কাদের মির্জার যত অনিয়ম দুর্নীতি by মারুফ কিবরিয়া
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নিজ নির্বাচনী উপজেলা এটি। কাদের মির্জা তারই আপন ছোট ভাই। ১৫ বছর তিনি এখানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসন সবই ছিল তার কাছে তুচ্ছ। স্থানীয়রা দাবি করেন, ওবায়দুল কাদের এলাকায় খুব একটা যাতায়াত না করলেও ভাইয়ের মন্ত্রিত্ব ও দলীয় সর্বোচ্চ পদ থাকায় বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠেন কাদের মির্জা।
সরজমিন জানা গেছে, বসুরহাটের সাবেক এই পৌর মেয়র ও তার পরিবারের লোকজনের কাছে পুরো কোম্পানীগঞ্জবাসীই ছিলেন জিম্মি। কেউ তার বিরুদ্ধে কিছুই বলতে পারতেন না। চাঁদাবাজি, ঠিকাদার নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী মত দমন, নিয়োগ বাণিজ্য- কী করেননি তিনি? অত্যাচার চালিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপরও।
কাদের মির্জার যত অনিয়ম, দুর্নীতি: কোম্পানীগঞ্জের টেন্ডারবাজি, দখল, চাঁদাবাজি, মন্ত্রী কোটার টিআর, কাবিখা, সরকারি অফিস-আদালত সবই কাদের মির্জার নিয়ন্ত্রণে চলতো। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত মির্জার ইশারা ছাড়া কিছুই হতো না। স্থানীয় প্রশাসনও কখনো মির্জার ইচ্ছার বাইরে যাননি। বসুরহাট বড় মসজিদসহ বিভিন্ন মসজিদের ইমাম কে হবেন তাও ঠিক করতেন কাদের মির্জা। বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরের প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশের সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের সকল অফিস থেকে চাঁদা আদায় করতেন তিনি। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ভয় দেখাতো ফেসবুক লাইভে এসে সব বলে দেয়ার। নিজের দলের নেতাকর্মী, সমর্থকদের থেকেও বিভিন্ন অজুহাতে চাঁদা আদায় করতেন। আওয়ামী লীগ সমর্থক চরকাঁকড়া ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খালের পাশে হওয়ায় খালের ওপর কালভার্ট করায় কয়েক ধাপে ৩ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন কাদের মির্জা। বসুরহাট বাজারের প্রায় পাঁচ শতাধিক ব্যবসায়ীর থেকে তিনি বিভিন্ন দিবসসহ দল চালানোর কথা বলে বছরে ৫ কোটি টাকার উপরে চাঁদা আদায় করতেন। তার এসব চাঁদা সংগ্রহ করতেন বসুরহাট পৌরসভার কর্মকর্তা করিমুল হক সাথী। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বসুরহাট বাজারের বেশ কয়েকটি স্থান থেকে টোল আদায় করতেন কাদের মির্জা। মির্জার নির্দেশে বছরে প্রায় ২ কোটি টাকার টোল আদায় করতেন তার অনুসারী শ্রমিক লীগ নেতা ওয়াসিম। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে বসুরহাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল মতিন লিটন মানবজমিনকে বলেন, একজন স্বৈরাচার ছিলেন মির্জা কাদের। মানুষকে অত্যাচার নির্যাতন করেছেন ক্ষমতায় থাকাকালীন। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে চাঁদা আদায় করতেন। টাকা না দিলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। ব্যবসা বন্ধের হুমকি দিতেন। তবে ৫ই আগস্ট ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর কোম্পানীগঞ্জের ব্যবসায়ীরা স্বস্তিতে রয়েছেন বলেও জানান লিটন।
মির্জার টর্চার সেল: কাদের মির্জা শুধু মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন না, ক্ষিপ্ত হয়ে মানুষকে কখনো কখনো নিয়ে যেতেন পৌরসভার তিনতলায়। সেখানে তিনি গড়ে তুলেন একটি আধুনিক টর্চার সেল। ওই টর্চার সেলে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ৫০ জন ব্যবসায়ী, শতাধিক আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। টর্চার সেলে ছিল অস্ত্র ভাণ্ডার। এ ছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়েও ছিল একটি টর্চার সেল। সোমবার সরজমিন দেখা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়টি ভেঙে দেয়া হয়েছে। ৫ই আগস্ট কাদের মির্জা এলাকা থেকে পালিয়ে গেলে বিক্ষুব্ধ জনতা অগ্নিসংযোগ করে।
ভূমি দখলের সর্দার মির্জা কাদের: উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের মুছাপুর ক্লোজারে কাদের মির্জা ৬০০ একর খাস জায়গা দখল করেন। এরপর ভুয়া ভূমিহীন সাজিয়ে ৪ কোটি টাকার ভিটি বিক্রি করেন। ক্লোজার সংলগ্ন নদী থেকে গত ৩ বছর অবাধে বালু উত্তোলন শুরু করেন। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রায় ২০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেন কাদের মির্জা। তার এই অবৈধ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন মুছাপুরের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আইয়ুব আলী ওরফে টাকলা আলী। বসুরহাট পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর বাবুলের বসুরহাট বাজারের রূপালী চত্বর সংলগ্ন বহুতল ভবন কৌশলে দখল করে নেন কাদের মির্জা। উপজেলা ভূমি অফিসের খাস জায়গা দখল করে বাবার নামে মোশারেফ হোসেন ডায়াবেটিক হাসপাতাল নির্মাণ করেন।
কাদের মির্জার হেলমেট বাহিনী: কাদের মির্জার ছিল সশস্ত্র হেলমেট বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল শতাধিক। কোম্পানীগঞ্জের মানুষ ছিল তাদের কাছে জিম্মি। এ বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরনবী চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খিজির হায়াত খান, উপজেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান রিপনসহ প্রায় ২ শতাধিক মানুষ। যুবদল নেতা রাজন ও ফয়সালের বাড়িতে হামলা চালায় এ বাহিনীর সদস্যরা। হেলমেট বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল কাদের মির্জার ছেলে তাশিক মির্জা কাদের, আর্থিক ও প্রশাসনিক শেল্টারে ছিল মির্জা ও তার স্ত্রী বকুল। হেলমেট বাহিনীর সেকেন্ড কমান্ড ছিল বসুরহাট পৌরসভার কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা রাসেল, হামিদ ওরফে কালা হামিদ, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মারুফ, সাধারণ সম্পাদক তন্ময়, বসুরহাট পৌরসভা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জিসান, কেচ্ছা রাসেল, বাংলা বাজারের পিচ্ছি মাসুদ ওরফে ডাকাত মাসুদ, রাস্তার মাথার শিপন, বসুরহাট পৌরসভার কর্মচারী পিচ্ছি স্বপন, শুঁটকি কামাল, মাছ সবুজ, ঠোঁট কাটা শিবু, পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হোনারি বাড়ির ছায়েদ ও মাছ ব্যবসায় শামীম। এ বাহিনীর সকল সদস্য ছিল আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রধারী। তারা সব সময় কোমরে অস্ত্র নিয়ে চলতে। ২০২২ সালের ১৩ই মে বসুরহাট পৌরসভার করালিয়া এলাকায় মিজানুরের অনুসারীদের ওপর প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে আনোয়ার হোসেনের ধাওয়া করার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ছাড়া ২০২১ সালের ২১শে নভেম্বর রাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খিজির হায়াত খানের বাড়িতে সশস্ত্র হামলাকালে অস্ত্র হাতে আনোয়ার হোসেনকে গুলি করার দৃশ্য সিসিটিভির ক্যামেরায় ধরা পড়েছে। ১৩ই মে’র ভাইরাল ভিডিওতে কেচ্ছা রাসেলের সঙ্গে ছিলেন আরেক অস্ত্রধারী সহিদ উল্যাহ। পিচ্ছি মাসুদের বিরুদ্ধে কোম্পানীগঞ্জ থানায় খুন, ডাকাতি, মাদক, পুলিশের ওপর হামলাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ২১টি মামলা রয়েছে।
