মানুষ মানুষের জন্য
ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে ১১ জেলা। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লায় পরিস্থিতি খুবই নাজুক। বানের পানিতে বাড়িঘর ভেসে যাওয়ায় মানুষের বাঁচার আকুতি। খাদ্য ও পানির হাহাকার। এমন অবস্থায় সারা দেশ থেকে ত্রাণ আর উদ্ধারের সহযোগিতা নিয়ে দুর্গত এলাকায় ছুটে যাচ্ছে মানুষ। দেশ জুড়ে চলছে ত্রাণ সংগ্রহের কার্যক্রম। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা রাত-দিন একাকার করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ত্রাণ কার্যক্রমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যেখান থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধেছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে গণ ত্রাণ কার্যক্রমের সদরদপ্তর। হাজার হাজার মানুষ ত্রাণ নিয়ে আসছেন। নগদ অর্থ নিয়ে আসছেন কেউ কেউ।
শিশুরা আসছে মাটি বা
প্লাস্টিকের ব্যাংকে জমানো টাকা নিয়ে। এতিমখানার শিশুরা তাদের খাবারের টাকা
বাঁচিয়ে নিয়ে আসছে টিএসসিতে। পেশাজীবীরা যার যা সামর্থ্য আছে তা নিয়েই
হাজির হচ্ছেন। ত্রাণ সংগ্রহ প্যাকেট করা এবং তা দুর্গত এলাকায় পৌঁছে দিতে
নির্ঘুম সময় কাটাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। শুধু কি
টিএসসি। পুরো রাজধানী জুড়ে ত্রাণ সংগ্রহ করছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
পাড়ায় পাড়ায় করা হয়েছে ত্রাণ সংগ্রহের কমিটি। যে যা পারছেন তা দিয়েই শরিক
হচ্ছেন। খাদ্য, টাকা, জামা জমা হচ্ছে ত্রাণের ভাণ্ডারে। দলবদ্ধভাবে তা নিয়ে
যাওয়া হচ্ছে দুর্গত এলাকার মানুষদের জন্য। সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল,
ছাত্র সংগঠন ঝাঁপিয়ে পড়েছে দুর্গত এলাকায়। এ যেন এক অন্য বাংলাদেশ।
টিএসসিতে তিনদিনে জমা পড়লো তিন কোটির বেশি অর্থ
বিশ্ববিদ্যালয়
রিপোর্টার জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গত তিনদিন এক অসাধারণ
সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়েছে। বন্যায় বিপর্যস্ত জেলাগুলোর সহায়তায় যেন সেখানে
এক হয়েছে পুরো রাজধানীবাসী। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে তারা এগিয়ে এসেছিলেন
ক্ষতিগ্রস্তদের সেবায়। দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ত্রাণ হিসেবে আসা সব
সামগ্রী সুশৃঙ্খলভাবে বুঝে নিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। মধুর কোলাহলে, ঐক্যে, ভ্রাতৃত্বে,
মানবিকতায় আর দেশপ্রেমে টিএসসি যেন হয়ে ওঠে নতুন বাংলাদেশের এক খণ্ড
চিত্র।
সরজমিন টিএসসি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, দিনব্যাপী সেখানে ভিড়
লেগে আছে ত্রাণ দিতে আসা লোকজনের। কিশোর থেকে শুরু করে ষাটোর্ধ বয়স্করাও
এসেছিলেন মহৎ এই কাজে অংশ নিতে। কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি, কেউ ভ্যানে করে, কেউ
আবার ছোট ট্রাকে করে ত্রাণ নিয়ে আসছিলেন। ত্রাণ দিতে আসা লোকজনের ভিড় ও
গাড়ি টিএসসি এলাকা ছাপিয়ে আশেপাশের এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছিল।
টিএসসি’র
প্রধান ফটকে বুথ স্থাপন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে থাকা
শিক্ষার্থীরা গত তিনদিন ত্রাণ সংগ্রহ করেন। বুথে থাকা শিক্ষার্থীরা দাতার
নাম ও পণ্যের বিবরণ লিখে রাখেন খাতায়। পাশাপাশি অনেকে নগদ অর্থ দিয়ে
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান। সেই অনুদানের অঙ্কও শিক্ষার্থীরা খাতায় লিখে
রাখেন। গত তিন দিনে নগদ অর্থ উঠেছে তিন কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে
শুক্রবার কর্মসূচির দ্বিতীয়দিনেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই উদ্যোগে ১
কোটি ৪২ লাখ ৫০ হাজার ১৯৬ টাকা জমা পড়েছিল।
বৃহস্পতিবার গণত্রাণের
এই কর্মসূচি শুরু করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেদিন নগদ অর্থ এসেছিল
২৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৩ টাকা। আর গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত উঠেছিল সোয়া কোটি
টাকার বেশি নগদ অর্থের পাশাপাশি সর্বসাধারণের দেয়া নানা ত্রাণসামগ্রীতে
কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে টিএসসি’র বিশাল বিশাল সব কক্ষ। টিএসসি’র
অভ্যন্তরীণ ক্রীড়াকক্ষ ও ক্যাফেটেরিয়ায় পূর্ণ হয়ে মাঠও ভর্তি হয়ে গিয়েছিল
ত্রাণসামগ্রীতে। শত শত শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত পরিশ্রমের
পরেও ত্রাণের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের। ত্রাণ নিয়ে
আসা বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগমে টিএসসি এলাকা গত তিনদিন সকাল-সন্ধ্যা ছিল
লোকারণ্য।
ত্রাণ বুথে লিপিবদ্ধ হওয়ার পর সেটি স্বেচ্ছাসেবকদের হাত ঘুরে
টিএসসি’র ভেতরে যাচ্ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহায়তায় সেখানে চলে
প্যাকেজিং এর বিশাল যজ্ঞ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক
আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, প্রায় ৪০০ জন স্বেচ্ছাসেবক এই গণত্রাণ
কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করছেন। জমা দেয়া ত্রাণের মধ্যে নগদ অর্থ,
শুকনো খাবার ছাড়াও আছে- স্যালাইন, স্যানিটারি প্যাড, জরুরি ওষুধ, মোম,
দিয়াশলাই, গুড়, নানারকম পোশাক এবং পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট।
বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলন ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ, ইনস্টিটিউট ও
হলের উদ্যোগে শিক্ষার্থীরা নগদ অর্থ ও শুকনো কাপড় সংগ্রহ করছেন।
শিক্ষার্থীদের অনেকগুলো দল ইতিমধ্যে ফেনী ও নোয়াখালীতে উদ্ধার অভিযান ও
ত্রাণ বিতরণ করতে গেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব
ত্রাণসামগ্রী প্যাকেজিংয়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনের সামনে থেকে একের
পর এক ট্রাকে করে পাঠানো হচ্ছে বন্যাদুর্গত এলাকায়।
No comments