পুত্র ও ভাই মিলে এডিপি’র কোটি টাকা তছরুপ করেন সাবেক এমপি by প্রতীক ওমর
অপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন স্থানে কাজ দেখিয়ে ও বিতরণকৃত মালামাল ক্রয়ের নামে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা প্রকৌশলী ও উপজেলা চেয়ারম্যান। এসব নানামুখী অনিয়ম করে ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। অন্যদিকে নিজ দলের নেতা কর্মীদের বিপদে ফেলে ইতিমধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছেন এসব অনিয়মের মাস্টারমাইন্ড বগুড়া-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহাদারা মান্নান শিল্পী ও সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট মিনহাদুজ্জামন লিটন। এতে করে এই ‘এডিপি’ প্রকল্পের বেশকিছু কাজ ঝুলে আছে। তবে কাজ ঝুলে থাকলেও এসব নির্মাণে সমুদয় অর্থ অনেক আগেই উত্তোলন করা হয়েছে।
এনুয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রোগাম (এডিপি)। বেশকিছু নিয়মনীতি অনুসরণ করে এই প্রকল্পের কাজ করতে হয়। কী ধরনের কাজ করা যাবে আর কী ধরনের কাজ করা যাবে না তাও উল্লেখ করা আছে এই প্রকল্পের নির্দেশিকা বইটিতে। তবে এসব নিয়ম নীতির তোয়াক্কা কখনোই করা হয়নি বগুড়ার সোনাতলা উপজেলায়। দীর্ঘদিনের আওয়ামী শাসনামলে সবকিছুই নিজেদের একান্ত করে নিয়েছিলেন সাহাদারা মান্নান। তার নানা ধরনের কৌশলে লুটপাট গত কয়েক বছরে লুটপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকা। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সরকারি খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য (এডিপি) অর্থাৎ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সোনাতলায় করা হয়েছে তার উল্টো। এই প্রকল্পের সমুদয় অর্থ ব্যয় করা হয়েছে দলীয় কর্মকাণ্ড ও নিজেদের পকেট ভারী করতে।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বরাদ্দে যে কাজগুলো করা হয়েছে সরজমিন এসব দেখে চোখ কপালে ওঠার মতো। আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে বালুয়া ইউনিয়নের জুয়েলের বাড়ির তিন মাথা মোড় হতে শাহিদুলের বাড়ি পর্যন্ত যে রাস্তার বর্ণনা দেয়া আছে সেখানে মাত্র ৯০ ফিট রাস্তা সিসি ঢালাই করা হয়েছে। যাতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে ৬০-৭০ হাজার টাকা। ১ লাখ ব্যয়ে শিহিপুরের রাস্তা, ২ লাখ ব্যয়ে গণসারপাড়ায় ইটের সোলিং, ১ লাখ ব্যয়ে গড়চৈতণ্যপুর কমারবাড়িতে সিসি ঢালাইকরণ, ১ লাখ ব্যয়ে দিগদাইড় উত্তরপাড়া মসজিদের নিকটে সিসিকরণ, আড়াই লাখ ব্যয়ে রংরারপাড়া দুলুর বাড়ির মোড়ে প্যালাসাইডিংকরণ, উত্তর আটকরিয়ায় আড়াই লাখ ব্যয়ে সিসিকরণ, আড়াই লাখ ব্যয়ে মহিচরণ বুলবুলের ‘ছ’ মিলের পাশে সিসিকরণ, ১ লাখ ব্যয়ে হড়িখালি টেকনিক্যাল কলেজ রোডে সিসিকরণ, দেড় লাখ ব্যয়ে ফুলবাড়িয়ায় ফাইদুলের বাড়ির মোড়ে সিসিকরণ, আড়াই লাখ ব্যয়ে পূর্ব তেকানী বড় মসজিদের পাশে প্যালাইডিং আড়াই লাখ ব্যয়ে পাকুল্লায় এনামুল বাড়ি টুটুলের পুকুর পাড়ে প্যালাসাইডিং করা হয়েছে। এসব কাজে ৩ ভাগের একভাগ অর্থও ব্যয় হয়নি। এ ছাড়া ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে সোনাতলা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ সংস্কারের নামে পুরোটাই পকেটে তোলা হয়েছে। ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যয়ে উপজেলা পরিষদের ভেতরে জয় বাংলা ফোয়ারা নির্মাণ কাজটি কিছুটা হয়ে আটকে আছে। আড়াই লাখ ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিটি একটু কাৎ হয়ে আটকে আছে।
