লাপাত্তা জনপ্রতিনিধিরা, সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি by মারুফ কিবরিয়া
সূত্রমতে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার খবরে মুহূর্তেই এলাকা ত্যাগ করেন তারা। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেয়। ফলে আতঙ্কে এলাকা ছাড়া হয়ে কেউই দাপ্তরিক কার্যক্রমে অংশ নেননি। যদিও অনেক এলাকায় সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইতিমধ্যেই।
শেখ হাসিনা পালানোর আগেই দেশত্যাগ করেন ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। গত ৩রা আগস্ট সপরিবারে সিঙ্গাপুর চলে যান। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগের পরপর এই সিটির ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও লাপাত্তা। সংশ্লিষ্ট এলাকায় এসব কাউন্সিলরদের না পেয়ে জন্মনিবন্ধনসহ বিভিন্ন সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। একই অবস্থা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনেরও। ঘটনার পর থেকে প্রকাশ্যে আসেননি এই সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম। সিটির আওতাধীন ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অনেকেই লাপাত্তা। ৩৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ সেলিম। ৫ই আগস্ট থেকে উত্তর বাড্ডা সাতারকুল রোড এলাকায় তার দপ্তরটি বন্ধ রয়েছে।
শেখ হাসিনা পদত্যাগের পরপরই আত্মগোপনে চলে গেছেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) মেয়র তাহসিন বাহার সূচনা ও কাউন্সিলররা। ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কুসিক এলাকার নাগরিক সেবা কার্যক্রম। ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের কার্যালয়গুলো রয়েছে তালাবন্ধ। কোনো ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় খোলা পাওয়া যায়নি। ওইদিন পালিয়ে যান কুমিল্লার প্রভাবশালী সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার।
৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় কুসিক মেয়রের বাসভবন পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। লুট করে নিয়েছে ভবনের জিনিসপত্র। অনেক কাউন্সিলরের বাসভবন এবং কার্যালয় পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসে কাজ করার মতো অবস্থাও নেই। লুটপাট হওয়া কম্পিউটার, চেয়ার, টেবিলসহ কিছু জিনিসপত্র দুর্বৃত্তরা নিয়ে গেছে। এদিকে, সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের প্রায় সবক’টিই বন্ধ রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশন এলাকায় নাগরিক সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা নুরুদ্দিন আহমেদ বলেন, ৭ই আগস্ট জরুরি একটি কাজে কাউন্সিলর অফিসে গিয়েছিলাম। দেখি তালাবদ্ধ। কুমিল্লা সিটি ছাড়াও জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধিরাও ৫ই আগস্ট থেকে লাপাত্তা বলে জানা গেছে।
গত ৫ই আগস্ট থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন ফেনী পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা পালানোর পরপর তাকে আর এলাকায় দেখা যায়নি। পৌরসভার কাউন্সিলররাও নেই। গত ১০ দিনেরও বেশি সময় ধরে কার্যক্রমে নেই তারা। একই পরিস্থিতি ইউনিয়ন পরিষদেও। জেলার ৮ নং জয়লস্কর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মামুনুর রশিদ মিলন ৫ই আগস্ট থেকে পলাতক। তার সঙ্গে পালিয়েছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডের মেম্বাররাও।
এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার পর থেকে সিটি করপোরেশনের কার্যালয়ে আসেননি সিলেটের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান। তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলররাও গা-ঢাকা দিয়েছেন। টানা দু’দিন সিটি করপোরেশনের অচলাবস্থার পর সাবেক মেয়র আরিফুল হক সব কাউন্সিলরকে কাজ করার আহ্বান জানান। এ সময় বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত নির্বাচিত কাউন্সিলররা কাজে যোগ দেন। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ এলাকার বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিরা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
শেখ হাসিনার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন রাজশাহী জেলার জনপ্রতিনিধিরা। ৯০ শতাংশেরও বেশি জনপ্রতিনিধি ফেরেননি কর্মস্থলে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা কার্যক্রম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র ও কাউন্সিলররা আত্মগোপনে চলে গেছেন। গত এক সপ্তাহ ধরে তারা সবাই পলাতক থাকায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কার্যক্রম। একই অবস্থা জেলার গোদাগাড়ী, তানোর, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, পবা, মোহনপুর, বাঘা, চারঘাট ও বাঘমারা উপজেলা পৌরসভার। এসব উপজেলা ও পৌরসভার মেয়র-চেয়ারম্যানদের বেশির ভাগই আত্মগোপনে আছেন।
আত্মগোপনে রয়েছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। পুরো সিটিতে কোনো কাউন্সিলরই এখন প্রকাশ্যে নেই। বেশ কয়েকদিন সিটির অচলাবস্থার পর ১২ই আগস্ট প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সেবামূলক কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা জেলার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে অন্য সব জনপ্রতিনিধিরা এলাকা ছাড়া। কেউ প্রকাশ্যে নেই। ফলে সাধারণ মানুষ ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর আত্মগোপনে চলে যান পাবনার ঈশ্বরদীর বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি। কার্যালয় ছাড়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তাদের অনেকেই এখনো কার্যালয়ে ফেরেননি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপর ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটুসহ সব ওয়ার্ড কাউন্সিলররা গা-ঢাকা দিয়েছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাগেরহাটে আওয়ামী লীগ দলীয় শতাধিক জনপ্রতিধি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে থাকায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সেবাবঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাগেরহাট জেলার ৩টি পৌরসভা, ৯টি উপজেলা ও ৭৫টি ইউনিয়ন পরিষদের মেয়র ও চেয়ারম্যানরা সবাই আওয়ামী লীগ দলীয়। এরমধ্যে গণঅভ্যুত্থানের পর শরণখোলা উপজেলা চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত, সদ্য সাবেক এমপি শেখ হেলাল উদ্দিনের প্রার্থীকে হারিয়ে বিদ্রোহী হিসেবে বিজয়ী ফকিরহাট উপজেলা চেয়ারম্যান অহিদুজ্জামান বাবু ও চিতলমারী উপজেলায় চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন সিদ্দিকী এলাকায় থেকে অফিস করলেও অন্যরা জনরোষের ভয়ে এখনো পলাতক রয়েছেন।
No comments