এ বিষয়ে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল মানবজমিনকে বলেন, কাদের মির্জা ছিলেন একজন মাফিয়া ডন। তার শাসনামল ছিল বিভীষিকাময়। এলাকায় কোনো স্বাধীনতা ছিল না। উপজেলা আওয়ামী লীগের এমন কোনো নেতাকর্মী নেই যে, কাদের মির্জার হাতে নির্যাতিত হননি। আমি অনেকবার মারধরের শিকার হয়েছি।
মির্জার দোসর কামাল কোম্পানী অঢেল সম্পদের মালিক: কামাল কোম্পানী কবিরহাটের ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের পরিবার ও মির্জার ঘনিষ্ঠ অনুসারী হওয়ার সুবাধে গত ১৩ বছরে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। মির্জার ঘনিষ্ঠ অনুসারী চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাকের যোগসাজশে কোম্পানীগঞ্জের চরএলাহী ইউনিয়নের দক্ষিণ চরএলাহীর তিন মৌজার ১২ একর খাস জায়গা ও সরকারি খালসহ নামমাত্র মূল্যে দখল করে নেন কামাল কোম্পানী। এরপর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের এক মৎস্য ব্যবসায়ীর কাছে ৭ কোটি টাকা জামানত নিয়ে ভাড়া দেয়। ১২০০ একর জায়গার ভাড়া বছর একর প্রতি ৫০ হাজার টাকা। গত জুলাই মাসে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নোয়াখালী সুবর্ণচরে প্রায় ৭০০ একর খাসজমি দখলের অভিযোগ উঠে ধানসিঁড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কামাল কোম্পানী ও মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে তারা উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের চরলক্ষ্মী, উড়িরচর ও চরনোমান মৌজার ১ নম্বর খাস খতিয়ানের ওই জমির ফসল নষ্ট করে অর্ধশতাধিক পুকুর খননকাজ চালাচ্ছেন। গত ১০ বছরে নোয়াখালী এলজিআরডি’র অধীনে নোয়াখালীর কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ সহ বিভিন্ন উপজেলার প্রায় ২ শতাধিক সড়ক নির্মাণে ব্যাপক দুর্নীতি করে কামাল কোম্পানীর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তার গত ১ বছরের কাজ পরিদর্শন করে দেখে যার সত্যতা মিলবে। নিজের ইউনিয়নে প্রতি বছর মেলার নামে নগ্ন নৃত্যের আসর, জুয়া ও অসামাজিক কার্যকলাপ চালান।
মির্জার অবৈধ অস্ত্রের যোগানদাতা আইয়ুব আলী চেয়ারম্যান: ২১ মামলার আসামি পিচ্ছি মাসুদ মুছাপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রক ছিল আইয়ুব আলী। কাদের মির্জার হাতে পিচ্ছি মাসুদকে তুলে দেন আলী। এই পিচ্ছি মাসুদ ও আলীর হাত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক দ্রব্য আসতো মির্জার হেলমেট বাহিনীর হাতে। মুছাপুরের চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাধে মির্জার নির্দেশে মুছাপুর ক্লোজারের ৬০০ একর খাস জায়গা দখল করে আইয়ুব আলী। আলী গত ৪ বছরে মুছাপুর ক্লোজার সংলগ্ন নদী থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকার অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে। মির্জার হাত মাথায় থাকায় স্থানীয় ও জেলা প্রশাসন তাদের কিছুই করতে পারেনি। উল্টো ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ জায়গা দখল ও বালু উত্তোলন বন্ধ করতে গেলে মির্জার নির্দেশে আইয়ুব আলীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী জাহাঙ্গীর ও তার ভাই হামলা চালায়।
পুলিশ পেটানোর অভিযোগ মির্জাপুত্রের বিরুদ্ধে: করোনাকালীন সময়ে পুলিশ চেকপোস্টে কোম্পানীগঞ্জ থানার পুলিশ কনস্টেবল হুমায়ুনকে মারধর করেন কাদের মির্জার ছেলে তাশিক মির্জা। মির্জার বাড়ির সামনের সড়কে এই মারধরের ঘটনা ঘটে। তৎকালীন কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন মো. আরিফুল ইসলাম। পরে তিনি তৎকালীন এসপি’র নির্দেশে ঘটনা ধামাচাপা দেন। নির্যাতনের শিকার পুলিশ কনস্টেবল হুমায়ুন বর্তমানে নোয়াখালীর একটি থানায় কর্মরত আছেন। একাধিক সূত্র দাবি করে, হুমায়ুন বর্তমানে কবিরহাট থানায় কর্মরত আছেন।
মির্জার ছেলের যত অপকর্ম: কোম্পানীগঞ্জের কিশোর গ্যাংয়ের লিডার ছিল মির্জার ছেলে তাশিক মির্জা। বিএনপি-জামায়াত পরিবারের অনেক ছেলেকে ছাত্রলীগে প্রতিষ্ঠিত করেন তাশিক। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের থেকে চাঁদাবাজি করতেন তিনি। ২০১৮ পরবর্তী কোম্পানীগঞ্জে বেপরোয়া মাদক সিন্ডিকেট ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল তাশিক মির্জার হাতে। কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষের সময় বাবার আগ্নেয়াস্ত্র ভাণ্ডার ছিল তার হাতে। চলতি বছরে উপজেলা নির্বাচনের দিন তার গাড়ি করে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সকাল ৮টার মধ্যে উপজেলার ভোট কেন্দ্র দখল করেন। তাদের প্রার্থী গোলাম শরীফ চৌধুরী পিপুলের থেকে নেন এক কোটি টাকা। এ ছাড়া সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে সোনাপুর টু বসুরহাট সড়ক প্রশস্তকরণ কাজে ঠিকাদার ছিদ্দিক উল্যাহ ভুট্টুর থেকে ৬ কোটি টাকা কমিশন নেন তাশিক মির্জা ও কাদের মির্জা। মুছাপুরের খাস জায়গা, বালু উত্তোলন, চর এলাহী ইউনিয়নের খাস জায়গা বিক্রির ভাগ কমিশন পেতেন তাশিক মির্জা।
কাদের মির্জা পত্নীর যত অনিয়ম: চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কবিরহাটের বাটইয়া ইউনিয়নের আমেরিকা প্রবাসী বিএনপি’র নেতা ওমর ফারুকের বাসভবনে বকুল মির্জার নির্দেশে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। হামলার নেতৃত্ব দেয় তার বোনের ছেলে হিমেল। এ ঘটনায় কবিরহাট থানায় মামলা করতে গিয়ে মামলা করতে পারেননি ড. ফারুক। হিমেলের সন্ত্রাসী বাহিনী ভাঙচুর করে সাউন্ড সিস্টেম সহ অন্যান্য মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। পরে কৌশলে ঢাকা থেকে আমেরিকা চলে যান ফারুক। স্থানীয়দের অভিযোগ মতে, মির্জা ফেরাউন হলে তার স্ত্রী লেডি ফেরাউন। উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বকুল মির্জা।
কাদের পরিবারের আরেক ত্রাস শাহাদাত: কাদের মির্জার ছোট ভাই শাহাদাত হোসেন। তিনিও এক নীরব কিলার। ২০২৩ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। অনুমোদনহীন বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণে বাধা দেয়ায় নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) প্রকৌশলী সাইফুল ইসলামকে মারধর ও তার মাথা ন্যাড়া করে দেয় সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই শাহাদাত হোসেন ও তার অনুসারী যুবলীগ নেতা শিপন। দুই দফায় ওই প্রকৌশলীর ওপর নির্যাতন চালানো হয়। কুমিল্লা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন নির্বাহী প্রধানের থেকে আদায় করতেন কোটি টাকার কমিশন। চরএলাহী ইউনিয়নে নয়ছয় করে খাস জায়গা দখল করেন ১৮৫ একর। যার বাজার মূল্য রয়েছে কোটি টাকার উপরে। শাহাদাতের এক সময় সুনির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। ভাই মন্ত্রী হওয়ার পর তার ভাগ্য সহজে ঘুরে যায়। তার কাজ হয়ে দাঁড়ায় ভাইয়ের পরিচয়ে বিভিন্ন দপ্তরে, প্রতিষ্ঠানে দালালি, চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্য। এতেই বনে যান হাজার কোটি টাকার মালিক।
সদরেও কাদের মির্জার সিন্ডিকেট: নোয়াখালী সদর হাসপাতালের ১২ কোটি টাকার এমএসআর টেন্ডার (পথ্য মালামাল, ওষুধ ক্রয়) শিডিউল নিয়ন্ত্রণ করে কোনো সাধারণ ঠিকাদারকে শিডিউল নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়নি কাদের মির্জার একটি সিন্ডিকেট। এর নেপথ্যে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হেলাল উদ্দিন, আরএমও ডা. আজীম, কেরানী মাসুদ, প্রধান সহকারী সুরুজ নিয়মবহির্ভূতভাবে ফাহিম টেইলার্সের মালিক শাহজাহান শাহীনকে কাজ পাইয়ে দেন। এই কাজ বাগিয়ে নিতে নোয়াখালী-৪ আসনের এমপিপুত্র সাবাব চৌধুরীকে নগদ দশ লাখ ও চেকের মাধ্যমে নব্বই লাখ টাকা দেয়া হয়। এই সিন্ডিকেটের আরেক অন্যতম দোসর সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান একেএম শাসমুদ্দিন জেহান ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবদুল মোমিন বিএসসি। গত ১০ বছরে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। এই সিন্ডিকেট থেকে কমিশন পেতেন একরামুল করিম, কাদের মির্জা ও ওবায়দুল কাদের।
কাদের মির্জার সাংবাদিক নির্যাতনের কাহিনী: ২০১৯ সালে স্থানীয় সাংবাদিক এইচ এম মান্নান মুন্নার ছোট ভাইকে জোর করে মুজিব কলেজ থেকে চাকরিচ্যুত করে। হেলমেট বাহিনীর সংবাদ প্রকাশের জের ধরে দৈনিক মানবজমিনের কোম্পানীগঞ্জ প্রতিনিধি নাজিম উদ্দিন খোকনের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন শেষে তাকে মাদক দিয়ে থানায় সোপর্দ করে। দৈনিক আমার সংবাদের প্রতিনিধি আরমানকে বেধড়ক মারধর করে মির্জার হেলমেট বাহিনী। স্থানীয় সাংবাদিক সুভাষের বসতঘরে হামলা করে হেলমেট বাহিনী। মির্জার নির্দেশে সুভাষকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিনিধি জাফর উল্যাহ পলাশকে লাঞ্ছিত করে মির্জা। দৈনিক নয়াদিগন্ত প্রতিনিধি রাসেদকে প্রেস ক্লাবে কার্ড খেলার সময় আটকে ফেসবুকে লাইভে নিয়ে হেনস্তা করে। দৈনিক সকালের সময় প্রতিনিধি আমির হোসেনকে হেনস্তা করতে তার সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দেয়।
মির্জার দুর্নীতি-অনিয়মে সমর্থন ছিল সেতুমন্ত্রী কাদেরের: একাধিক সূত্রে জানা যায় সাবেক সেতুমন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন সমর্থনে কাদের মির্জা বেপরোয়া হয়ে উঠে। মন্ত্রী কোটার টিআর, কাবিখা ও অন্যান্য বরাদ্দ নামমাত্র পেতো দলীয় লোকজন। মন্ত্রীর বরাদ্দে ৮৫ ভাগ মির্জা আত্মসাৎ করতেন। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, উপজেলার উন্নয়নকাজে দশ শতাংশ কমিশন, ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা, চাঁদাবাজির কথা জানতেন ওবায়দুল কাদের। সাবেক সেতুমন্ত্রী কাদের নিজেও অনেক বড় বড় কাজ থেকে ভাইদের কোটি কোটি টাকা কমিশন নিয়ে দিয়েছেন এটি তার নিজ উপজেলার মানুষের কাছে ওপেন সিক্রেট।
মির্জার ৫ই আগস্ট: শেখ হাসিনা সরকার পতনের খবরের সঙ্গে সঙ্গে মির্জা তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার একটু পরই তার বাড়িতে হামলা হয়। তখন তারা বাড়ির পাশের এক মেম্বারের ঘরে আশ্রয় নেন। এর একদিন পর সেখান থেকে বৃষ্টির মধ্যে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে গাঢাকা দেয়। তবে তাদের বর্তমান অবস্থান অজানা। জনশ্রুতি রয়েছে, হামলাকারীরা ওই দিন মির্জার ঘর থেকে ১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ৪০০ ভরি সোনা ও তার ছোট ভাই শাহাদাতের ঘর থেকে ১০ কোটি টাকা লুট করে নেয়। হামলার সময় শাহাদাতের স্ত্রী পুকুরে ২ ঘণ্টা লুকিয়ে থাকে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রণব চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, কাদের মির্জার বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করার সাহস পেতেন না। প্রশাসনও তার কাছে জিম্মি ছিলেন। অনেকটা স্বেচ্ছাচারিতার মনোভাব ছিল তার। তিনি আরও বলেন, কাদের মির্জার শাস্তি হওয়া উচিত।
No comments