সাড়ে ৪ লাখ ব্যয়ে আব্দুল মান্নান বাস্কেট বল গ্রাউন্ড নির্মাণের নামে কিছু ইট বিছানো হয়েছে। পাকুল্লা উত্তরপাড়া ব্রিজের পাশে ২ লাখ ব্যয়ে আরসিসিকরণের নামে নামমাত্র সিসিকরণ, শিহিপুর সরকার পাড়া মসজিদের কাছে সিসিকরণ উক্ত কাজগুলোর নামে লাখ লাখ টাকা পকেটে তুলেছেন উপজেলা প্রকৌশলী ও উপজেলা চেয়ারম্যান। এ ছাড়া গরিব দুস্থদের মাঝে সেলাই মেশিন, নলকুপ, প্লাস্টিকের চেয়ার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেঞ্চ বিতরণের নামেও করা হয়েছে হরিলুট।
প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে স্প্রে মেশিন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্টিলের আলমারি, গরু খামারিদের মাঝে গামবুট, বিভিন্ন ক্লাবে ক্রীড়াসামগ্রী, ডেস্কটপ কম্পিউটার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মারকার পেন, কলম, মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্রেস্ট বিতরণসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ দেখানোর শতকরা ৮০ ভাগই ভুয়া। তবে যেটুকু বিতরণ হয়েছে এসব সামগ্রীগুলোর উপরে স্টিকার সাঁটিয়ে দেয়া হয়েছে যাতে লেখা রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে কিংবা, নৌকায় ভোট দিন অথবা সাহাদারা মান্নান শিল্পীর পক্ষ থেকে। আবার বিভিন্ন সভা সমাবেশে কিংবা বিতরণকালে এনাউন্স করা হয়েছে যে, উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে এসব দেয়া হচ্ছে।
উক্ত প্রকল্পগুলোর জন্য যেসব কমিটি করা হয়েছে। সেগুলো সম্পূর্ণ ভুয়া। কারণ যাদেরকে কমিটিতে রাখা হয়েছে তারা জানেই না যে এডিপি প্রকল্পের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সদস্য তারা। এই কমিটিগুলোর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তারা যেন আকাশ থেকে পড়েন। কারণ এসবের তারা কিছুই জানেন না। উক্ত প্রকল্পের সদস্যরা দাবি তোলেন আমাদের নাম ভাঙিয়ে যারা লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হোক।
উপজেলা আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী বলেন, আমরা সারাজীবন দল করে কিছুই পাইনি। বরং এমপির পরিবারতন্ত্রের কাছে জুলুম, অত্যাচার-নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আজ এই বিপদের সময়ে তারা আত্মগোপনে চলে গেছে।
এ বিষয়ে সোনাতলা উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান বলেন, বোঝেনি তো বাধ্য হয়ে এসব অনিয়মে সায় দিতে হয়েছে। এমপি উপজেলা চেয়ারম্যান যেসব করতে চাইছে আমাকেও তাই করতে হয়েছে। তিনি আরও বলেন অসম্পূর্ণ যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো করতে ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করে পকেটে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেন, এসবে যে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে তা স্বীকার করতেই হবে। যেসব কাজ এখনো শেষ হয়নি সেগুলোর বিল কীভাবে উত্তোলন করা হলো জানতে চাইলে তিনি বলেন কী আর বলার আছে, বোঝেনি তো সব কেন করতে হয়েছে।
সাবেক সংসদ সদস্য সাহাদারা মান্নান শিল্পী ও উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট মিনহাদুজ্জামান লিটন আত্মগোপনে থাকার কারণে তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
No comments