বিচারপতি মানিক, এ পরিণতি ছিল অবধারিত by ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বর্তমান অবস্থা দেখে সত্যিই করুণা হয়। কিন্তু এটাই ছিল তার পাওনা ও নিজ হাতের কামাই। ইতিহাস সাক্ষী এমন মানুষদের এমন পরিণতিই হয়। এটা ছিল অবধারিত। জান ও প্রাণের এতো ভয়! সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি ছিলেন, কিন্তু জান নিয়ে বর্ডার ক্রস করে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পালাতে হবে? এই হলো উনার সাহস ও দম্ভ!  এটা দেখে বারবার সিনেমার ঐ পরিচিত ডায়লগের কথা মনে পড়ে “এর আগে আমার মরণ হলো না কেন…?”।

কি-না করেছেন তিনি! পুরো বিচারবিভাগ ও বিচারবিভাগের সাথে জড়িত সবাইকে হেয় করছেন। অপূরণীয় ক্ষতি করে গেছেন বাংলাদেশের আইনাঙ্গন ও বিচার বিভাগের। মানিক সাহেবের এই পরিণতিতে আছে সবার জন্য শিক্ষা।

কিন্তু তাকে এই দানবে পরিণত করেছিল কারা? তাদের কথা একটুও আলোচনায় আসবে না? আওয়ামী লীগ সরকার তার টার্মের শেষের দিকে ২০০১ সালে চরম এই দলকানা, high tempered ও উগ্র ব্যক্তিকে হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। ঐ বছরই ভূমিধ্বস বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি দু’বছর পর ২০০৩ সালে যখন সময় আসলো তখন এই দলকানা ও উগ্র ব্যক্তিকে বিচারপতি হিসেবে তাকে কনফার্ম করেনি। ফলে বাদ পড়েন মানিক সাহেব হাইকোর্টের বিচারপতির পদ থেকে। ইতিহাস সাক্ষী বিএনপির এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।

হাইকোর্ট থেকে বাদ পড়ে বিচারপতি মানিক লন্ডনে চলে আসেন। ২০০৭ সালের দিকে তৎকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি এসকে সিনহা লন্ডনে বেড়াতে এসেছিলেন। তখন বিচারপতি মানিক ও বিচারপতি সিনহা ছিলেন অনেকটা এক শরীরের দুইপ্রাণ, জানের দোস্ত!  একসাথে লন্ডনে ঘুরাফেরা করেছেন, একসাথে খাওয়া দাওয়া করেছেন, একসাথে মিটিংয়ে যোগ দিয়েছেন। বিচারপতি মানিক বিচারপতি সিনহাকে নিয়ে সাউথ-এন্ড সী বীচে (সমুদ্র সৈকতে) বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার চোখে দেখা- সী বীচে বেড়িয়ে এসে আমার চেম্বারের সামনে কার পার্কে জড়ো হয়েছিলেন অন্য এক বিচারপতির সাথে অন্য এক জায়গায় যাওয়ার জন্য। বিচারপতি সিনহার পরামর্শেই মূলত: মানিক সাহেবসহ যাদেরকে বিএনপি সরকার দলীয় ও অযোগ্য বিবেচনায় বিচারপতি পদ থেকে বাদ দিয়েছিলে অর্থাৎ দুই বছর পর কনফার্ম করেনি তারা হাইকোর্টে রীট করলেন। এরপর তিনজন বিচারপতি নিয়ে বৃহত্তর একটি বেঞ্চ গঠিত হলো। বিচারপতি সিনহাও ঐ বেঞ্চে ছিলেন। রায় এলো মানিক সাহেবদের পক্ষে। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগও আবার ক্ষমতায় আসলো। এ যেন ছিল মানিক সাহেবদের জন্য সোনায় সোহাগা! তারা ফিরে আসলেন হাইকোর্টে বিচারপতি হয়ে ভিন্ন এক স্বরুপে। শুধু ফিরেই আসলেন না, বরং ২০১৩ সালে ২১ জন বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে বিচারপতি মানিককে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে নেয়া হয়। বিচারপতি মানিককে পূনর্বাসিত করতে তাই বিচারপতি সিনহার দায় কম নয়।

পরবর্তীতে উভয়ই আপিল বিভাগে যাবার পর অন্য কারণে মানিক সাহেব ও সিনহা সাহেবের সম্পর্ক হয়ে গেল সাপে-নেউলে।

আওয়ামী ও জাতীয় পার্টির এমপিরা সংসদে মানিক সাহেবের কঠোর সমালোচনা ও গালিগালাজ করলেন এবং বর্ষিয়ান আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমদ নিজে সিটিং বিচারপতি মানিককে “সেডিস্ট” বলে আখ্যায়িত করলেন। সংসদ সদস্যরা ক্ষোভে ফেটে পড়ার পরও কিন্তু সংসদ অদৃশ্য ইঙ্গিতে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলো না। বিচারপতি মানিক হাইকোর্টে সিটিং বিচারপতি থাকা অবস্থায় প্রকাশ্যে ভরা কোর্টে তৎকালীন সিটিং স্পিকার আব্দুল হামিদকে “রাষ্ট্রদ্রোহী” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন যা বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে এসেছে। আশ্চর্যের বিষয় এই বিচারপতি মানিককেই আবার ছয় মাসের মাথায় স্পিকার আব্দুল হামিদ প্রেসিডেন্ট হয়ে আপিল বিভাগে নিয়োগ দিয়ে প্রমোশন দিলেন! এবার ভাবুন আব্দুল হামিদ কোন ধরনের ও কোন ব্যক্তিত্বের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। বিচারপতি মানিককে মাথায় তুলতে প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদের দ্বায় কম?

