জুতা-ডিম নিক্ষেপ: যেভাবে ধরা পড়েন বিচারপতি মানিক by ওয়েছ খছরু ও মুফিজুর রহমান
পাহারায় রয়েছে ছাত্র-জনতাও। শামসুদ্দিন মানিককে নিয়ে যে ক্ষোভের শেষ ছিল না সেটি আটকের পর তার নিজ মুখের বয়ানেই স্পষ্ট হয়েছে। পটপরিবর্তনের পর তার ভয় বর্তমান প্রশাসনকে নিয়ে। এ কারণে তিনি সিলেট হয়ে ভারতে পালাতে চেয়েছিলেন। সিলেট সীমান্তে অবস্থান নিয়েছিলেন দু’দিন আগেই। পথ খুঁজছিলেন পালাবার। ডোনার দালালদের হাত ধরলেন। সঙ্গে ছিল ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা। বৃটিশ পাসপোর্টও। ডোনা মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের একটি বস্তি। ওপার ডোনা আর এপার বাংলাদেশের মিকড়িপাড়া। সীমান্তঘেঁষা এক গ্রাম। বাংলাদেশের সীমানাঘেঁষা বাড়ি আলোচিত চোরাকারবারি ও দালাল সাদ্দামের। তার বাড়ি থেকে ৫০ ফুট দূরে সীমানা। বিকাল থেকে সীমান্তের জিরো পয়েন্টের কাছে কলাপাতাকে বিছানা করে শুয়ে ছিলেন শামসুদ্দিন মানিক। এ দৃশ্য চোখ এড়ায়নি স্থানীয়দের।
একজন লোক শুয়ে আছেন সীমান্তে। প্রথমে কেউ পাত্তা দেননি। কিন্তু সময় যত গড়ায় স্থানীয়দের মুখে মুখে রটে এ খবর। এলাকার কয়েকজন যুবক কৌতূহলবশত যান সেখানে। কথা বলেন তার সঙ্গে। সন্ধ্যার একটু আগে সাবেক এই বিতর্কিত বিচারপতি নিজেই বিচারপতি মানিক বলে পরিচয় দেন। একইসঙ্গে তিনি স্থানীয় যুবকদের কাছে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার জন্য সহযোগিতা চান। দিতেও চান টাকা। পরে স্থানীয় যুবকদের ধারণ করা ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তোলপাড় শুরু হয়। নিশ্চিত হওয়া যায় তিনি সাবেক বিতর্কিত বিচারপতি। যাকে নিয়ে গোটা দেশেই আলোচনা। বিচার বিভাগও তার হাত ধরে বিতর্কিত হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকে যুবকরা তাকে ঘিরে রাখে। খবর দেয়া হয় স্থানীয় ইউপি সদস্য নাজিম উদ্দিনকে। তার কাছেও পাঠানো হয় ভিডিও। তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভিডিওটি নিজের ফেসবুকে শেয়ার করেন। খবর দেন বিজিবি’র স্থানীয় বিওপি’র সদস্যদের। দুর্গম পথ। ক্যাম্প থেকে যেতে সময় লাগে একঘণ্টা। বিজিবি’র সদস্যরা সাড়া দিলেও ঘটনাস্থলে যেতে যেতে সময় লাগে অনেক। স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ জানান, বিজিবি গিয়ে কলাপাতায় শোয়া অবস্থায় তাকে আটক করে। এ সময় অবশ্য এলাকার মানুষ ওখানে ছিল। পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তারা আটক করেন। এরপর জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তিনি নিজেও নিজের পরিচয় দেন। এরপর তাকে ডোনা বিজিবি ক্যাম্পে এনে রাখা হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নাজিম উদ্দিন জানিয়েছেন, মিকড়িপাড়া গ্রামের সাদ্দামসহ কয়েকজন দালাল তাকে ভারতে পাঠাতে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। পরে তারা কলাপাতার উপর রেখে চলে যায়। আমার ম্যাসেজে বিজিবি আটক করে। তিনি জানান, ডোনা সীমান্তে দালালরা অনেককেই পাচার করে। এর ধারাবাহিকতায় তারা সাবেক এই বিচারপতিকে ভারত পাঠাতে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু স্থানীয় জনতা ধরে ফেলায় তারা পালিয়ে যায়। তবে, জনতার হাতে আটকের পর শামসুদ্দিন মানিক জানিয়েছেন, স্থানীয় কয়েকজন দালাল তাকে ভারতে পাঠাতে এখানে নিয়ে আসে। বৃহস্পতিবার দুপুরের পর তারা ডোনা সীমান্ত দিয়ে ভেতরে গহীন অরণ্য এলাকায় নিয়ে যায়। ওখানে যাওয়ার পর তাকে মারধর করে সঙ্গে থাকা ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। তবে, ওই যুবকদের তিনি চিনেন না বলে জানান। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ৫ই আগস্টের পর ওই সীমান্ত দিয়ে অনেককে ভারতে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা হয়েছে। দালালদের এই চক্রের মূলহোতা হচ্ছে সাদ্দাম হোসেন। তার বাড়ি মিকড়িপাড়া জিরোপয়েন্টে। সঙ্গে সাবেক মেম্বর মজির, রহিম ও রাজুসহ কয়েকজন ছিল। তারা শামসুদ্দিন মানিককে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে মারধর করে প্রায় ৭০ লাখ টাকা, বৃটিশ পাসপোর্ট, মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। মোবাইল ফোন নেয়ার পর শামসুদ্দিন মানিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এদিকে ভোররাতে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর একটি টিম গিয়ে শামসুদ্দিন মানিককে সিলেটে নিয়ে আসেন বলে জানিয়েছেন কানাইঘাট থানার ওসি জাহাঙ্গীর হোসেন সর্দার। তিনি জানান, বিজিবির পক্ষ থেকে মামলা দায়ের না করায় গতকাল বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে সিলেটের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর হোসেনের আদালতে ৫৪ ধারায় হাজির করা হয়। সিলেট জেলা কোর্ট ইন্সপেক্টর জামসেদ আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আদালত শুনানি শেষে বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিককে কারাগারে আটকে রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন। একইসঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলায় তার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে সেগুলোর অনুসন্ধানপূর্বক ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেছেন। শুনানি শেষে তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানান কোর্ট ইন্সপেক্টর।
আদালতে বিক্ষোভ, ডিম নিক্ষেপ: শনিবার সকাল থেকে সিলেটে আদালতপাড়া ছিল সরগরম। স্থানীয় জনতার ভিড় ছিল। বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষার পর মামলা না হওয়ায় বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শামসুদ্দিন মানিককে আদালতে আনা হয়। এ সময় শ’ শ’ জনতা আদালত এলাকায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কেউ তার ওপর জুতা, কেউ ডিম ছুড়ে মারেন। কেউ কেউ কিল-ঘুষি দেয়ার চেষ্টা করেন। তবে, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কড়া পাহারায় পুলিশ তাকে আদালতে তুলেন পরে বেরও করেন। এ সময় উপস্থিত থাকা সিলেট জেলা বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাপলু বলেন, শামসুদ্দিন মানিক অতীতে যে কর্মকাণ্ড করেছে সেজন্য মানুষ ক্ষোভ দেখিয়েছে। সে বিচার বিভাগকে কলঙ্কিত করেছিল। রাজাকার রাজাকার বলেও স্লোগান দিয়েছে। অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে মানুষের এই ঘৃণা তার প্রাপ্তি বলে জানান তিনি।
No comments