বাবরি মসজিদের মতো কিছু বাংলাদেশে ঘটেনি: ভারতীয় টিভিকে রিজওয়ানা হাসান

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। এই সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে বলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে অতিরঞ্জিত করে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

এর মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মুখোমুখি হন ভারতীয় টিভি চ্যানেল নিউজ নাইনের।

ভার্চ্যুয়াল সাক্ষাৎকারে তাকে প্রশ্ন করা হয়- হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ কী?

এ বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলন করছে, তাদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরাও আছে। সুতরাং বলা যাবে না যে এটা শুধু মুসলিম শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। এই আন্দোলনে হিন্দু, খ্রিস্ট্রান, আদিবাসীসহ বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ আছে। যে কোনো সরকার পরিবর্তনের পর কিছু বিশৃঙ্খলা ঘটে- এখানেও সেটাই হয়েছে। হিন্দুদের ওপর যেসব আক্রমণের কথা শোনা যাচ্ছে- সেগুলো যে ধর্মীয় কারণে হয়েছে, এমন নয়। এগুলো হয়েছে মূলত রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে। পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে এগুলো হয়েছে। আমরা এরই মধ্যে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা যে কোনো ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে। একেবারেই যে হামলার ঘটনা ঘটেনি, তা আমরা বলছি না। তবে এগুলো কোনো সাম্প্রদায়িক ঘটনা নয়।

তাহলে শুধু আহমাদিয়া এবং হিন্দুদের কেন টার্গেট করা হচ্ছে?

রিজওয়ানা হাসান বলেন, শুধু আহমাদিয়া এবং হিন্দুদের টার্গেট করা হচ্ছে- বিষয়টি এমন নয়। আপনি যদি খেয়াল করেন, দেখতে পাবেন মুসলিমরাও আক্রমণের শিকার হয়েছে। যে কোনো সম্প্রদায় যারা সরকারের ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করে, সেগুলো হামলার শিকার হয়। এখানেও দু/একটি ঘটনা এ রকম ঘটেছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, সেটি হচ্ছে- সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে। যেসব জায়গায় হামলা হয়েছে, সেখানে হিন্দু, মুসলিম, আহমাদিয়া, আদিবাসী সবার ওপরেই হয়েছে।

কোনো মৌলবাদী গোষ্ঠী এই গণঅভ্যুত্থানের সুযোগ নিতে পারে কি না, এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

এ বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, এ ব্যাপারে আমি মোটেও চিন্তিত নই। কারণ, আমি আমার দেশকে ভালোভাবেই চিনি। এ রকম কথা বিগত অনেক বছর ধরেই শোনা যায়। এমনকি আপনি আপনার পুরো সাংবাদিকতার ক্যারিয়ারেই হয়তো এ ধরনের কথা শুনে থাকবেন। তবে আমি আমার জীবনে কখনও দেখিনি যে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে এ দেশে মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলো ২ বা ৩ শতাংশের বেশি ভোট কখনও পেয়েছে। সুতরাং রাতারাতি বিষয়টি পরিবর্তন হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমি একটি বিষয় আপনাকে বলতে চাই, ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলো যে শুধু বাংলাদেশেই সংগঠিত হয়েছে, বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। ভারতে যেমন বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছে, সেখানেও মুসলিমরা নিরাপদ নয়। এটার একটা প্রভাব কিন্তু সেখানে পড়েছে। আমাদের সৌভাগ্য যে বাংলাদেশে এ রকম কিছু ঘটেনি। আপনার প্রশ্নের জবাবে আমি বলবো, আপনি ভারতের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ঘটনার প্রভাব লক্ষ্য করতে পারবেন, সেখানে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো সংগঠিত হয়। তবে আমাদের দেশে এর নজির নেই।

সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বন্ধে আপনাদের পদক্ষেপ কী?
 
এর জবাবে রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা প্রত্যেক ঘটনার রেকর্ড রেখেছি। আমরা পুলিশকে বাড়তি নিরাপত্তার নির্দেশ দিয়েছি, আমরা সেনাবাহিনীকেও বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলেছি। আমরা তাদের বলেছি- যে কেউ এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত আছে প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিতে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার কখনওই বাংলাদেশ আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সাধারণত নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিপক্ষের ওপর হামলার ঘটনা ঘটায়। অবশ্যই এটির অবসান ঘটাতে হবে।

এই অন্তর্বর্তী সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ কী?

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- সব খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। কারণ, আমরা প্রায় ১৬ বছর ধরে একটি বিশেষ দলের শাসনে ছিলাম, যারা ক্ষমতায় এসেছিল জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে। ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে তারা সব খাতে এমনভাবে আধিপত্য বিস্তার করেছে যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে চেইন অব কমান্ড (শৃঙ্খলা) একেবারেই ভেঙে পড়েছে। আমাদের প্রচেষ্টা হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনমুখী করা, সেগুলোকে যে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রভাব থেকে মুক্ত করা এবং আমার আহ্বান হচ্ছে- প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কার, যাতে সব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে পারে এবং সেগুলো যাতে কোনো রাজনৈতিক দলের কাজ না করে। সুতরাং বলা যায়, আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং জনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, যেগুলো মানুষের প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক সাড়া দেবে।
এই সরকার নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে বলে কি আপনি মনে করেন?

রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমরা দায়িত্ব নিয়েছি মাত্র আড়াই দিন হয়েছে। যেসব খাতে জরুরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন, সেগুলোতে এই সরকার ধারাবাহিকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। আমি বলব- অর্থ ও আইন-শৃঙ্খলা খাতে এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে।

নতুন এই সরকার কীভাবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করবে?

এ বিষয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আজ আমাদের দ্বিতীয় দিনের অফিস চলছে। এই সময়ে অর্থ উপদেষ্টাকে পুরো বাংলাদেশ ব্যাংকে বড় ধরনের রদবদল করতে হচ্ছে। কেননা, সেখানে শীর্ষ পর্যায়ের সব কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খালি পদগুলো পূরণ করা হয়েছে, যাতে করে কোনোভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর সরবরাহ বন্ধ হয়ে না যায়। এখন আমাদের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ, আমরা দেখতে পাচ্ছি- কিছু ব্যাংক প্রায় দেউলিয়াত্বের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যদিও এর নেপথ্যে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি একটি কারণ। তবে দুঃশাসন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার অনেক কিছুই এর পেছনে রয়েছে। আমি ঠিক এই মুহূর্তে বলতে পারছি না কীভাবে সংস্কার আনা যাবে, তবে আমরা যদি অন্য দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব, এটা একেবারেই অসম্ভবও না। আমাদের এই মুহূর্তে এজেন্ডাই হচ্ছে সংস্কার এবং কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটা করা যায়।

সর্বপ্রথম কোন কোন খাতে সংস্কার আনা হতে পারে?

এর জবাবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা ও বিচার বিভাগ। সূত্র: নিউজ৯

No comments

Powered by Blogger.