বিচারপতি মানিক ছিলেন স্পষ্টত ও দৃশ্যমান দলকানা, উগ্র, বদমেজাজী ও চরম প্রতিশোধপরায়ণ। এমন ব্যক্তি নিম্ন আদালতেরই বিচারক হওয়ার অযোগ্য, উচ্চ আদালতে নিয়োগ দেয়া তো দূরের কথা। আমি বহু ফোরামে বলেছি তার মতো ব্যক্তি বাংলাদেশের উচ্চ আদালতের বিচারপতি হওয়া মানে বাংলাদেশের উপর এক গজব নাজিল হওয়া। আর এই গজব নাজিলের প্রধান দ্বায় পতিত ও পলায়নকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

মানিক সাহেব বিচারিক জীবনে দম্ভ, অহংকার ও ক্ষমতা দেখিয়ে গেছেন। এটা থামেনি তার অবসরে যাবার পরও। বরং তা বেড়েছে। দু:খজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এমন ব্যক্তিকে বারবার সুযোগ দিয়েছে দানবে পরিণত হতে। প্রত্যেকটি টকশোতে মানহানিকর কথা বলা ও জীবিত এবং মৃত জাতীয় ব্যক্তিত্বদের গালিগালাজ করার পরও বিভিন্ন টকশোতে তাকে নিয়মিতভাবে ডাকা হতো! তাদের দায় কম?

সমাজ ও রাষ্ট্রের বহু নামী দামী মানুষকে আদালতে ডেকে নিয়ে চরম অপমান করেছেন। বর্তমান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, কবি ও প্রাবন্ধিক আবু মকসুদ, সাবেক খ্যাতিমান সিএসপি অফিসার সচিব আসাফুদ্দৌলা, বিমানের এমডিসহ বহু বিদগ্ধ ব্যক্তিদের হাইকোর্টে ডেকে নিয়ে নাজেহাল করেছেন, দাঁড় করিয়ে রেখেছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার পতিত হওয়ার ক’দিন আগে টকশোর একজন সম্মানীত মহিলা উপস্থাপিকার সাথে অনলাইনে ও অফলাইনে যে ব্যবহার করেছেন তা রীতিমতো মানহানিকর ও ফৌজধারী অপরাধ। লন্ডনেও সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ তার ওপর ক্ষেপা, কেননা তাদের অনেককে বিভিন্নভাবে তিনি নাজেহাল করেছেন।

সুতরাং সব বিবেচনায় বিচারপতি হওয়ার অযোগ্য মানিক সাহেবের দেয়া রায়গুলো আজ সাংঘাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ফাঁসির রায় দিয়ে বারবার টকশো ও পাবলিক মিটিং -এ এভাবে কোনো বিচারপতি বলতে পারেন “আমি ওমুক ওমুককে ফাঁসি দিয়েছি”। এতে তার কুমতলব ও mala fide intention ফুটে উঠে। তাই তার দেয়া প্রত্যেকটি রায় পূনর্বিবেচনা করা আশু প্রয়োজন। আমার দেশ সম্পাদক সাহসী ব্যক্তিত্ব মাহমুদুর রহমান দেড় ডজনের উপরে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তৎকালীন প্রেসিডেন্টের কাছে দিয়েছেন। তখন এই অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিলে মানিক সাহেব এমন দানবে পরিণত হতে পারতেন না। এখন সময় আসছে - ঐ অভিযোগগুলোর আলোকে তার বিরুদ্ধে ফৌজধারী আইনে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দেশ ও ভবিষ্যতের স্বার্থে, বিশেষ করে আইন ও আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে।

বিচারপতি মানিক যতই স্পষ্টত ও দৃশ্যমান দলকানা, উগ্র, বদমেজাজী ও চরম প্রতিশোধপরায়ণ হোন না কেন তার সাথে আচরণ করতে হবে আইনানুগ। তাকে শাস্তি দিতে হবে due process -এর মাধ্যমে competent court - এর দ্বারা। মানিক সাহেবকে অবমাননাকর অবস্থায় বর্ডার ক্রসে ধরা হয়েছে। কোর্টে হাজিরার সময় তাকে নাজেহাল করা হয়েছে। এটা মোটেই কাম্য নয়। যত বড় অপরাধীই থাকুক না কেন, আইনের আশ্রয় নেয়ার ও যথাযথ বিচার পাবার তার অধিকার আছে। এটা তার মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। আইনের শাসনের মূল কথাটিও এটি।

মানিক সাহেবের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও উপাদানসহ কোনো মামলা এখনও চোখে পড়েনি। অথচ তার বিরুদ্ধে মামলা করার বহু কারণ, তথ্য ও উপাদান আছে। তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত তথ্য ও প্রমাণসহ সঠিক আইনে মামলা না করে শুধু আবেগ ও ক্ষোভ জাড়লে শিগগিরই এসব ক্ষোভ ও আবেগ যখন প্রশমিত হবে তখন তিনি অনায়াসে জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন। শাস্তি তো দূরের কথা, একটু সুযোগ পেলে লন্ডনে পালিয়ে আসবেন। তখন আপনাদের হয়তো পস্তাতে হবে।

নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।

Email: ahmedlaw2002@yahoo.co.uk

No comments

Powered by Blogger.