শেখ হাসিনা কেন বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবেন না by ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
মোট পাঁচটি কারণে কোনো ব্যক্তি তার নিজ দেশে নিরাপদ না থাকলে দেশ থেকে বের হয়ে অন্য নিরাপদ দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। পাঁচটি কারণের মধ্যে একটি হলো Seeking asylum based on political opinion (রাজনৈতিক মতামতের ভিত্তিতে আশ্রয় চাওয়া) বা সহজ কথায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা।
বাংলাদেশে সফল গণ-অভ্যূত্থানের পর ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তার চূড়ান্ত গন্তব্য কোথায় হবে, সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর পরিষ্কারভাবেই জানিয়েছেন যে, শেখ হাসিনার জন্য ভারত শেষ গন্তব্য নয়।
তাহলে কোথায় যাবেন শেখ হাসিনা? অনেকে জল্পনা-কল্পনা করছেন যে, তিনি হয়তো বৃটেনে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করবেন। এই জল্পনা-কল্পনার কারণ হলো শেখ হাসিনার ছোটবোন ও বোনের মেয়ে বৃটেন থাকেন।
আসলে কি শেখ হাসিনা বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করবেন? করতে পারবেন? করলে পাবেন? অনেকে না বুঝেই বলেন যে, শেখ হাসিনা হয়তো এসাইলাম ভিসা নিয়ে বৃটেনে আসতে পারেন। এসাইলাম ভিসা নিয়ে বৃটেনে আসার কোনো নিয়ম বা আইন নেই। অথবা এসাইলাম ক্লেইম করার জন্য আগাম জানিয়ে কোনো ভিসায় আসারও আইন নেই।
জাতিসংঘের সনদ ও বৃটেনের অভ্যন্তরীণ আইন অনুযায়ী আশ্রয়প্রার্থী তার নিজ দেশ থেকে সরাসরি বৃটেনে এসে বৃটেনের পোর্ট বা এয়ারপোর্টে তাৎক্ষণিকভাবে অথবা বৃটেনে ঢুকে প্রথম সুযোগেই (at earliest opportunity) রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতা ত্যাগ করে ভারতে পলায়ন করেছেন। ভারত তার জন্য একটি নিরাপদ দেশ। সেখান থেকে বৃটেনে এসে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক সনদ, বৃটেনের অভ্যন্তরীণ আইন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে বলা যায় যে, চারটি কারণে শেখ হাসিনা বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় পাবেন না বা আবেদন করলেও তা মঞ্জুর হবার সম্ভাবনা নেই। চলুন কারণগুলো দেখি:
প্রথমত: জাতিসংঘের রিফিউজি সনদ ও বৃটেনের আইন অনুযায়ী কোনো আশ্রয়প্রার্থী (asylum seeker) তার নিজের দেশ থেকে বের হয়েই যে নিরাপদ দেশে যাবেন তাকে সেখানেই আশ্রয় চাইতে হবে। এটাকে বলে Safe Third Country (নিরাপদ তৃতীয় দেশ)। ঐ নিরাপদ তৃতীয় দেশ হয়ে বা ঐ দেশ থেকে এসে বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে তা নাকচ করে ঐ নিরাপদ তৃতীয় দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। শেখ হাসিনার জন্য Safe Third Country হচ্ছে ভারত এবং তিনি সে দেশে গিয়েই উঠেছেন বা আশ্রয় নিয়েছেন। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তার ভারতেই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করা উচিৎ। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা না করে বৃটেনে এসে করতে চাইলে আইন অনুযায়ী তা নাকচ করা হবে অথবা ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হবে অথবা ভারত থেকে বৃটেনে ঢুকতে বা আবেদন করতেই দেয়া হবে না। Safe Third Country - এ ব্যাপারে বৃটেনে settled law আছে। এ ব্যাপারে Section 80B and 80C of the Nationality, Immigration and Asylum Act 2002 and Paragraph 327F of the Immigration Rules -এ বিস্তারিতভাবে বলা আছে। এ ছাড়া Safe Third Country সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে উচ্চ আদালতের বহু নজির (Precedent) ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: উপরের আইন বা নিয়মের বাইরে গিয়েও যদি বৃটিশ সরকার কোনো কিছু করতে চায় তাতেও সমস্যা আছে। এখানে national interest (জাতীয় স্বার্থ) বা public interest (জনস্বার্থ) সম্পর্কিত বিষয় আছে যা বৃটিশ সরকারকে তাদের বিবেচনায় নিতে হবে। শেখ হাসিনাকে বৃটেনে আশ্রয় দিলে তাকে নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা (security and protection) দিতে বৃটিশ সরকারকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হবে। বৃটেনে অর্ধ মিলিয়ন থেকে এক মিলিয়ন বাংলাদেশির বসবাস। গত ১৫-১৬ বছরের স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভিকটিম হচ্ছেন বৃটেন প্রবাসী অনেকেই। গত দেড় দশকে বিশেষ করে ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বৃটেন প্রবাসী অনেকের আত্মীয় স্বজন নিহত, আহত, গুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গত দেড় যুগে দেখা গেছে বাংলাদেশের বাইরে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক আন্দোলন ও প্রতিবাদ হয়েছে লন্ডনে। শেখ হাসিনা স্বয়ং লন্ডনে আসলে কেবল বিএনপির মারমুখী প্রতিবাদে অস্বস্তি অনুভব করেছেন একাধিকবার। পুলিশকে অনেক সময় এ সব মিটিং-মিছিল নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয়।
এমতাবস্থায় শেখ হাসিনাকে বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় দিলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও প্রতিবাদের মাত্রা আরও বাড়বে নি:সন্দেহে। সম্প্রতি ছাত্র বিক্ষোভে বৃটেনে বসবাসরত অধিকাংশ বাংলাদেশি সমর্থন যেমন দিয়েছেন, তেমনি শেখ হাসিনার বিচারের দাবিতেও তারা সোচ্চার হয়েছেন। সুতরাং এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বৃটেনে শেখ হাসিনার উপস্থিতি পূর্ব লন্ডনে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থিত আলতাব আলী পার্ক, সেন্ট্রাল লন্ডনের হাইড পার্ক কর্নার, বৃটিশ পার্লামেন্ট স্কোয়ার ও ডাউনিং স্ট্রিটে (বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন) প্রতিবাদের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে। অবনতি হবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। পুলিশকে অনেক রিসোর্স ডাইভার্ট করতে হবে এগুলো সামাল দিতে। সব মিলিয়ে প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করতে হবে বৃটিশ সরকারকে। আর এ পাউন্ডগুলো আসবে জনগণের পকেট (public purse) থেকে। ফলে সৃষ্টি হবে গণ-হৈচৈ (public outcry)। তাই জনস্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বৃটিশ সরকার এসাইলাম আইনের বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনার জন্য কিছু করবে বলে মনে হয় না।
তৃতীয়ত: ছাত্র বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনী যে শক্তি প্রয়োগ করেছে সেটির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল পশ্চিমা বিশ্ব, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মারাত্মক গণহত্যার ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে জাতিসংঘ শিশু হত্যার নাম, তালিকা ও বিবরণসহ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ইতিমধ্যে ICC (International Criminal Court - আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত) - এ গণহত্যার অভিযোগ গিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যদি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিষয়গুলো তদন্ত করে এবং কোনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় সেটি এক ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করবে। এমন ব্যক্তিকে বৃটেন আশ্রয় দিলে বৃটেনকে আন্তর্জাতিকভাবে মারাত্মক বিব্রতকর (embarrassing) অবস্থায় পড়তে হবে।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সদ্য প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার তথা ৫৯ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা আত্মসাৎ করেন। এটি মারাত্মক ধরনের একটি অভিযোগ। কপালে চোখ উঠা এমন বিশাল দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে বৃটিশ সরকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে মারাত্মক বিব্রতকর অবস্থায় পড়ার ঝুঁকি নেবে বলে মনে হয় না।
চতুর্থত: ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, শেখ হাসিনা অতীতে কদাচিৎ পশ্চিমাদের পছন্দের তালিকায় যেতে পেরেছেন, কিন্তু কখনও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে উঠতে পারেননি। এমতাবস্থায় শেখ হাসিনার প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে বলে মনে হয় না। তার ঘনিষ্ঠতা ছিল বরং পশ্চিমাদের মিত্র নয় (ক্ষেত্র বিশেষ প্রধান শত্রু) এমন দেশগুলোর সাথে, যেমন রাশিয়া। তার দীর্ঘ শাসন আমলে সকল কূটনৈতিক নিয়ম (diplomatic norms) ভঙ্গ করে অত্যন্ত বিশ্রী ও কঠোর ভাষায় পশ্চিমাদের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আক্রমণ করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ও পরীক্ষিত মিত্র দেশ হচ্ছে বৃটেন। আর সেই বৃটেন আন্তর্জাতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার বলয়ের বাইরে গিয়ে তাকে আশ্রয় দিবে বলে মনে হয় না। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার ভিসা বাতিল করেছে।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে, অতীতে বিভিন্ন সময় পতিত স্বৈরাচাররা রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে ইউরোপ কিংবা আমেরিকায়। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো ব্যতিক্রম হবে কেন? তবে ঐসব ঘটনা ঘটেছে অনেক আগে স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War) ঠিক পরবর্তী অবস্থায়। আধুনিক প্রযুক্তি ঐ সময় ছিল না। স্বৈরাচাররা অনেক কুকর্ম করে লুকিয়ে পার পেয়েছে। বাংলাদেশে সম্প্রতি যা হয়েছে সেটি সবাই দেখেছে। যদিও হাসিনা রেজিম ইন্টারনেট ব্লাকআইট করত: বিশ্ব থেকে বাংলাদেশকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন করে অনেক কিছু লুকাবার চেষ্টা করেছে। এতে হিতে বিপরীত (counter productive) হয়েছে। অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার পর প্রচুর ভিডিও-ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে। বিশ-ত্রিশ বছর আগে বিষয়গুলো এতো দ্রুত বিশ্বে ছড়াতো না। যে পরিমাণ রক্তপাত হয়েছে এবং শেখ হাসিনার প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি (perception) আন্তর্জাতিকভাবে তৈরি হয়েছে সেটি অবজ্ঞা করে পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে বৃটেন তাকে আশ্রয় দেবে বলে মনে হয় না।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখলাম শেখ হাসিনা বেলারুশে যেতে পারেন। মুলত: শেখ হাসিনার মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিশ্বের যেসব দেশ মাথা ঘামায় না অথবা যে সব দেশ তাদের নিজ দেশের বাইরের ব্যাপার নিয়ে তেমন আগ্রহী নয় সে সব দেশ হয়তো তাকে আশ্রয় দিতে পারে, করতে পারে সাদরে গ্রহণ। সবকিছুর বিবেচনায়, ভারত বা ভারতের বাইরে বেলারুশ, রাশিয়া, বুলগেরিয়া বা এ ধরনের দেশই হবে সম্ভবত: শেখ হাসিনার নিরাপদ ঠিকানা।
নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk
No comments