অসমাপ্ত বিপ্লব: দুর্নীতি ও বৈষম্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে

৫ আগস্ট একটি ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লব বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ঘটায়। ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তার সরকারের আকস্মিক পতন বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। গণতন্ত্রপন্থীরা নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে, কিন্তু অস্থিতিশীলতা এবং সহিংসতা আগামী দিনে বৃদ্ধি পেতে পারে। যার জেরে ব্যাহত হতে পারে দেশের  অগ্রগতি। বাংলাদেশের বিপ্লব এখনো শেষ হয়ে যায়নি। শুধুমাত্র একটি  টেকসই এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমেই ছাত্ররা যে বিপ্লব শুরু করেছিল তার সমাপ্তি ঘটতে পারে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে সহায়ক ভূমিকা নিতে  পারে।

হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের অগ্রগতি যেভাবে এগিয়েছে পরবর্তী সরকারকে  তা ধরে রাখতে হবে। ২০১৬ সালে প্রাণঘাতী হলি আর্টিজান সন্ত্রাসী হামলার পর, তার সরকার ইসলামিক চরমপন্থাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনেছিল  এবং দেশের ধর্মীয় বহুত্ববাদের  উপর জোর দিয়েছিল। পররাষ্ট্রনীতিতে তিনি প্রায়শই আঞ্চলিক প্রতিযোগী ভারত ও চীনের সাথে বাংলাদেশের কঠিন ভারসাম্য রক্ষার কাজটিও পরিচালনা করে এসেছেন।

তবুও এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে নিকষ অন্ধকার, যা বাস্তবতাকে আড়াল করে। দুর্নীতি ও বৈষম্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শ্রম সুরক্ষা নীতিকে  দুর্বল করেছে ।  

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রায়শই ইসলামপন্থী দলগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢুকে পড়েছে রাজনীতি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্র ক্রমবর্ধমানভাবে অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে- বিরোধপূর্ণ নির্বাচন,  বিরোধীদের ওপর সরকারের  হয়রানি, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার একাধিক অভিযোগ সামনে এসেছে।

নোবেল বিজয়ী তথা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা  মুহাম্মদ ইউনূস নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে বাংলাদেশের বিপ্লবকে পথ দেখাবেন। তার দায়িত্ব দেশের ইতিবাচক উন্নয়ন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি  গণতন্ত্রকে সঠিক পথে পরিচালনা করা। গত ১৫ বছরে অপব্যবহার এবং দুর্নীতির জন্য জবাবদিহিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি যা  দীর্ঘকাল ধরে শূন্য-সমষ্টির রাজনীতি দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়ে এসেছে , তাকে সমঝোতা এবং ঐকমত্যের নিয়মে আবদ্ধ করতে  হবে। রাজনৈতিক ইস্যুগুলির বাইরে, দেশের  দুর্বল অর্থনীতিরও সংস্কার প্রয়োজন।

এই  কাজ  সহজ হবে না। দেশের মাটিতে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা বিশাল কাজ, বিশেষ করে একটি অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের পক্ষে।   যে প্রতিবাদ আন্দোলন হাসিনার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল তাতে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার বাইরেও ঐক্যবদ্ধ উদ্দেশ্যের অভাব ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র, বিরোধী দল এবং  আমলাতান্ত্রিক নেতাদের  চাপের সম্মুখীন হবে, যাদের সকলের আলাদা আলাদা এজেন্ডা রয়েছে।

তবে স্বার্থান্বেষীরা  সংস্কারে বাধা দিলে বাংলাদেশ আবারো  অস্থিতিশীল ভবিষ্যতের মুখোমুখি হতে পারে। বৈধ শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নির্বাচনের প্রয়োজন কিন্তু  যদি সময়ের আগে সেটি অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণীকে আবদ্ধ করতে পারে যাদের   পরিবর্তনের প্রতি আগ্রহ কম । যদি বাংলাদেশের তরুণ  বিক্ষোভকারীরা একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যানারে স্থিতাবস্থা অনুভব না করে  তাহলে আবারো  দেখা দিতে পারে অস্থিরতা। পরবর্তী সরকারের ওপর সেই ক্ষোভ গিয়ে পড়তে পারে। হাসিনার পতনের পর  রাজনৈতিক সহিংসতা এবং সংখ্যালঘুদের ওপর  আক্রমণগুলি পুনরুজ্জীবিত হয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে সেগুলি বাড়তে পারে।

আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা এই পরিস্থিতিতে কি ভূমিকা নেয় তা দেখার বিষয় । ভারত তাদের দীর্ঘ পারস্পরিক সীমান্তে দিল্লির নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করে আওয়ামী লীগকে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হিসেবে দেখে এসেছে। বিনিময়ে, ভারত বিতর্কিত নির্বাচন এবং মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগের মধ্যে  হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিল। যা তাকে রাজনৈতিক উদারীকরণের অভ্যন্তরীণ আহ্বানের প্রতি কম প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলেছিল এবং ফলস্বরূপ দানা বেঁধেছিলো বিদ্রোহ।  যার পরিণতিতে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান সাবেক প্রধানমন্ত্রী। চীনও তার অর্থনৈতিক স্বার্থে হাসিনাকে নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করেছে। ভারত বা চীন  কোন দেশই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র চায় না এবং উভয়ই এখন সতর্কতার সাথে রাজনৈতিক বিরোধীদের উত্থান প্রত্যক্ষ করতে চাইছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিবেশী নয়, কিন্তু তার স্বার্থও এখন গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির মুখে রয়েছে। পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গন্তব্য এবং দেশের সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের মূল উৎস।এটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। হাসিনার অধীনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের রেকর্ড খারাপ হওয়া সত্ত্বেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রাক্তন সরকারের সাথে শক্তিশালী নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বজায় রেখেছিল এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান কৌশলগত অংশীদার হিসাবে দেখেছিল।

বাংলাদেশের উত্তরণের পথে এই  অস্থিতিশীলতা স্বল্পমেয়াদে চীন বা ভারতের স্বার্থগুলিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, তবে আমেরিকার কাছে  একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কাম্য। সুষ্ঠু নির্বাচন সহ একটি স্থিতিশীল, বহুদলীয় গণতন্ত্র জবাবদিহিতার পথ প্রশস্ত করবে, দুর্নীতি ও সরকারি অপব্যবহারে রাশ টেনে  রাজনীতিকে স্থিতিশীল করবে। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজও চীনের দ্বারা প্রভাবিত। বাংলাদেশের পূর্ববর্তী বিরোধীরা প্রায়শই উদার সংস্কার এবং পশ্চিমের সাথে বৃহত্তর পররাষ্ট্রনীতির সম্পর্ককে সমর্থন করে এসেছে। শেষে বলতে হয়, বাংলাদেশিরা নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিজেরাই নির্ধারণ করবে, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র  রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সংলাপ এবং সমঝোতাকে উত্সাহিত করতে পারে, গণতান্ত্রিক সংস্কারে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে পারে, যুবদের ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ করতে পারে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে বাংলাদেশের সংস্কারকদের হাত শক্ত করতে পারে।

বাংলাদেশের সামনের পথটি বিপদসংকুল, কিন্তু গণতন্ত্রের শক্তিগুলো- বিশেষ করে এর তরুণরা - চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে  প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হলো, দেশের মাটিতে জেগে ওঠা  বিপ্লব এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। বছরের পর বছর সুপ্ত থাকার পর নাগরিকদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্খা প্রকাশ পেয়েছে। যদি এটি দমন করা হয়, তাহলে সেই ক্ষোভ আরো হিংস্রতার সাথে  ফেটে  পড়তে পারে। রাজনৈতিক ও নাগরিক প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিগত পুনরুদ্ধারের মধ্যে জনগণের দাবিগুলিকে গুরুত্ব দেয়া  দেশকে স্থিতিশীলতা এবং  অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রও  এই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করবে ।

সূত্র : ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অফ পিস

No comments

Powered by Blogger.