কার দায় কতো? by মো. আল-আমিন
এ কারণে এই নির্বাচন পরিচিত হয় ডামি নির্বাচন হিসেবে। বলা হয়ে থাকে দশম সংসদ নির্বাচন এক তরফা ও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আয়োজন করে রকিব কমিশন আওয়ামী লীগকে বিনা ভোটে দেশ চালানোর লাইসেন্স দেয়। এরপর থেকেই দলটি বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় পরের দুই নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন একতরফা ও একপেশে হয়ে পড়ে। একে একে ভেঙে পড়ে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা। নির্বাচন বিমুখ হয়ে পড়েন ভোটাররা। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মত স্বাধীন কমিশন হয়েও সরকারি দলের আজ্ঞাবহ এবং তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করে পর পর তিনটি নির্বাচন কমিশন দেশকে এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে নিপতিত করে। দেশকে এই অবস্থায় নেয়ার পেছনে তিনটি কমিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাই দায়ী। নির্বাচন কমিশন সঠিক ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাস ভিন্ন হতে পারতো। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর এখন যেসব ঘটনার বিচারের দাবি উঠছে তিনটি নির্বাচন কমিশনে থাকা সবার দায় নিরুপণ করে বিচারও জরুরি।
বিনা ভোটের নির্বাচন
কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বিরোধী দলবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল, তা এই কমিশন ধ্বংস করে দেয়। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ না থাকলেও বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করে রকিবউদ্দীন কমিশন। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোট ও তাদের শরিক দলের প্রার্থীরা ভোটের আগেই ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এতে ভোটের আগেই সরকার গঠনের আসন পেয়ে যায় আওয়ামী লীগ। এছাড়া এতে পাঁচ কোটির বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ হারায়। এদিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পায়। আর জাতীয় পার্টি ৩৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৬টি, জাসদ (ইনু) ৫টি, তরীকত ফেডারেশন ২টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ২টি, বিএনএফ ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১৬টি আসনে জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে (১৪৭টি আসনে) ভোট প্রদানের হার দেখানো হয় ৪০ দশমিক ০৪ ভাগ। নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৃতীয় দফা সরকার গঠিত হয়। এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে সংসদে বিরোধী দল বানানো হয়। একই সঙ্গে দলটি থেকে মন্ত্রীও করা হয় এবং এরশাদকে বানানো হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। জাতীয় পার্টি আসলে সরকারের অংশ নাকি বিরোধী দল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সংকটের পেছনে এই কমিশনের দায় সবচেয়ে বেশি।
রাতের ভোট
২০১৪ সালের মতো ২০১৮ সালেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় ছিল। নির্বাচনের আগে বিএনপি’র সঙ্গে আরও কিছু দল যুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি রাজনৈতিক জোট গঠন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ আরও কিছু দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করেন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এমন প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৫৮টি আসন পায়। অন্যদিকে জাতীয় পার্টি ২২টি এবং মহাজোটভুক্ত অন্য দলগুলো ৮টি আসনে জয়ী হয়। আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত বিএনপি পায় মাত্র ৬টি আসন। এছাড়া গণফোরাম ২টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে জয়ী হন। এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় মোট ভোটের ৭৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বিএনপি পায় মাত্র ১২ দশমিক ০৭ শতাংশ ভোট। একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং ১ হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের ওপর ভোট পড়ে। অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭৫টি আসনের ৫৮৬টি কেন্দ্রে যতগুলো বৈধ ভোট পড়ে তার সবগুলোই পেয়েছে নৌকা মার্কার প্রার্থীরা। এসব কেন্দ্রে ধানের শীষ কিংবা অন্য প্রার্থী কোনো ভোটই পাননি।
এ নির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি ও ফলাফল যে স্বাভাবিক ছিল না, তা হুদা কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার তার নির্বাচননামা বইয়ে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, জনগণের কাছে একাদশ সংসদ নির্বাচন রাতের নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এই নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবেও গ্রহণযোগ্যতা হারায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় ছিল রাতের ভোট। বিএনপি এবং তাদের জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অনেক প্রার্থী ভোটের আগের রাতেই ভোটকেন্দ্র নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। তাদের অভিযোগ ছিল, রাতেই কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটের প্রার্থীর সমর্থকেরা ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরেন। আগের রাতে সিল মারার সত্যতা গণমাধ্যমেও উঠে আসে।
ডামি নির্বাচন
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে একটি ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনও ছিল বিতর্কিত। এমন বাস্তবতায় ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি একতরফাভাবে এই নির্বাচন আয়োজন করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সাড়ে ৭ মাস আগে আয়োজিত এই নির্বাচনও বয়কট করে বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে বিভিন্ন আসনে বিরোধী প্রার্থী হিসেবে ডামি প্রার্থী (নকল) দেয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
এই নির্বাচনের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেন বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পর্যাবেক্ষক সংস্থা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) তাদের প্রতিবেদনে বলে, বিরোধীদের অনুপস্থিতির প্রেক্ষাপটে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আগের তুলনায় সহিংসতা কম হলেও মান ক্ষুণ্ন হয়েছে। অন্যদিকে এ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আরেকটি বিতর্কিত বিষয় ছিল ভোটের অস্বাভাবিক হার। নির্বাচনের দিন সকাল থেকে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম থাকলেও ৪১ শতাংশ ভোট পড়ার তথ্য দেয় নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের দিন ৩ দফা ভোটের শতকরা হার ঘোষণা করে ইসি। সেই হিসাব অনুযায়ী দুপুর ১২টা ১০ মিনিট পর্যন্ত গড়ে সাড়ে ১৮ শতাংশ ভোট পড়ে। এরপর বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ ভোট পড়ার কথা জানানো হয়। অর্থাৎ প্রায় ৩ ঘণ্টায় ভোট বাড়ে ৮ শতাংশ। সে হিসাবে ঘণ্টায় ভোট প্রদানের হার ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সকাল ৮টায় শুরু হওয়া ভোটে দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে এসে কমিশন জানায়, ভোট পড়েছে ১৮ শতাংশ। সে হিসাবে ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৫০ শতাংশ ভোট পড়ে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে দেখা গেছে, সকাল থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট প্রদানের হার সবচেয়ে বেশি থাকে। তারপর এই হার কমতে থাকে। বিশেষ করে বিকাল ৩টার পর হাতেগোনা ভোটার ভোট দিতে আসেন। নির্বাচন কমিশনের দেয়া হিসাবেও দেখা গেছে দুপুর ১২টার পর থেকে ৩টা পর্যন্ত ঘণ্টায় ভোট প্রদানের হার ছিল ২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু শুধু শেষ এক ঘণ্টায় ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। অর্থাৎ ১ কোটি ৭৬ লাখ ৫৯ হাজার ৮৮৮ জন ভোটার ভোট শেষ হওয়ার পূর্বের এক ঘণ্টায় তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই দেখা যায়নি। বিরোধী দলগুলোর দাবি, এ নির্বাচনে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ভোট পড়তে পারে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি।
কার কতো দায়?
দেশের চলমান সংকটের জন্য গত তিনটি নির্বাচন কমিশনকেই দায় দিচ্ছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এই তিন কমিশনের কারণেই এতো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সংকটে পড়তে হয়েছে। তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা উচিত।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন যদি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন না করতেন, তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাস ভিন্ন হতো। এই নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের (আওয়ামী লীগের) মধ্যে ধারণা তৈরি হলো যে, তারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে এবং পারবে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন রাতের ভোট আয়োজন করে এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিতর্কিত একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করেন। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য এই তিন কমিশনই দায়ী। তারা বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন চাইলে যেকোনো নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনটা যদি না হতো তাহলে আজকের ঘটনা ঘটতো না। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজন করার দায়ে এই তিন কমিশনেরই বিচার হওয়া উচিত।
সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান এ বিষয়ে বলেন, শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছা প্রয়োজন। নির্বাচনকালীন সরকার চাইলেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশন যতগুলো ভালো নির্বাচন করেছে, সেগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হয়েছে। তিনি বলেন, তাদের ব্যর্থতা আছে। আমরা বলতে পারি তারা পদত্যাগ করলো না কেন? তবে সেটাও চিন্তা করতে হবে যে, তখন পদত্যাগ করার মতো পরিস্থিতি থাকে কিনা। আমি পদত্যাগ করার পর যদি আয়নাঘরে যেতে হয়, নিপীড়নের স্বীকার হতে হয়। এগুলোও বিবেচনা করতে হবে।
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, সংকটের জন্য কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের দায় সবচেয়ে বেশি। তারা যদি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্থগিত করতেন, তাহলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।
No comments