অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও জনপ্রত্যাশা : একটি বিশ্লেষণ by ড. মো. সফিকুল ইসলাম
এমতাবস্থায় অকুতোভয় ছাত্রদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্রের অবসান হয়। এজন্য প্রায় চার শতাধিক ছাত্র-জনতাকে জীবন দিতে হয়েছে যা দেশে-বিদেশে জুলাই ম্যাচাকার নামে পরিচিত। আমি মনে করি, এ গণ-অভ্যুত্থানে মূল চেতনা হচ্ছে বৈষম্যহীন, দুনীতিমুক্ত একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ যেখানে সকল মানুষ রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন থেকে মুক্ত থাকবে; সকল সমাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ সমানভাবে ভোগ করবে। ভোটাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে পাবে। এ প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার মতামতের ভিত্তিতে নোবেল বিজয়ী জননন্দিত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে।
এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে সরকার ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পুনর্গঠন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু; স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য সকল স্বায়ত্তশাসিত, সাংবিধানিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার ও পুনর্গঠন প্রয়োজন। বিশেষ করে; পুলিশ প্রশাসন, জন প্রশাসন ও বিচার বিভাগের সংস্কার অতীব জরুরি। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের প্রায় ১৬ বছরের শাসনামলে পুলিশ বাহিনী দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল ও বিরোধী মতকে দমন ও নিপীড়ন তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পুলিশ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের গুম, খুন ও অবর্ণনীয় নির্যাতনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। তারা আওয়ামী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মত আচরণ করতেন। কথায় কথায় বিরোধী দলের মিছিল ও সমাবেশে গুলি ও ধরে নিয়ে নেতা-কর্মীদের নির্যাতন ও রিমান্ডে নেওয়া তাদের দৈনন্দিন প্যাকটিজ হয়ে গিয়েছিল। সর্বশেষ ছাত্র জনতার আন্দোলনকে দমন করার জন্য প্রায় চার শতাধিক ছাত্র-জনতা এবং বিরোধী দলীয় কর্মী-সমর্থককে গুলি করে হত্যা করেছে। প্রায় বার হাজার ছাত্র ও বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এ অবস্থায় পুলিশ প্রশাসনের যেসব সদস্য আইনের অপব্যবহার করে হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত তাদের তদন্ত করে অতি দ্রুত বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।
যেসব মেধাবী ও যোগ্য পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যগণ এতদিন ও.এস.ডি. ও কম গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিল তাদেরকে দিয়ে পুলিশ প্রশাসন পুনর্গঠন করা অতি জরুরি। পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে জনবান্ধব সংস্কৃতি তৈরির লক্ষ্যে তাদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। বিজিবি এর মত তাদের পোশাক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন করা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করা যেতে পারে।
জন প্রশাসনেরও সংস্কার প্রয়োজন। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর জন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছে। বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে নির্বাচনের সময় দলীয় বক্তব্য দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের তিনটি জাল জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্ব পালন করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটের আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করণে সহায়তা ও ভোট কাস্টিং এর হার বাড়িয়ে দেখিয়ে নির্বাচনকে আইনগত বৈধতা দান করেছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও অবর্ণনীয় নিপীড়নের সহযোগী হিসেবে করেছে তাদের বরখাস্ত করে যারা এতদিন উপেক্ষিত ছিল এবং দক্ষ ও যোগ্য তাদেরকে দিয়ে জন প্রশাসন পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।
মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ ভূমিকা অপরিহার্য। কিন্তু, বিচার বিভাগ বিগত আওয়ামী সরকারের দুঃশাসনকে বৈধতাদানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। ২০১১ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কের বিধানকে অবৈধ ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ও তিনটি জাল-জালাতিপূর্ণ নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় শাস্তি দিয়ে কারারুদ্ধ করেছে। বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী ও বিরোধী মতের লোকদেরকে, বিশেষ করে, সিনিয়র রাজনৈতিক নেতাদেরকে হয়রানিমূলক ও মিথ্যা মামলায় ডিমান্ড দিয়ে পুলিশকে নির্যাতনের সুযোগ করে দিয়েছে। অসংখ্য বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও বিরোধী মতের লোকদেরকে কারারুদ্ধ করেছে। বিচার বিভাগ থেকে এসব বিচারকদের সরিয়ে বিচার বিভাগ পুনর্গঠন করতে হবে। বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ নিরপেক্ষকরণ এবং উচ্চ আদালতে যোগ্য ও নিরপেক্ষ বিচারপতি নিয়োগের আইন করতে হবে। তাছাড়া, দুর্নীতি দমলো কমিশন, মানবাধিকার কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ সরকারি, স্বায়তশাসিত, রাষ্ট্রত্ব প্রতিষ্ঠান থেকে দলীয় কর্মকর্তাদেরকে সরিয়ে পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।
এছাড়া অন্তর্বর্তীকালনি সরকারের প্রধান কাজ হবে গণতন্ত্র পুনঃ:প্রতিষ্ঠা, বিশেষ করে, জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়া। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচন। এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়। বিগত তিনটি নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশেষ করে, তরুণ ভোটারগণ ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ব্যবস্থা জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাই জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনসহ পুরো নির্বাচনীয় ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে। বাংলাদেশে ইতিহাসে সবচেয়ে জালিয়াতিপূর্ণ ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ নির্বাচন যেসব কমিশন পরিচালনা করেছেন তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এ সরকারের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি না হলেও তাদের প্রতি ব্যাপক জন সমর্থন রয়েছে। আশা করি এ সরকার প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে।
লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments