুরত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে কিছু সময় দাঁড়িয়ে আবারো যাত্রা শুরু করেন তারা। সড়কে মিছিল যাওয়ার সময় দুইপাশে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ মিছিলকারীদের অভিবাদন জানান।

সবশেষ সন্ধ্যার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এই শহীদি মার্চ। সেখানে সমন্বয়কেরা কথা বলেন। এ সময় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ৫ই আগস্ট এই ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি সেই বাংলাদেশ সৃষ্টিতে যে ছাত্র এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার ভাইয়েরা নিজের জীবন দিয়ে এই বাংলাদেশকে সৃষ্টি করেছে তাদের স্মরণ করতে আমরা এই শহীদি মার্চ পালন করেছি। এই শহীদি মার্চে আমাদের শহীদ ভাইদের স্মরণ করবো একটি কথাই বলতে চাই, যে স্পিরিটকে ধারণ করে আমরা আমাদের এই রক্তের উপর দিয়ে লড়াই করেছি সে স্প্রিরিটকে বজায় রাখার জন্য আমরা আবারো আমাদের জীবন দিতে প্রস্তুত থাকবো। তিনি বলেন, হাসিনার মতো কোনো ফ্যাসিস্ট যদি আগামীতেও এই বাংলাদেশে জেঁকে বসার ন্যূনতম চেষ্টা করে তাহলে এই দেশের ছাত্র-জনতা আবারো নতুন করে আসা সেই ফ্যাসিস্টকেও প্রতিহত করবে। আজকে লক্ষাধিক ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ প্রমাণ করে শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। সারজিস আলম বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানে আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছে, সেই অভ্যুত্থানের চেতনা ধরে রাখতে আমরা আবারো রক্ত দিতে প্রস্তুত আছি। বলেন, ভুলেও কেউ ফ্যাসিস্টদের দোসর হওয়ার চেষ্টা করবেন না। যারা ফ্যাসিস্টদের বিন্দুমাত্র ধারণ করে তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, যদি দোসর হয়ে থাকার চেষ্টা করেন তাহলে এ দেশের ছাত্র-জনতা একসঙ্গে তাদের প্রতিহত করবে। কোনো চাঁদাবাজ, ক্ষমতার অপদখলকারী, সিন্ডিকেটদের অবস্থান এ দেশে হবে না।

সমন্বয়ক আখতার হোসেন বলেন, গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করত হবে। ছাত্র-জনতা সম্মিলিত শক্তিতে ফ্যাসিবাদকে হটিয়েছে। ফ্যাসিবাদকে ফেরানোর কোনো চেষ্টাকে ছাত্র-জনতা ছাড় দেবে না। সমন্বয়ক আব্দুল কাদের বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার দায় শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের নিতে হবে। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে শেখ হাসিনাসহ সকল অপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানাই।

সন্ধ্যা ৭টায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ৫ দফা দাবি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের। তাদের ঘোষিত ৫ দফা দাবিগুলো হলো- ১. গণহত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। ২. শহীদ পরিবারদের আর্থিক ও আইনি সহযোগিতা দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রদান করতে হবে। ৩. প্রশাসনে দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টদের দোসরদের চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে বিচারের আওতায় আনতে হবে ৪. গণভবনকে জুলাই স্মৃতি যাদুঘর ঘোষণা করতে হবে। ৫. রাষ্ট্র পুনর্গঠনের রোডম্যাপ দ্রুত ঘোষণা করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.