সিলেটে চিনির সাম্রাজ্যে মিললো মহিষের চালান by ওয়েছ খছরু

দেশ জুড়ে আলোচিত চিনির সাম্রাজ্য সিলেটের হরিপুর। গত এক বছরে এই হরিপুরে হাজার কোটি টাকার চিনি লেনদেন হয়েছে। সীমান্ত গলিয়ে আসা চিনির চালান হরিপুর থেকেই খালাস হতো রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও এ চিনির অবৈধ ব্যবসাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। তারাও কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ফলে অবৈধ কারবার হরিপুরে হয়ে বৈধ হয়ে গিয়েছিল। সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন সবাই। শেষ দিকে এসে বিগত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বজনরাও এই চিনিকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ফলে অনেকটা নির্বিঘ্নেই চলতো এই চিনির ব্যবসা। স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকার চিনি এই হরিপুর থেকে পাচার হতো।

যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরুর আগে চিনি কারবারিদের সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছিল স্থানীয় প্রশাসন। চিনির আগেও হরিপুর বাজার বিখ্যাত ছিল চোরাই গরু-মহিষের হাট হিসেবে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার ভোররাত ৩টার দিকে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা হরিপুর বাজারে অভিযান চালান। প্রথমে তাদের টার্গেটে ছিল চিনির আড়ত। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনের আগাম সতর্কবার্তায় চিনি কারবারিরা সতর্ক হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে স্থান বদল করে তারা ব্যবসায় চালাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা হরিপুর বাজারের আশপাশের গ্রামকে ব্যবহার করে। এসব গ্রামের ভেতরে ট্রাক নিয়ে গিয়ে চিনি লোড করে পাথর কিংবা বালি উপরে দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পাচার করছে। এ কারণে রাতে যখন যৌথ বাহিনীর সদস্যরা বাজারে থাকা কয়েকটি বড় গুদামে তল্লাশি চালায় তখন সেখানে মিলেনি চিনির চালান। হরিপুর বাজারের পাশেই ইসমাইল হাজীর বাড়ি। এ বাড়ি চিনির গোডাউন হিসেবে অনেক আগে থেকেই পরিচিত। বাড়িটিতে ৭-৮টি গুদাম রয়েছে। এসব গুদামেও তল্লাশি চালায় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় ওই গুদামের বাইরে থেকে প্রায় ১৫টির মতো পরিত্যক্ত চিনির বস্তা উদ্ধার করে। তবে কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। বাজারের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভোররাতে যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় আতঙ্ক দেখা দিলে ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে সরে যান। একপর্যায়ে পশুর হাট থেকে ৬৭টি মহিষ আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় সেখানে বিজিবি ছাড়াও অন্য বাহিনীর সদস্যদেরও একাধিক টিম উপস্থিত ছিল। ব্যবসায়ীরা জানান, অভিযানের আশঙ্কায় হাটে থাকা কয়েকশ’ মহিষ আগেই সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। তবে; সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রশিদ তার মহিষগুলো সরাননি। অভিযানের সময় ওই মহিষগুলো আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাজার সেক্রেটারি জাকারিয়া মাহমুদ মানবজমিনকে জানিয়েছেন, এ হাটে বৈধভাবেই ব্যবসা করা হচ্ছে। প্রতি বছর বাজার নিলাম হয়। কোনো ধরনের অবৈধ ব্যবসা না করতে ইতিমধ্যে আমরা বাজারের ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দিয়েছি। বিজিবি সীমান্তে মহিষ আটক করলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেগুলো বৈধ হাট থেকে আটক করে নিয়ে যাওয়া নিয়ে এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে বাজার কমিটির নেতারা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে জানান তিনি। এদিকে, গতকাল দুপুরে বিজিবির ৪৮ ব্যাটালিয়নের তরফ থেকে বিশেষ অভিযানে ৬৭টি ভারতীয় মহিষ আটক করা হয়েছে। এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে এ তথ্য জানানো হয়। বিজিবি জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে  সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির একটি চৌকষ টহল দল ভোর ৪টায় চোরাচালানবিরোধী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। আভিযানিক টহল দল সিলেট জেলার জৈন্তাপুর উপজেলার বিরাইমারা ব্রিজ নামক সীমান্ত এলাকা হতে ৬৭টি ভারতীয় বড় আকারের মহিষ আটক করতে সক্ষম হয়। যার আনুমানিক এক কোটি চৌত্রিশ লাখ টাকা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর বিজিবি টহল দলের টের পেয়ে চোরাকারবারিরা মহিষ ফেলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। ফলে বিশেষ অভিযানে কাউকে আটক করা যায়নি। সিলেট ব্যাটালিয়ন ৪৮ বিজিবির অধিনায়ক  লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হাফিজুর রহমান, পিএসসি স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী সীমান্তে নিরাপত্তা রক্ষা ও চোরাচালান প্রতিরোধকল্পে বিজিবির আভিযানিক কার্যক্রম ও গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আটককৃত ভারতীয় চোরাচালানের ৬৭টি বড় আকারের মহিষগুলোর পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। মহিষগুলো ৪৮ বিজিবির তামাবিল বিওপি’র জিম্মায় রাখা হয়েছে। স্থানীয় কাস্টমস প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নিলাম কার্যক্রম সম্পন্ন করা হবে। হরিপুর বাজারের সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানান, চিনি ব্যবসা শুরু হওয়ার পর হরিপুরের সিন্ডিকেটরা গরু, মহিষ ব্যবসা থেকে সরে এসেছেন। এখন আশপাশের দরবস্ত, চিকনাগুল ও জৈন্তাপুর সদরে সীমান্ত দিয়ে আসা গরু, মহিষের হাট বসে। এসব বাজার প্রশাসনের তরফ থেকে উচ্চমূল্যে ইজারা দেয়া হয়েছে। হরিপুর বাজারে আগের মতো পশুর হাট বসে না। কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী হাটে মহিষ বিক্রি করে থাকেন।

No comments

Powered by Blogger.